জানা অজানা পুরী পর্ব ৩

 জানা অজানা পুরী

পর্ব ৩
লেখায়, সমীরণ সামন্ত



আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষ। পুরীতে এই সময়ের আগে পিছে যাওয়াটা বোকামি। কারন স্নানযাত্রা হওয়ার সাথে সাথেই পুরীর মন্দিরে দর্শনার্থীদের ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়কালে যদি পুরী ছাড়িয়ে ২৩ কিমি দূরে যাওয়া যায়, তাহলে দারুন কিছু দেখার সুযোগ থাকবে।
আমি আলারনাথ মন্দিরের কথা বলছি। এই সময়কালে পুরীর ভক্তদের বেশিরভাগ অংশই এখানে পরিলক্ষিত হয়। স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুও এখানে এসেছেন

আমরা খুব সক্কাল বেলাতেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। মন্দিরের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি। বেশ পরিস্কার জায়গা। মন্দিরের চারিপাশে দেওয়ালে বেশ কিছু বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের শুভ্রতা অন্যভাবে দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। সবসময় কোন পূজা অর্চনা হয়ে চলেছে। মিনিট কুড়ি পর বেড়িয়ে পড়লাম, আজকের মহা সফর চিলকা-র উদ্দেশ্যে।
তবে সেখানে যাওয়ার আগে কিছু কথা এই মন্দিরের সম্পর্কে।
অনেকেই আমার কথায় সহমত হবে না, তবে আমি যেটা বলবো, বলছি খুব ভেবে চিনতেই বলছি।



পুরী এলে এই মন্দিরটি যদি সম্ভব হয় এড়িয়ে যান, অথবা বুঝে শুনে আসুনমন্দিরের চারিদিকে শুধু ব্যাবসার ভাণ্ডার ( সব জায়গাতেই হয়, তবে এটা একটু আলাদা, একচেটিয়া, যার ওপর কথা বলতে গেলেও পিছিয়ে আসতে হবে )। জুতো রাখতে পয়সা দেওয়া ঠিক আছে, সামান্য পয়সার বিনিময়ে মোবাইল ওনারা রাখবেন, সেটাও ঠিক আছে কিন্তু সেখানে কোন লকার বে সেই ব্যাবস্থা নেই যে মোবাইল তা সেফ থাকবেখালি জায়গায় ফেলে রেখে দিছে। কেও নিয়ে নিলে ওদের ক্ষেত্রে “ না আপনি রেখে যাননি “ বলাটা এমন কিছু কঠিন নয়, যতই স্লিপ আপনার হাতে থাকুকআরও একটা ব্যাপার।
মোবাইল যদি রাখতে না চাই, তাহলেও একটা পন্থা আছে। ওদের ২০ টাকা মোবাইল পিছু দিলে ভেতরে যেতে দেবে ওটা নিয়ে, সঙ্গে ছবি তোলা ফ্রি। মানে সব নিয়ম টাকা এর জন্য বাতিল। ভেতরে একমাত্র যাদের কাছে হলুদ ওই স্লিপটি আছে, তারাই মোবাইল ব্যবহার করবে, বাকিদের ক্ষেত্রে ‘ মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারন ‘।




আরও কিছু কথা জানিয়ে রাখি।
ভেতরে যাওয়ার সময় দশ টাকার বেশ কয়েকটা নোট নিয়ে যেতে ভুললে মুশকিল। কারন কোথায় কখন কি দরকারে দিতে হবে, বোঝার আগেই জোর করে টাকা চাওয়া হবে। সেই সময়ে টাকা ভর্তি মানিব্যাগ যদি খোলা হয়, চিচিং ফাক। তার থেকে নোট গুলো থাক বুক পকেট এ। লাগলে একটা একটা বার করে দেওয়া যাবে।
গাড়ী নিয়ে গিয়েছিলাম তাই, জুতো মোবাইল সবই গাড়ির ভেতর রেখেছিলাম, একটা মোবাইল বাদে। ভেতরেও এমন সব আচরণে খুব খারাপ লাগছিল। সেটা আর ব্যাখা করলাম না। ভগবানের ভক্তিতে ভক্তরা ওখানে যায়। এমন আচরণ পেলে তারাও খুব অসন্তুষ্ট হয়।






চিলকা, ভারতের সবথেকে বড় ও বেশি মিষ্টি জলের হ্রদ। পুরী , খুরদা ও গঞ্জাম এই তিন জেলাকে নিয়ে চিলকা প্রায় ১১০০ বর্গ কিমি জুড়ে অবস্থান করছে। শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখী প্রচুর আসে। এই হ্রদে ঘোরার জন্য রয়েছে তিনটি পয়েন্ট, সাতাপাডা, রম্ভা, বরকুল। আমরা গিয়েছিলাম সাতাপাডা তে, পুরী থেকে ৫০ কিমি দূরে, যেখানে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়।





