#দার্জিলিং #লামাহাত্তা #তিনচুলে
দার্জিলিং
জমজমাট
পর্ব – ৬
©সমীরণসামন্ত
আজ ঘরে
ফেরার গান। রাত্রি গুলো বেশ ভালই কাটল দার্জিলিঙে, দিনের বেলা খাওয়া রাতে শুধু হইহই, অনেক দিন পর মুক্ত আকাশে খোলা পথে উড়ে বেরিয়েছি দুজনে। আবার কাজে ফিরতে
হবে, সেই পুরনো রুটিনে। খাঁচা বন্দী জীবন সঙ্গে মোহহীন দৌড়।
সকাল পৌনে
আটটায় হোটেল ছাড়লাম, সঙ্গে একরাশ ভালোলাগা ওই রুমের মধ্যেই আটকে রেখে।
ম্যালটা ওই
সকালে বেশ ফাঁকা, নাকি আমরা ফিরতি পথে বলে মন খারাপ করছে, তা জানিনা।
পথ পেরিয়ে ভানু ভবন এর কাছে দাড়িয়ে ছিল আমাদের ছোট্ট গাড়ি। বিকেলের দিকে আমাদের
বাস রয়েছে শিলিগুড়ি থেকে ( রিভিউ পরে আসবে এটা নিয়ে ), তাহলে
এতো সক্কাল সক্কাল কোন দুঃখে দার্জিলিং ছাড়ছি।
উহু, দুঃখ নয়, সুখে। শেষ
পাতে চাটনি পড়বে, যার স্বাদ এই কদিনের আনন্দ কে ছাপিয়ে যেতে
চলেছে।
গন্তব্যের
নাম, লামাহাত্তা ও
তিনচুলে ( বাকি জায়গা যাবো না স্থির করেছিলাম, সময়ের জন্যে )।
এতো সক্কাল
সক্কাল ওখানে জনপ্রাণী বলতে আমরাই। বেশ ফাঁকা আর বেশ নিশুতি। রোদ একটু আগে পর্যন্ত
ছিল, এখানে আকাশ
একেবারেই অন্য। পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘরূপী কুয়াশার চাদর, এক
অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। ঠিক একটা মোহ লাগা ব্যাপার। পুরোটাই সবুজ, পুরোটাই সতেজ। দেখেও আরাম। চোখে অদ্ভুত এক প্রকার আরাম অনুভূত হছে। ঠিক কি
দেখেছি, বলে বোঝাতে পারবো না।
কোথাও আমার
হারিয়ে যাওয়ার মানা নেই, তাই এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতে বড়ই সাধ জাগল।
ঘন পাইন
গাছে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটির নাম লামাহাত্তা। দার্জিলিং থেকে ২৩ কিমি দূরে এই জায়গাটি
পর্যটকদের বিশেষ পছন্দের জায়গা। লামাহাত্তা এই শব্দটিকে ভাঙলে পাই, লামা অর্থাৎ বৌদ্ধ মঙ্ক এবং হাটটা অর্থাৎ থাকার জায়গা, এক কথায় মঙ্কদের থাকার জায়গা এই লামাহাত্তা।
একটা
মিনিমাম এন্ট্রি ফি লাগবে ইকোপার্কটিতে প্রবেশ করার জন্যে। যারা ভিড় এড়িয়ে একটু
সাইলেন্স এর খোঁজে ঘুরতে চান, অথবা পাইনবনের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে চান, যারা শুধু
মাত্র প্রকৃতি কে উপভোগ করতে চান ব্যাক্তিগত ভাবে নিজের সাথে, একাকিত্তে হারিয়ে যেতে চান, অবশ্যই স্বাগত জানায় এই
লামাহাত্তা।
রাস্তার
ধারে এই বড় আউটডোর গার্ডেনে দেখতে পাবেন বিভিন্ন ধরনের এক্সটিক অর্কিড। ভিউ উপভোগ
করার জন্যে ওয়াচ টাওয়ার এমনই একটি জায়গায় রাখা হয়েছে, যেখান থেকে মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিকিমের পাহাড় , তিস্তা নদীর ভিউ পেতে পারেন।
এখানে এসে
আরও একটি দেখার বা উপভোগ করার জায়গা রয়েছে, যেটা কিছুটা ট্রেকিং পথে যেতে হয়, ওপরে।
এটাই আসল আকর্ষণের জায়গা আমার মতে। ‘জোড় পোখরি’ নামের পুকুর রয়েছে ওই ওপরে। এই নামের মানে জোড়া পুকুর। দারুন একটা ব্যাপার
চোখে পড়ার মত। হাটাপথটা বেশ দারুন। সবুজ ছাড়িয়ে যেখানে মাটি দেখতে পাওয়া যায়,
মাটির সাথে মিশ্রিত অভ্রের মত কিছু চকচক করতে দেখেছি। যত ওপরে উঠছি,
ততই আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে। নিস্তব্ধতা আরই বেশি, সঙ্গে ঠাণ্ডা কনকনানি। অন্ধকারাছন্ন পরিবেশ পুরো ব্যাপারটা কে যেন অন্য এক
পৃথিবীর খোঁজ দেয়। হাটা পথে ঘাম হয়, তেষ্টা পায়। তাই যারা এই
পথে যাবে, ব্যাগে যেন অন্তত পক্ষে জলটা রাখে। যারা হাটতে
তেমন পারেন না, খাড়াই পাথুরে রাস্তা চড়ার অভ্যাস নেই,
তাদের সেখানে যেতে একটু সমস্যা হতে পারে।
ওপরের জগতটা
সম্পূর্ণ আলাদা। এ এক অন্য জায়গা, অন্য পৃথিবী।
চোখের সামনে হাতের নাগালে দাড়িয়ে সব লম্বা লম্বা পাইন গাছ। ওপরের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাছে কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে আসছে ভেসে ভেসে। এতোটা সামনে থেকে এমন ভাসা সাদা তুলো, শেষবার মেঘালয়ে দেখতে পেয়েছিলাম।
প্রকৃতি দাড়িয়ে আছে আমাদের সামনে, খাড়াই হয়ে। আমরা শিশুর মত ছবি তুলছি, উনি আজ্ঞা দিয়েছেন বলে। এই যদি পাইন বন গুলো হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠে হাটতে শুরু করে, তাহলে আমরা যাবো কোথায় ? অথবা ভেতর থেকে কোন অজানা প্রাণী যদি দেখে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে ?
