জানা অজানা
পুরী
শেষ পর্ব
পুরী যাবো, অথচ কোনারকের মন্দির যাবো না, এটা ভাবা মানেই আমি মানুষের পর্যায়ে পড়ি না।
কিন্তু আজ বলবো, কোনারকের সে লুকনো সৌন্দর্যের কথা, যেটা অধিকাংশ
মানুষই মিস করে যান, বারবার প্রতিবার। আমি মোটামুটি নিশ্চিত,
অনেকেই রয়েছেন যারা বছরে একবার অন্তত পুরী প্ল্যানিং লিস্টে রাখেন।
তারাও পর্যন্ত এই ব্যাপারটা মিস করে থাকেন।
খুব সকালে বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা। আজকের গন্তব্য লিস্টে রয়েছে নন্দনকানন এবং কোনারক। নন্দনকানন নিয়ে বিশেষ কথা এখানে বলছি না। শুধু বলবো, আমরা যেই সময়ে গিয়েছিয়াল্ম অর্থাৎ দুর্গা পূজার শেষের দিকে, মেঘলা আকাশ থাকায় ওই জায়গাটি এতোটুকু ভাললাগেনি। দেখার মত তেমন কিছুই নেই বললেই চলে। ওই স্নেক এর জায়গাটা টুকটাক, একটু এদিকে গিয়ে পাখী। সাফারি এখন একটা প্যাকেজ করে দিয়েছে দেখলাম। আগে প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা করেই হতো। খারাপ লাগার বিষয় হল, ভেতরে কেও গাইড করার নেই যে টিকিট কোনটা কাটবো, কোনটা নয়।প্যাকেজ হিসেবেই টিকিট কেটে ফেলছে। আমি সাফারি নেবো কিনা, সেটা আমার ব্যাপার। কিন্তু এন্ট্রি লাইন করার পর ভেতরে একটাই লাইন, যেখানে খরচা হিসেবে সাফারি যোগ করেই পয়সা নিয়ে নেয়। এবার আপনি চড়ুন কি না চড়ুন আপনার ব্যাপার। সাফারি অভিজ্ঞতা ওদিকে খুব খারাপ। লাইনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে এক চোট মারপিট দেখলাম। ওখানের কমিটি থেকে লাইন দেখার ব্যাপারে কোন আলাদা গার্ড ছিল না, তাই নয়ছয় চলছিল আর কি।
থাক সেসব মন খারাপের কথা। বিকেল বিকেল বেড়িয়ে চললাম কোনারকের দিকে।
‘ কোনারক ‘ , সংস্কৃত ভাষায় ‘কোনা’ অর্থাৎ কর্নার, ‘ অর্ক ‘ অর্থাৎ সূর্য। এই জন্য এই মন্দিরের ওপর নাম, “সূর্যমন্দির” । অনেকেই আবার “অর্কক্ষেত্র” বলে থাকেন। কথিত আছে, গয়াসুর কে মারার পর ভগবান বিষ্ণু এখানে তাঁর "পদ্ম” কোনারক এই রাখেন, তাই এই জায়গার ওপর নাম “পদ্মক্ষেত্র“ ( শঙ্খ পুরীতে, চক্র ভুবনেশ্বরে, গোদা জাজপুরে )।
১৩তম সেঞ্চুরিতে রাজা প্রথম নরসিংহ ১২০০ জন মানুষ কে নিয়ে প্রায় ১২ বছর সময় নিয়ে ( ১২৪৩ – ১২৫৫ ) এই মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির টি একটি রথের আকারে বানানো, ২৪ টি চাকা, ৭ টি ঘোরা সহযোগে।
অনেকেই জানেন এই তথ্য গুলো। কিন্তু কেন ১২ বছর ? এতোটা সময়ের মধ্যে কি ঘটেছিল এখানে ?
গল্প শুনতে ইছে করছে না ?