রম্ভা তে গেলে ওখানে থেকে লঞ্চে লেকের বুকে জেগে থাকা বার্ডস
, হানিমুন, ব্রেকফাস্ট প্রভৃতি দ্বীপগুলি বেড়িয়ে নেওয়া যায়। ২২ কিলোমিটার দূরত্বে ভাল্লারি পাহাড়ে নারায়ণী মন্দির।
বরকুলে পান্থনিবাসের পিছনে জেটি থেকে লঞ্চ ছাড়ে নলবন বার্ড স্যাংচুয়ারি
, কালিজাই দ্বীপ যাওয়ার। কালিজাই দ্বীপ ১০ কিলোমিটার দূরত্বে। এখানে মন্দিরে উপাস্য দেবী কালিজাই বা মা কালী। শোনা যায়, রাজা মানসিংহ খুরদার রাজা ভগীরথের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে এখানে পুজো করেন ও যুদ্ধে জেতেন। বরকুল থেকে কাছেপিঠে ১৩ কিলোমিটার দূরে দক্ষপ্রজাপতি মন্দির, ১০ কিলোমিটার দূরে নারায়ণী মন্দির, ৩০ কিলোমিটার দূরে বারবারা অরণ্য প্রভৃতি বেড়িয়ে নেওয়া সম্ভব। বরকুল থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বাণপুর একসময় ছিল শৈলোদ্ভব রাজবংশের রাজধানী। এখানে ভগবতী মন্দিরটি দর্শনীয়।





যাইহোক, চিলকা যাবো অথচ বোটইং করবো না এটা হতে পারে না। ওড়িশা টুরিস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে বোট রয়েছে।
টিকিট কাউন্তারের সামনেটা বেশ ভীর। তবে কিছু জন মুখে গালাগাল করতে করতে ফিরে আসছে। কারণটা পরে বুঝেছি।
দুটো করে প্যাকেজ করা আছে। এর বাইরে কোন সিন সিনারি নেই। প্রাইভেট বুকিং করে সিঙ্গেল বোট নিতে হবে। দুই জন থাকুক কি চার জন। এর বেশি হয়ে গেলে আরও একটি বোট নিতে হবে।
মেজার সমস্যা হবে, বোটের ভাড়া দেখে। চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। ফুল ঘোরাঘুরি হলে সেটা ৫ হাজার এর ওপর খরচা পড়ছে, পুরো বোটেঘোরাবে মোটামুটি ঘণ্টা তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা, ডলফিনের জায়গা যুক্ত রয়েছে। আর তার নিচের প্যাকেজ হলে ৩ হাজার মত, সেক্ষেত্রে ডলফিন এর জায়গা বাদ পড়বে। পূজার সময় এমন রেট কিনা জানিনা। আমি যেটা শুনেছিলাম সেটা এই খরচের অনেকটাই কম ছিল। অগত্যা, ফুল প্যাকেজ নিয়েই উঠলাম আর কি।
বলে রাখা ভালো, বোট সারাক্ষণ জলেই থাকবে। তাই বোটইং এ ওঠার আগে জল আর শুকনো খাবার নিয়ে ওঠা ভালো।





পাঠক বন্ধুদের মনে একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরছে মনে হয়। উত্তর দিয়েই ফেলি।
হ্যা, ডলফিন সত্যি রয়েছে। ওখানের একটা রিজিয়নে একটাই ডলফিন দেখা গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে সেই এরিয়া তে দুটো বোট ছিল। দুটোই এই দৃশ্যের সাক্ষী কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই হঠাৎ দৃশ্যটি আমার বৌ এর চোখেই পড়েছে। মাঝিভাই রাও ব্যাপক এক্সপার্ট এই ব্যাপারে। ওরাও মোটামুটি ইশারা করে আমাদের বুঝিয়ে দেয় ওদের ওপর কিন্তু ভরসা করা যায় অবশ্যই। জলের ওপর পাতা অথবা ঢেউ এর কারসাজি দেখিয়ে ওরা পয়সা নেয় না। খুব চেষ্টা করে ভ্রমণ পিপাসুদের খিদে মেটানোর।
অনেকেই এটাকে গুল ভেবে বসবে, কিন্তু আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, হ্যা ডলফিন আছে।
সমস্যা হল, এতো গুলো বোট একসাথে সফরে বের হলে আওয়াজ যেমন আকাশে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনই জলের মধ্যেও তরঙ্গ আকারে বিস্তার করে। খুব স্বাভাবিক যে এই ভীরে ডলফিন ধারে কাছেও আসবে না। প্রকৃতি নিজের খেয়ালে সবসময় চলে।
বনে শিকার করতে বের হলেও চাইলেই হরিন যে সামনে আসবে তা নয়। সব কিছতে ধৈর্য আবশ্যক।
আমরা মানুষরা ইকো সিস্টেমটাকে যেভাবে নষ্ট করছি, তাতে সব কিছুই আসতে আসতে ধ্বংসের পথেই যাবে।
এমন অদ্ভুত কথা কেন বলছি ? বলবো না কেন ?
বোটিং করতে বলা হয়েছে আমাদের টুরিস্ট দের। তা না করে খাওয়ার খেয়ে প্ল্যাস্টিক, বোতল ফেলছি হ্রদে। মানে কোন পরিস্কার জায়গা কে পরিস্কার দেখলেই হাত চুলকায় মানুষের।





