#দার্জিলিং #মহাকালমন্দির #গ্লিনারিস
দার্জিলিং জমজমাট
পর্ব – ৪
©সমীরণসামন্ত
দার্জিলিং মানেই কেভেন্তার, গ্লিনারিজ, টাইগার হিল নয়। আরও একটি মনে রাখার নাম এই মহাকাল মন্দির। ডানদিকে ম্যাল থেকে রগিয়ে চৌরাস্তা ছাড়িয়ে মার্কেট, তার পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই দুটো বড় বড় গেট আপনাকে স্বাগত জানায় মন্দিরের প্রবেশ পথ হিসেবে। এই মন্দিরে অনেকেই এসেছেন। এই মন্দির কে মঠও বলা যায়। এক কথায় বলতে হলে মঠ-মন্দির। কারন এই একমাত্র নজিরবিহীন জায়গা যেখানে শিব ও বুদ্ধ একই সাথে বিরাজমান। শুধু মাত্র শিবের মন্দির বললেও ভুল হবে না। আর একদিকে বুদ্ধমঠ বললেও ভুল নেই। একই মন্দিরে একই সাথে এই দুই ভগবানের পূজা করা হয়। একপাশে শিবের আরাধনার জন্য যেমন পুরোহিত বসেন, ওপর দিকে মঠের সাধু। ছোটবেলায় আমরা অনেক পাঠ্য বইয়ে পড়েছি, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। এই মহাকাল মন্দির তারই এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
দার্জিলিং এর এই স্থানটিকে আজও পবিত্র মানা হয়। এই ব্যাপারে একটা ছোট্ট ইতিহাস রয়েছে।
১৭৬৫ সাল, আজ থেকে প্রায় ২৫৮ বছর আগের কথা। পলাশীর সংঘর্ষ শেষ হয়। সিরাজ-উদ-দোউলা এর হারের ব্যাপারটা পাহাড়ের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে একজন তিব্বতি লামা, নাম দোরজে লিং , উত্তরের এই জায়গায় এসে উপস্থিত হন, যেটা আজকের ‘অব্জারভেটরি হিল’ নামে পরিচিত। একে একে লেপচা, স্থানীয় ভুটানিরা এখানে আসেন এবং আরাধনা শুরু করেন। জায়গাটা যেহেতু একটু উঁচুতে, তাই মেঘের আনাগোনা দেখা যায় অত্যন্ত বেশি, বিশেষত বর্ষায়। এছাড়াও বৃষ্টি সহযোগে এই সময় বজ্রপাত হয় চূড়ান্ত পরিমানে। তখন অনেকেই ঠিক করলেন এই জায়গার নামকরন, “বজ্রপাতের রাজ্য”। ‘দোর্জে’ ও ‘লিং’ দুটি শব্দ থেকে যার অর্থ বজ্রের দেশ। স্থানীয় ভাবে মনে করা হয় এই স্থানের নামকরন সেই তিব্বতি মানুষটার সাথেই যুক্ত।
আমরা প্রায় সকাল আটটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই ওপরে, মন্দিরে। যেহেতু আজ পূর্ণিমা, তাই বেশ সুন্দর করে সাজানো চলছিলো। চারিদিকে সেই রং বেরঙের পতাকা, “ ওম মণি পদ্মে হুম “ লেখা।
ওখানে পুজা দেওয়ার জন্যে ডালি কেনার কনসেপ্ট রয়েছে। জুতো গুলো খুলে আমরা ডালি নিতে গেলাম তার ঠিক পাশেই। একজন দিদি বসে ছিলেন, অত্যন্ত ব্যাস্ততার সাথে সবদিকটা সামলে চলেছেন। মিষ্টি বলতে শুকনো লাড্ডু, নাড়ু, বাদাম এবং সেই রকম জাতীয় জিনিষের চিট, হাতে বাধার ধাগা ইত্যাদি সমস্তটাই আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পাবেন। ( এখানের একটা জম্পেশ খাওয়ার দোকান রয়েছে, পরে বলবো। পুজা দিতে যাবো তো, ওদিকে তাকাতে নেই )
