#দার্জিলিং #ম্যালরোড #এনজেপি
দার্জিলিং জমজমাট
পর্ব – ২
©সমীরণসামন্ত
ষ্টেশনের নাম এন জে পি।
ঘড়িতে প্রায় ১টা ৩৬। লাগেজ পত্তর নিয়ে বন্দেভারত কে টাটা জানিয়ে রেলষ্টেশনের ফ্লাইওভার ধরলাম। হাতে একটা বড় ট্রলি, আর ওর পিঠে লাল ব্যাগ। গাড়ী যেহেতু শেয়ারিং এ নেবো, তাই আগে থেকে প্রস্তুত হলাম, ভেতরে ভেতরে।
ওখান থেকে টোটো করে শিলিগুড়ি গেলেও গাড়ী পাওয়া যায়, রেট একটু কম পরে সেক্ষেত্রে। কিন্তু আর নড়তে চড়তে ইছে করছিল না। ভনভন করে মাছির মত ঘুরতে থাকলাম, গাড়ী খোঁজার চক্করে।
ষ্টেশন থেকে বাইরে এসেছি মাত্র, ডানদিকে একটা রেলের বগি হলুদ রং করে সাজিয়ে রাখা, পরিত্যাক্ত। ঠিক তারপরেই ছেকে ধরল ড্রাইভার দাদা ভাই রা। পরে অবশ্য বুঝলাম এদের মধ্যে বেশীরভাগই দালালের মত, গাড়ী ঠিক করেই চাপিয়ে ছেড়ে দেবে, মাঝে কমিশন বুঝে নেবে। কেউ বলল, প্রাইভেট কার করে নিতে, এখন নাকি আর শেয়ারিং কার পাওয়া যাবে না ( কাস্টমার পাওয়ার জন্য একটু মিথ্যে বলতে হয় )। ৩০০০ টাকায় ফুল গাড়ী বুকিং। ওরে সাব্বাস, দার্জিলিং যাওয়ার আগেই তো পকেট ফাঁকা হয়ে যাবে রে।
ওদের কাছে একটা ডিল তো ক্লাস লেগেছিল। দুইজনের নেবে ২০০ করে ৪০০, একেবারেই সস্তা। কিন্তু তার একটা কন্ডিশন আছে। দার্জিলিং এর ঘোরার প্যাকেজে আমাদের ঢুকতে হবে। অর্থাৎ ওখানে ওরাই গাড়ী দেবে ঘোরার জন্য। ( এদিকে আমরা গেছি শুধু মাত্র হাওয়া বদল করতে, তেমন দৌড়াদৌড়ি করে ঘোরার জন্য নয় ) এরই মধ্যে একজন আবার আমাকে বোঝাতে শুরু করে দিল, দার্জিলিং এ গিয়ে শুধু ঘরে বসে থাকবেন কেন, এদিকে ওই সেদিকে ওই এগুলো…। আরে ধুর মশাই, ঝেড়ে দিলাম একজন কে, “ আপনি চুপ করে ওখানে দাড়িয়ে থাকেন ভায়া, আমি জানি কি করবো, আপনাকে বোঝাতে হবে না। “ মুখ করার কোন ইছে ছিল না, কিন্তু এমন ভাবে সব্বাই পিছু নিয়েছিল, একটা ধমক যথেষ্ট ছিল সব্বার জন্য।
লাগেজ নিয়ে শেয়ারিং কারের স্পটের দিকে গেলাম। পেয়েও গেলাম, তবে রেট একটু বেশি অন্য দিনের থেকে, হোলি সিজন আসছে। ৪০০ টাকা করে মাথা পিছু। সেখানেও বিপত্তি। গাড়ী ছাড়ে আর না, লোকজন ফুল হলে তবেই ছাড়বে। এদিকে একজন দম্পত্তি পিছনে নিজের মেয়ে কে ফুল সীট বুক করে বসে রয়েছেন। তাতেও এনাদের শখ মিটছে না। আরও লোক চাই। অবশ্য সেটা স্বাভাবিক, এটাই তো ওদের রোজের কাজ। আমরা এলাম একদিনের জন্যে, ওরা যে রোজ এখানেই করে খায়। যাকগে, মিনিট কুড়ি কেটে গেল। বিরক্তি একটু লাগছিল। তার পর একটা ফন্দি আঁটলাম।