কোনারকের তরফ থেকে সেই ইছে পূরণ হতে চলেছে আপনাদের।
স্বাগত জানাই নতুন কোনারকে।
আগে মন্দিরে ঢোকার রাস্তার দুই ধারে ক্রেতা বিক্রেতা অনেক বেশি দেখা যেত। এখন সেই রাস্তা অত্যন্ত পরিস্কার, এবং ভাবনার বাইরে। সুন্দর করে বাধানো, পাশে গাড়ী পারকিং এর জায়গা রয়েছে।
মন্দিরের ঢোকার পথেই পড়বে সেই জায়গা। ছোট্ট কিন্তু অপূর্ব মিউজিয়াম। শো চলছে একটি সময়ের বিরতির পর পর। এন্ট্রি ফি রয়েছে। পার্সোনাল হোম থিয়েটার এর জায়গা মত। অ্যানিমেশন এর মাধ্যমে মন্দিরের ইতিহাস, সংক্ষিপ্ত ভাবে বর্ণনা করবে। ওই স্থানে গিয়ে সময় কাটানো আমার মনে হয় বেশি উপভোগ্যের কারন।
এটা দেখে বেরোনোর পর আপনি ধুকবেন কোনারকের মন্দিরে। একটু আগে শুনে আসা গল্প, সেই মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। মন্দিরের পাথর কথা বলবে। আপনি যদি ইতিহাস প্রেমী হয়ে থাকেন, অথবা যদি পুরনো তত্তের ওপর ভালোবাসা কাজ করে, তাহলে এই অনুভূতি টা আপনাকে ভাবনার আলাদা এক জগতে নিয়ে যাবে, এটুকু আমি পুরো মাত্রায় নিশ্চিত।
মন্দির সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু আর বলবো না। কিন্তু এরপর আমি আসছি কোনারকের দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে, যেটা পুরী ভ্রমণ করার ওয়ান অফ দ্যা রিজন।
বরাবরি ওখানে একটি লাইট শো হয়। বর্ষাকাল বাদ দিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুবার করে এই শো অনুষ্ঠিত হয়। শো এর সময় সিজন অনুযায়ী পাল্টায়।
মন্দির মোটামুটি যখন বন্ধের সময় এসেছে, তখন বাইরে থেকে সব্বাই কে বার করে দেওয়া হয়। টোকেন অনুযায়ী আবার প্রবেশ করানো হয় এই শো দেখার জন্য। খোলা আকাশে, মাঠের মধ্যে মন্দিরের একপাশে বামদিকে বসার জায়গা করা হয়। টোকেন পায়ার সাথে সাথে দিয়ে দেওয়া হয় লোক্যাল ব্রডক্যাস্ত করা যায় একটি হেডফোন, যেটা প্রয়োজন অনুসারে আপনি নিজস্ব ভাষা পরিবর্তন করে নিতে পারবেন। শো চলাকালীন হেডফোন সহযোগে সেটা এঞ্জয় করতে হবে, কারন শব্দ বাইরে থেকে কোন ভাবে শোনা যাবে না, তার জন্য কোন রকম বক্স সিস্টেম নেই। আর যাওয়ার সময় ফেরত দিতে হবে, সেটা বলে না দিলেও চলে।
এবারে প্রশ্ন হল, এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলছি কেন এই কথা।
তার কারন, এটা শুধু শো নয়, একটা অসধারন অভিজ্ঞতা। এর মাধ্যমে আপনি পৌঁছে যাবেন মন্দির যে সময় শুরু হয়নি তারও আগে।
একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল পরিমাপ করে বসানো থাকে একটি বড় প্রোজেক্টর। ফোকাস আলো সম্পূর্ণ ভাবে পড়বে মন্দিরের গায়ে, মেপে মেপে, এক চুল এদিক ওদিক নয়। মন্দিরের ওপর ভেসে উঠবে এর গল্পগাঁথা। কৃষ্ণ স্বয়ং এই মন্দিরে থাকবেন। আলোর খেলা কাকে বলে, তার এক অন্যোন্য নিদর্শন এই লাইট শো। আলাদা ভাবে সম্ভবত লেজার এর মাধ্যমে দারুন কিছু জিনিষ এই শো এর মধ্যে আরও জীবন্ত করে তুলবে। দর্শকের অভিজ্ঞতা আরও একধাপ এগিয়ে যাবে, যেখানে দেখবে চোখের সামনে মন্দির টি ভেঙ্গে গেল, আর ঠিক তারপরই হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে তিলে তিলে মন্দিরটি তৈরি করছে। প্রপার শব্দের মাধ্যমে সেই অনুভূতি আমি আজও মনে রেখেছি। যেন মনে হল, আমিও সেই সময়ে আছি, চোখের সামেন সব ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস দেখছি। ছবিতে কতটা বোঝাতে পারছি জানি না, তবে যেটা দেখেছি, সেটা কখনোই ভুলতে পারবো না।
রাত্রিকালীন এই শো এর কথা অনেকে সঠিক ভাবে জানেনই না।
বলে রাখি, লাইনে দাড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে। অনলাইন কোন ব্যাপার নেই। আর ৭ টায় শো হলে, ৬ টায় লাইনে দাড়িয়ে পড়া ভালো, কারন সীট সংখ্যা লিমিটেড, ১৫০ এর মত।
রাতের দিকে আসবেন যখন, গাড়ি একদম বুক করেই যাবেন। কারন ফেরার আলাদা কোন অপশন নেই ওখান থেকে, অত রাত্রে।
‘ জানা অজানা পুরী ’ কেমন লাগলো ?
মতামত জানাবেন অবশ্যই। ভাল লাগলে সঙ্গে থাকবেন।
ধন্যবাদ।
#lightshow #konark #konarkLightShow #NightShowKonark #PuriTravelGuide #Puri
Comments
Post a Comment