ওপরে উঠে গেলাম দুজনে, খালি পায়ে। পাইন বনে ঘেরা এই ছোট্ট মঠ মন্দির, অনুভূতি একটু অন্য প্রকার ভালোলাগা। হনুমানজি র মন্দির রয়েছে। মন্দিরের প্রাঙ্গনটি কিন্তু বেশ সুন্দর। রো হিসেবে আলাদা করা রয়েছে। ওঠার ও নামার রাস্তা আলাদা। সম্ভবত দুটো করে রো পরপর, মনে পড়ছে।
সবুজ কার্পেট পাতা রয়েছে সারা রাস্তায়। সেদিন বেশ ফাঁকা ছিল। তবে ভীর হঠাৎ করে হয়ে গেলে তাতেও অসুবিধে হবে না বলেই আমার মনে হয়।
ঢুকতে গিয়েই মাথার সামনে বড় বড় ঘণ্টা ঝুলছে। প্রনাম ও মন থেকে নমস্কার জানিয়ে ঢুকে গেলাম মন্দিরে।
ঢং ঢং ঢং
ডানদিকে কালিমাতার মন্দির। মেইন মন্দিরে ঢুকতে গেলে শুরুতে পরে একটি নন্দীর মূর্তি, দরজা ভরিয়ে বসে রয়েছে। ওনাকে ক্রস করে ভেতরে গেলাম।
পূজা দিলাম। ওই জায়গাটা একটু ভীর। তার মধ্যেই গুঁতিয়ে ঢুকতে হয়েছিল বলা যায়। ধূপকাঠি, আগুন, প্রদীপ জালানোর জন্যে প্রাঙ্গনে বিশেষ জায়গা রয়েছে চারিদিকে। একটি বিশেষ প্রকার বড় ঘণ্টা, “ ওম মণি পদ্মে হুম “ লেখা।
পূজা দেওয়ার পর একটা কথা সব্বাই কে বলবো, মন্দিরটা চারিদিকে একটু ঘুরে নেওয়া। জায়গা তেমন বেশি নেই। কিন্তু ওই উচ্চতায় অমন মন্দির, ওই ভাবে সাজানো, জাস্ট ভাবতেও অদ্ভুত লাগবে। আমরা কোলকাতাবাসিরা কথায় কথায় বেলুড়, দক্ষিণেশ্বর যাই না ? কিন্তু ওই পাহাড়ি অঞ্চলেও যে এমন রীতি পালন করা হয়ে চলেছে রোজ রোজ, এটা অনুভবেও অন্য কিছু এনে দেয়।
নামার সময় আবার ওই ডালির জায়গায় গেলাম। হ্যাঁ খিদে পেয়েছে, হ্যাঁ খাবো খাবো।
মোমো নিলাম এক প্লেট করে। সেটাই ভুল হোল আমাদের।
আসলে মিনিট পাঁচেক ধরে সুস্বাদু মোমোর স্বাদ নিতে নিতে যখন প্লেটটা ফাঁকা হয়ে গেল, তখন মনে হোল আর একটা করে প্লেট চাই। ততক্ষণে কাউন্তারে মোমো শেষ। ওরা গোনাগুন্তি বানায়, আর রোজের খাবার শেষ করে দেয়। এতোটাই টেস্টই হয়, চাহিদা ভরপেট। চালের মত কিছু একটা জিনিষ দিয়ে বানানো হয় ওগুলো, তাই বেশ নরম লাগছিল।
অগত্যা নুডলস নিলাম, ওটা তখনও ছিল। উহু, তেমন স্বাদ লাগেনি। সোয়া আর চিলি সস দিয়ে তৈরি, উহু। তবে মাস্ট ট্রাই ওখানের মোমো। মানে সত্যি বলতে, পুজা দাও না দাও, ওপরে সক্কাল সক্কাল উঠে ব্রেকফাস্ট করে চলেই আসতে পারেন। প্লেট পিছু দাম একেবারেই সাধ্যের মধ্যে, যতটা মনে পড়ছে।
পাইন গাছের সামনে দিয়ে নামার সময় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে শেষমেশ ঠিক করলাম, গ্লিনারিস ট্যুর করে আসি। ( না করলেই ভালো হতো, পরে বুঝলাম )
কি খাবো কি খাবো এমন ভাব করতে করতে মনে হোল ছোট্ট করে লাঞ্ছ সেরে নেওয়া যাক। ওপরে উঠে অর্ডার দিলাম, চিকেন সিজলার।