পিছনের দাদার সাথে কথা বলে আমরাও লোক দেখানো বেড়িয়ে পড়লাম গাড়ির জন্যে। চাপে পড়ে গেল ওরা। ওষুধে কাজ হোল অবশ্য। অন্য একটা ভালো গাড়িতে শিফট করিয়ে দিল। দুটো বেজে এগারো, দার্জিলিং দিকে গাড়ি রওনা দিল ।
“দার্জিলিং” নামের উৎপত্তি, তিব্বতি শব্দ ‘দোরজে’ ও ‘লিং’, এই দুটি শব্দ থেকে। শহরটি পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার জন্যে বিশেষ খ্যাত, এছাড়াও চা শিল্প তো রয়েছেই। যখন তখন এখানে চলে আসা গেলেও দার্জিলিঙে আসার জন্যে বছরের দুটো সময় বেশি উপযোগী। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর এবং এপ্রিল থেকে মে।
এখন তো মার্চ মাস, দোলের ছুটি। বলতে গেলে অফ সিজনেই গিয়েছি। এছাড়া যে ছুটি পাওয়া যায় না, আগের পোষ্টেই বলেছিলাম।
রোহিণী রোড ধরেছিল আমাদের গাড়ী। এই রোডটা একটু নতুন, কারশিয়াং এর সাথে শিলিগুড়ি কে কানেক্ট করেছে। দার্জিলিং এখান থেকে ৬৬ কিমি দূরে প্রায়।
গাড়ী আস্তে আস্তে ওপরে উঠছে। এই বাক সেই বাক করতে করতে কখন আমরা সবুজ চা বাগান ছাড়িয়ে পাহাড় দেখতে শুরু করে দিলাম বুঝতে পারিনি। দূর থেকে কি সুন্দর লাগছে। ধাপে ধাপে কত ঘরবাড়ি ওপরে রয়েছে, আর তার সামনেটা মুঠো খানেক মেঘ। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ী চলার পর সেই জায়গা গুলো নিচুতে নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ আমরা ওপরে উঠছি, ক্রমশ। ওপর থেকে সাপের মত এদিক ওদিক চলে যাওয়া রাস্তা। একটু আগেই ওইখানেই ছিলাম আমরা।
সাংঘাতিক বাক রাস্তায়। আশ্চর্যের বিষয়, ড্রাইভার ভাই রা একে অপরের সাথে বেশ ওয়াকিবহাল। নিমিত্ত মাত্র হর্ন বাজিয়ে একে অপরকে পাস করে চলেছে ( বছর দশেক আগে গ্যাংটক গিয়েছিলাম, সেখানের এই রাস্তার অভিজ্ঞতা এর থেকেও আরও বেশি সাংঘাতিক। যেহেতু অনেক দিন পর এই সব রাস্তায় এলাম, তাই অল্পতেই দারুন চার্ম অনুভূতি হয়েছিল )।
ডান কখনও বাম, রাস্তার দিকে তাকালে ট্রেনের লাইন। একে অপরকে যখন তখন ক্রস করে চলেছে।
গাড়ির কাচ যেহেতু বন্ধ, তাই বুঝতে পারিনি আবহাওয়া ধীরে ধীরে শীতল থেকে শীতলতর হয়ে চলেছে। তবে ওপরে ওঠার ফলে কানে এক প্রকার লক হয়ে গিয়েছে, এটা ঠাহর করেছি অনেকটা সময় পরে। কারশিয়াং পেরিয়ে গেছি প্রায় এক ঘণ্টা আগেই। এখানের লোকজন, কাপড় পোশাক সবটাই বেশ আলাদা।
ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে। হোটেল থেকে ফোন করে জানতে চাইল আর কতক্ষণ আমাদের। ম্যাপ খুলে নেটওয়ার্ক একটু পেয়েছিলাম তখন, দেখলাম আধ ঘণ্টা প্রায়। তবে পাহাড়ি রাস্তা তো , উঠতে একটু সময় লাগবে।
৫টা বাজতে দশ। দার্জিলিং এর রেল ষ্টেশন টা ক্রস করলাম। তারপর একটা মোড় ক্রস করলাম, যার ডানদিক ধরলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এর রাস্তা বেড়িয়ে যায়। আর তার পাস দিয়ে চলে যায়, লামাহাটটা, তিনচুলে। ( আমাদের ফেরার পথের জার্নি তে দ্বিতীয় কিস্তি টাই রেখেছিলাম। )
গাড়ি ঘুরিয়ে দাঁড়ালো, ভানু ভবনের কাছে। সেখানেই শেষ, তারপরে গাড়ি ঢোকা আইনত দণ্ডনীয়। গাড়ির কাচ যখন খুলল, বুঝে গেলাম কোন ভ্রমে আমরা এতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম রে বাবা।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বাপ রে বাপ। কোন রকমে পয়সা মিটিয়ে একটা ভারী জিনিষ গায়ে চাপিয়ে দিলাম ওর। আমার ঠাণ্ডা লাগলেও বেশ মজা লাগছিল। ওহ, ফাইনালি দার্জিলিং তো এসে গেলাম।
লাগেজ নিয়ে ওপরে উঠলাম। ঠিক সামনেই ম্যাল। দেখেই মনটা নেচে উঠলো। সেই ফাঁকা জায়গা, কত পর্যটক রয়েছে, বসে দাড়িয়ে সময় কাটছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্য দুজনে থমকে দাড়িয়ে গেছিলাম। হ্যাঁ এখানেই আমরা থাকবো আগামী দুটো রাত্রি ( আজকের টা বাদ দিয়ে, ওটা ফাউ )।
ম্যালরোড, চক বাজার, নেহেরু রোড, জাকির হোসেন রোড এই চারটি রোডের সংযোগস্থল হোল ম্যাল রোড, অন্য ভাষায় ‘চৌরাস্তা’ নামে পরিচিত।
ঘোড়ার আস্তাবলের সামনে দিয়ে এগিয়ে চলেছি দুজনে, দুইদিকে মার্কেট। সেটা শেষ হলেই একটা ঢালু জমি নিচের দিকে, একটা ওপরে চলে যায়। আমদের গন্তব্য ওপরে, একদম শুরুতেই। স্থানের নাম ‘ম্যাগনলিয়া রেসিডেন্সি’। থাকার জায়গার রিভিউ পরে দেবো অন্য পোস্টে। এখন আপাতত রুমে চেক ইন করা প্রয়োজন। বড্ড বেশিক্ষণ থাকলে কাবু করে ফেলবে বাইরের ঠাণ্ডা।
কোন রকমে ফ্রেস হয়ে দুইজনে বেড়িয়ে পড়লাম ম্যাল রাস্তার উদ্দেশ্যে। কারন এখন ঘরে থাকা একেবারেই ভাললাগছে না।
ঘোড়ার আস্তাবল এর পাশে লাইন দিয়ে রয়েছে সমস্ত স্ট্রিটফুড। দার্জিলিং এলাম আর মোমো খাবো না, এটা আবার কি কথা। এক প্লেট নিয়ে ধোঁয়া সমেত গরম গরম মুখে। ওহ, লাজাবাব। কিছুটা এগিয়ে এগচাউ খেলাম অল্প করে। বড্ড তেল দিয়ে বানায় দেখলাম।
