ঘুরতে যাওয়ার ভাবনাটা হঠাৎ এসেছিল তা নয়, আসলে কর্মক্ষেত্রে আমি দুর্গা পূজা ছাড়া এই আর একটা ছুটি পাই, যেটা দুইদিন নিজেকে নিজের মত করে থাকতে দেয়। গতবার দোল উৎসবে যাত্রা করেছিলাম, দিঘায়। ভালো মন্দ অভিজ্ঞতা মিশেছিল। তাই এবারে যাত্রাপথ পরিবর্তন করে স্থির করলাম, দার্জিলিং এর জন্যে।
আর সেক্ষেত্রে প্রথম নাম মাথায় এলো, ‘ বন্দেভারত ’ নামটা।
আজ তাহলে এই সফর টা নিয়ে একটু কথা বার্তা হোক।
#বন্দেভারত #দার্জিলিং
দার্জিলিং জমজমাট
পর্ব – ১
©সমীরণসামন্ত
রবিবার সকাল ৫.৫৫ তে ট্রেন টাইম। তার আগের রাত একেবারে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি বলা চলে। সমস্ত কাজ গুছিয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমোতে ঘুমোতে ১২ টা ক্রস করে গেছে। অ্যালার্ম ছিল সাড়ে তিনটের, ঘুম ভাঙল আধাঘণ্টা আগেই। শুরু হোল শেষ প্রস্তুতি।
ভোর চারটে কুড়ি। উবের থেকে গাড়ী বুকিং। ঠিক পাঁচটা পাঁচে হাওড়ার পুরনো রেলষ্টেশনে।
বন্দেভারত, ট্রেন নাম্বার – ২২৩০১। খুব সম্ভবত ১১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম এ দাড়িয়ে ছিল।
আমরা ঢোকার বেশ কিছুক্ষণ পর এলো গাড়ী। আর তারপরেই সে এক এলাহি ব্যাপার। ঠিক যেন বড় সাদা অ্যানাকন্দা সেলিব্রিটি সাপ এসেছে। সব্বাই হুমড়ি খেয়ে দেখছে তাকে। মুখের কাছে দাড়িয়ে ছবিছাবা, মেরে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, আমিও সেই পথের পথিক ছিলাম অবশ্য।
দূর থেকে মোটামুটি অনেক যাত্রিকেই দেখা যাছে মোটা কাঁচের এপার দিয়ে। নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে, কানে হেডফোন। অনেকেই ল্যাগেজ নিয়ে ওঠাতে, সেট করতে ব্যাস্ত। কেউই আবার গলি থেকে বেড়িয়ে টুক করে একটা সেলফি, নিজের শূন্য সীটের সাথে।
‘সি’ অ্যালফাবেট এর নম্বরের ওপর ভিত্তি করে সীট নম্বর, বগি তৈরি।
বেশ কিছুটা এগিয়ে আমরা উঠে পড়লাম। লাগেজ আমাদের বেশি ছিল না। রুক্স্যাক মত একটা ব্যাগ আর একটা জামবো সাইজের ট্রলি। ওটা ওঠাতে গিয়ে একটু বেগ পেতে হয়েছিল, কারন জিনিষটা ওজনে কম হলেও আয়তনে বেশ বড় ছিল। লক্ষ্য করলাম, বেশ আরামসে ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে গেল। অর্থাৎ, লাগেজ ঢোকানোর জন্য জায়গা খুব পরিকল্পিত এবং যথাযথ। কারন সচরাচর এমন সাইজের ট্রলি নিয়ে কেউই বের হয় না। সেখানে আমাদেরটা যখন মুশকিল আসান টপকে গেছে, বাকি তো সব নস্যি।
সকাল ৫.৫৫। ডট ওই সময়েই ছাড়ল গাড়ী।
হাওড়া ছাড়তে ছাড়তে যখন ষ্টেশনের কারসেড মিলিয়ে যেতে থাকলো, চোখে পড়ল প্রথম সূর্য। নিজের কিরনে ট্রেন টা কে সম্পূর্ণ ধুয়ে দিচ্ছে।
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল।
চলে এলো নিউজ পেপার, বাংলা হিন্দি ইংরেজি। নিজের মনমত পত্রিকা না পাওয়া গেলেও, সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি অবগত ছিলাম না। পেপার টা হাতে দেওয়া মাত্র, পেছনের পকেট এ হাত দিয়ে মানি ব্যাগ টাচ করতেই, আমার স্ত্রী বুঝে গেল আমি কি করতে চলেছি। সাথে সাথে সাবধান করে দিল, এটা কমপ্লিমেন্তারি। মনে মনে জিভ কেটে ফেললাম, এই যাত্রায় বেঁচে গেছি আর কি।
বেশ কিছুক্ষণ কাটল।