এই অনুভূতি
টা ভোলার নয়। মনে মনে অজানা আশঙ্কা হচ্ছে, আবার আরও কাছে যেতেই ইছে করছে। যেহেতু এই মুহূর্তে তেমন কেউই
ওখানে পৌছাতে পারেনি, আমরাই একা, আমরাই
রাজা, নিজের রাজত্তে।
বেশ অনেকটা সময় আমরা ওপরেই কাটিয়েছিলাম। সব্বার উদ্দেশ্যে বলে রাখি, এখানে এলে হাতে ঘণ্টা দুই নিয়ে আসা ভালো, মিনিমাম। আর যদি সক্কাল সক্কাল আসা যায়, তাহলে তো কথাই নেই। আপনারাও নিজের রাজত্তে রাজা হতে পারেন।
সারা বছর
ধরেই এই ইকো-ভিলেজে টুরিস্ট এর আনা গোনা রয়েছে। তবে লামাহাত্তায় আসার বেস্ট সময়
বছরে দুইবার, মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। এই সময়ে আবহাওয়া থাকে ভাল,
আকাশ থাকে পরিস্কার। যার ফলে আপনি পাশাপাশি পাহাড়ি ভিউ দেখতে পাবেন।
একটি রিমোট
ভিলেজ হওয়ার ফলে এখানে কোন হোটেল বা লজ পাবেন না। হ্যাঁ তবে স্থানীয়রা হোমস্তে
চালু করেছে অনেক আগে থেকেই, চাইলে সেখানে থাকা যেতে পারে।
হাঁটাহাঁটি করতে করতে খিদে কিন্তু বেশ পেয়ে গিয়েছে। রাস্তায় একটা দারুন খাবারের দোকান পেলাম। খাওয়ার জায়গার নাম ইওমো। স্থানীয় মোমো খেলাম যার স্বাদের কোন তুলনা নেই। সঙ্গে স্যুপটা অবশ্য বেশ পাতলা।
এখান থেকে ৬ কিমি দূরে আরও একটি জায়গা, তিনচুলে। নামটা ভাঙলে পাই, তিনটি চুল্লি বা ওভেন। গ্রামবাসীদের কাছে এই নামের একটা ব্যাখ্যা মেলে। পুরো গ্রামকে তিনটি বড় বড় পাহাড় ঘিরে রেখেছে। দূর থেকে যাকে দেখলে একটা ওভেন এর মতই মনে হবে। জায়গাটি ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।
আমরা এসে একটা চা বাগানের কাছে গিয়েছিলাম। বেশ সুন্দর একটা প্রাকৃতিক জায়গা। দারুন হাওয়া দিচ্ছে। দূর থেকে এক ধরনের ঢালু জমির ভিউ, অপূর্ব। যেখান থেকে বেশ সুন্দর ভিউ দেখা যায়।
অনেকটা সময় কাটানোর পর এবার ফিরতে হবে। মন ভার আর হয়নি। ফুরফুরে আনন্দে ক্লান্তি নিয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছিলাম গাড়িতে। এবার ফিরছি, আপাতত গন্তব্য শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড।
কেমন লাগলো আমাদের দার্জিলিং সফর ? পরপর না হলেও চেষ্টা করেছি সিরিজ করে ব্যাপারটা আপনাদের সামনে তুলে ধরার। এতদিন যারা যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
লাস্ট আর একটা পর্ব রাখছি, যেখানে বাসের অভিজ্ঞতা আর একটি ভালো প্রাইভেট কারের সন্ধান দেবো।
আজ আপাতত এটুকুই। এরপর আবার কোথাও ঘুরতে যদি যাই, দেখা হবে এখানেই, এভাবেই…
( ক্রমশ )
©সমীরণসামন্ত
Comments
Post a Comment