ম্যাল রোড ধরলাম মাঝের বসার জায়গা ক্রস করে। বেশ ভালই ভীর রয়েছে। রাতের ম্যালরোড এ হাঁটার মজা, কোলকাতার পার্কস্ট্রিট অঞ্চলে বড়দিনের হাটা থেকেও বেশি ভালো, কয়েক গুনে ভালো। এখানেও পাশে সমস্ত খাবারের দোকান। চিকেন বল, চিকেন লেগ, উইংগস, ড্রাই চিলি। বেশ রকমারি রংচং, খেলে কি হবে জানিনা। তাই একটু এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তারপরই প্রথম ট্রাই করলাম ‘শেফালি’। এ কেমন নাম ! আমি চমকে গেছিলাম। মোটা পুরের মত করে ময়দার কোটিন দেওয়া। তেলে ভেজে খেতে হয়। এখানেও দেখলাম তেল বেশ ভালই রয়েছে খাবারে। ভালো লেগেছে, তবে ভয় টাই বেশি। তেলের খাবারে তেলটা ভালো না হলে সারা ট্যুর নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, এই যা।
একটু নিচের দিকে হাটা লাগালাম। গ্লিনারিস এ বরাবরের মত আশা-র সামনে ( হোপ ) দাড়িয়ে সব্বাই ছবি তুলছে। আমিও তুলেছি, তবে অন্য সময়ে। কি যে এমন বিখ্যাত জানিনা। তবে এসেছি যখন চেখে যাবই, কিন্তু বিনা লাইনে। ( সে আশা পূরণ পরে হয়েছিল, কাহিনী তারও আসবে )। আর একটু এগিয়ে শেষ পথে একজন অ্যান্টির কাছে চা নিলাম লেবু দিয়ে। আর তার পাশেই কেভেনটার, যদিও বন্ধ। এখানেও দেখবো কি এমন যাদু আছে ( এটাও পরে পূরণ হয়েছিল )।
দেখতে দেখতে রাত্রি আটটা বেজে গিয়েছে। রাস্তা আস্তে আস্তে ফাঁক হতে থাকলো। রাস্তার পাশের বাজার মানে ম্যাল মার্কেট ক্লোজ হয়ে শুরু করেছে। যাওয়ার আগে দরদাম করা জিনিষ গুলো বিক্রি করার শেষ চেষ্টা সেই দিনের জন্যে।
আমাদের পেট মোটামুটি ভরাই ছিল। রাতে তেমন কিছু আর খেতে ইছে করেনি। কেক পেস্ট্রি নিয়ে রুমে ফিরে এলাম। আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। সেই ভোর বেলা থেকে বন্দেভারত জার্নি, তারপর এতক্ষণ সফর। টায়ার্ড একটু আছি। যদিও শীতের দেশে এসব কিছু মালুম হয়না।
রুমে ফ্রেস হয়ে বসার পর একটা আলাদা অনুভূতি ছুয়ে গেল চারিদিক দিয়ে।
কান এক প্রকার নিস্তব্ধতায় ভরে গিয়েছে। নিস্তব্ধতার শব্দ ঠিক কেমন হয় ?
সাইলেন্স, শূন্য। বায়ুশূন্য স্থান যেন। সমস্ত শব্দ থেমে গেলে কানে কি পরিমান আরাম হয় ? কি পরিমান শান্তি কান পেয়ে থাকে, বুঝেছিলাম রুমে বসে ( আমার গ্রামেও এটা হয়, কিন্তু মাঝে মধ্যে ঝি ঝি পোকা সেটা পণ্ড করে দেয়। এখানে সেটুকুও নেই )। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় লেপ চাদরের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করলাম।
কারন কাল থেকে দার্জিলিং ট্যুর শুরু করবো আমরা, সেটাও পায়ে হেঁটে... নিজেদের মত করে এক্সপ্লোর করতে করতে…
( ক্রমশ )
©সমীরণসামন্ত
Comments
Post a Comment