চলে এলো খালি কাপ, সঙ্গে গরম জল। চিনির ছোট্ট প্যাক, সঙ্গে টি ব্যাগ ও মিল্ক গুড়ো। নিজের মনমত বানিয়ে খেতে খেতে প্রকৃতি দেখছিলাম। এমন অভিজ্ঞতা বোধ করি এই প্রথম, কারন এর আগে রেডি জিনিষ পেতাম। নিজের মন মত করে বানানোর সুযোগ এই প্রথম।
ঠিক কিছুক্ষণ পরেই আবার খাবার দেওয়া শুরু হোল। প্রথম স্লটে এলো ভেজ আইটেম, যারা অর্ডার দিয়েছিল তাদের জন্যে। তারপর নন ভেজের পালা। ব্রেকফার্স্ট এতো সকালে অন্তত এইভাবে কবে করেছি, আমার মনে পড়ছে না।
ব্রাউন ব্রেড, জ্যাম, মাখন, ডিম এর ফ্রাই, সঙ্গে গাজর ও সবুজ মটর বয়েল করা। একটা ফ্রুটির মত পানীয় ছিল সঙ্গে।
কিছুক্ষণের জন্য মনে হোল, ট্রেন এ দার্জিলিং যেতে বসেছি নাকি খেতে এসেছি। একটার পর একটা চলেই আসছে। হ্যাঁ সত্যি তাই, একটা শেষ একটা শুরু।
টিটি মশাই বেশ খোশ মেজাজে। প্রতিটা স্থানে এসে চেকিং করছেন। কেও যদি নিজের নাম ঠিক করে না বলতে পারে, সেক্ষেত্রে আই ডি বার করে কনফার্ম করছেন।
এইসব চলছে, এদিকে বাইরের সিনারিও পরিবর্তন হচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে। সিমেন্ট এর ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন সবুজ রাস্তায় পাড়ি দিয়েছি আমরা। ভেতরে এ সি লক সিস্টেম, তাই সতেজ গন্ধটা আসছে না এই যা।
বোলপুর, মালদা, বারসই। এই তিনটে স্টপেজ দেবে। এর মধ্যে মালদা স্টপেজে একটু বেশিক্ষণের জন্য দাড়ায়, জল পরিবর্তন ইত্যাদি সব করা হয়। বাকি গুলোতে গড়ে এক থেকে দুই মিনিট। মোটামুটি ভাবে সব স্টেশনেই সঠিক সময়ে পৌঁছে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে সম্ভবত ফারাক্কা বাধ ক্রস করলাম, বেশ দারুন শুরুর দিকের দৃশ্য টা।
বেলা বারোটা বাজতে চলেছে। ঘড়ি কখন যে ঘুরে গেছে টের পায়নি। অবশ্য ঘড়ির থেকে অনেক বেশি দ্রুত ছিল ট্রেন। গড়ে ১১০ কিমি প্রতি ঘণ্টা ( মোবাইলের অ্যাপ তেমনই দেখাল )।
লাঞ্ছ এসে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও প্রথমে ভেজ। আর তার বেশ কিছুক্ষণ পর ননভেজ, একে বারে হাতে গরম।
ভাবা যায় না এমনটা। রানিং অবস্থায় এর আগেও আমরা ট্রেনে খাওয়া দাওয়া করেছি, কিন্তু এবারের ফিলিং টা বেশ অন্যরকম। যেন একটা প্রাইম কোয়ালিটি, সঙ্গে লাক্সারি ব্যাপার। স্যার ম্যাম বলে সম্বোধন, ভেতরের আনন্দ অনুভূতি আরই বাড়িয়ে তোলে।
সাদা লম্বা চালের ভাত এক বাটি, মুগ ডাল, চিকেন কারী, পরোটা, আচার। সঙ্গে দই রয়েছে। এবং শেষ পাতে আইসক্রিম। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেকেই মাছের ছোট্ট সাইজ নিয়ে কমপ্লেইন করেছিলেন। সেই সমাধান আমি দেখলাম এবং সেটা লাজাবাব। ফিস চপ ছিল নতুন মেনু হিসেবে। টেস্ট প্রত্যেকটা আইটেমের খুব ভাল। সব থেকে বড় কথা , জিনিষ গুলো টাটকা এবং গরম। ডাল টা বেশ ভালো লেগেছে। চিকেন রান্নার স্টাইলে একটু অবাঙ্গালি ফ্লেভার ঢুকেছে। তবে বোনলেস বলে সাত খুন মাফ।
খাওয়া শেষে হাত ধুতে গিয়ে আবিস্কার বাথরুমটা। খুবই পরিস্কার এবং যে কেউই ইউজ করার পরও একই রকম ক্লিন। বড় বাথরুম করার ক্ষেত্রে সাক্সান পাম্প খুব শক্তিশালী রাখা হয়েছে। আওয়াজ এতোটাই জবসদস্ত, প্লেনের ওয়াশরুমের সাথে তুলনা করা চলে।
১টা বেজে ৩২।
এন জি পি তে আমরা নামলাম।
আর তারপরই শুরু আমাদের দার্জিলিং ভ্রমণ...
YOUTUBE LINK - https://youtu.be/ymcthJH9Ebs
( ক্রমশ )
Comments
Post a Comment