প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষার পর অর্ডার নিতে এসে, মিনিট কুড়ি আরও নিয়ে তারপর জিনিষটা এলো। রংটা একেবারে পাতলা সস দিয়ে বানানো, এখনও চোখের সামনে ভাসছে। জু জু জু করে শব্দ করে করতে চলে এলো ঠিকই, কিন্তু আমার মনে কেমন একটা কু গাইল। মনে হোল, ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের নয়।
মাংস একেবারেই শক্ত, বলা ভালো বুড়ো মুরগী। পাহাড়ি টেস্ট তো পরের কথা, এই ডিসের একটা সুন্দর সেন্ট থাকে বলে জানতাম। চিকেন পিস গুলো লোভনীয় খেতে লাগতো। এখানে একটা কামড় দেওয়ার পর মনে হোল, টাকাটা জলে গেল। কেমন বাসী ফ্লেভার, টেনে টেনে ছিবড়ে বার হয়ে গেছে। পাউরুটি ছিল, বাসী বলবো না, কিন্তু টাটকা তো একেবারেই নয়। কোন রকমে সস সহযোগে খাবারটা জাস্ট গলার নিচে নামালাম। আগামী কিছু দিন হয়তো চিকেন এর প্রতি নেশাটা উড়ে গেল।
পেট ভরেনি, এটুকু বুঝে গিয়েছি। অনেকেই গ্লিনারিস নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে, আমি তাদের বলবো, আমি সেটাই বললাম যেটা আমার সাথে ঘটেছে। এতে তর্কের কিছুই নেই। কিন্তু আমি এর পরে এলে আর যাইহোক, এখানে ওপরে আসবো না। তবে নিচে বেকারি, পেস্ট্রি ট্রাই আবারও করবো। মোহ কেটে গেল আর কি। কেউই যদি বলে, আমি তাহলে কেভেন্তার কে এগিয়ে রাখবো টেস্ট এর দিক থেকে। আর গ্লিনারিস এ গেলে বেকারির খাবার ট্রাই করাই শ্রেয়। আমি নিচে নেমে একটা পেস্ট্রি খেয়েছি। দাম একটু বেশি হতে পারে, কিন্তু যেটা খেলাম মুখে লেগে গিয়েছিল।
আজ দোলপূর্ণিমা। ম্যালে একটা অনুষ্ঠান চলছিলো সকাল থেকে। কোন একজন এর চিকিৎসার জন্য ডোনেশন এর একটা অনুষ্ঠান। নাচ, গান সবটাই চলছে ওখানে। শেষের আধঘণ্টা আমরা উপস্থিত ছিলাম। বেশ ভালো লাগছিল।
দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে এলো। ম্যালে থাকতে থাকতে কোথায় যে সময় কেটে গেল, বুঝতে পারলাম না। চা কফি খেতে খেতে দুজনে আবার এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করলাম। সন্ধের দিকে মার্কেট ভিজিট হোল। কিছু কেনাকাটা হোল, পকেট খালি যতক্ষণ না হয়, সবটাই চলতে থাকলো। আসলে আগামীকাল যে চলে যাবো, এটা মন খারাপের ডোজ, আর কি।
আজকের রাত একটু নস্টালজিক রাত। মন খারাপ একটু হচ্ছে অবশ্য। কিন্তু সব কিছুর তো একটা শেষ আছে, তাই না ?
ম্যালের একদম পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট এ উঠলাম, ফিয়েস্তা।
লাইভ গান করছে রেস্টুরেন্ট এর স্টাফ। ক্যারাওকে চালিয়ে, গলা মিলিয়ে। চিকেন থুপ্পা, ফিশ ফিঙ্গার নিলাম।
আজকের রাত শেষ রাত।
অন্তিম ঘড়ি উপস্থিত। কুছ পরোয়া নেহি, কারন কাল আমরা রউনা দেবো লামাহাত্তা এর দিকে, যেটা এই ত্রিপের সেরা স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে...
( ক্রমশ )
©সমীরণসামন্ত
#mahakaalmandir #mahakalmandir #mahakaltemple #nightatDarjeeling #glenary's
Comments
Post a Comment