এছাড়া দারুন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বোট এ থাকাকালীন মেঘ জুড়ে বৃষ্টি, মুষলধারে। নৌকো তখন জলের মাঝখানে। দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচিল যে কালো অন্ধকার ধেয়ে আসছে। সেই দৃশ্য অপূর্ব, তার থেকেও অপূর্ব অনুভূতি টা। ধীরে ধীরে কোন একটি পাড়ের দিকে যাওয়া হল। বেশ অনেকক্ষণ ধরে জলের ওপরে থেকেই বৃষ্টির মজা নিলাম আমরা। এটা কখনোই ভোলার নয়।
সেই সময়ে সব বোট যে যার মত সাইড হয়ে গিয়েছে পাড়ে কোন শব্দ নেই। শব্দ শুধু জল পড়ার। সামনে থেকে জলের ফোঁটা পড়া কানের অক্সিজেন এর মত কাজ দেয়। সঙ্গে মাঝি ভাই এর গল্প। চরমআর কি চাই।

এইসব করতে করতেই প্রায় আড়াইতে বেজে গিয়েছিল।
তারপর মাঝি ভাই আমাদের একটি দ্বীপে নিয়ে গেল। লাল কাঁকড়ার দ্বীপ বলল।
সেখানে একটি লোক পাড়ে থাকা নৌকো তে চড়ে চড়ে বালতির মধ্যে আটকে রাখা লাল কাঁকড়া দেখাছে

আর দেখাছে জীবন্ত ঝিনুক, যার ভেতরে রয়েছে মুক্তা। হ্যা একদম ঠিক। প্রথম দেখায় ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। ওগুলো আসলে কালচার করা মুক্ত। অর্থাৎ প্রসেসিং অনুযায়ী চাষ করা হয়ে থাকে। যার দাম বড় জোর ৮০ কি ১০০। সেটা দেখিয়ে সেই লোক আপনাকে কিন্তু লোভ দেখাতে পারে। সদ্য ঝিনুক থেকে বের হওয়া মুক্ত, আপনারও কেমন একটা আকর্ষণ তৈরি এমনিতেই হয়ে যাবে। মনে হয় কিনে ফেলি। হ্যা কিনতেই পারেন।
কিন্তু সেই লোক দর হাকবে ৩৫০ বা তারও বেশি
বাজেট কমাতে পারলে আপনি গেইনার, একটা স্মৃতি থাকবে।
 কায়দা আছে লোকটার। প্রথমে দুটো ঝিনুক ভাঙবে, কিছুই পাওয়া যাবে না। তারপর সিলেক্ট করা আরও একটা ভাঙবে, যেটার মধ্যে থাকবে মুক্ত, আগে থেকেই ওরা জানত। কারন ওরা চাষ করছে যখন, এটা জানা কোন নতুন ব্যাপার নয়। আরও একটা জিনিষ দেখালও, যেটা আমার ভাষায় মুনস্টোন




কোরাল পাথর ভেঙ্গে পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দেওয়া মাত্র যেভাবে চকমক করছে, যে কেও ওটা দেখে আকৃষ্ট হতে বাধ্য। নাগ নাগিনীর মাথায় যেন ওটা থাকলে ভালো মানাবে। মুক্ত দেখে পছন্দ না হলেও এই জিনিষটা দেখে পছন্দ হবেই হবে। কিনে ফেলার জন্য মন নেচে উঠবে। দাম টা শুনে হয়তো সেটা দমন হয়ে যাবে। তবে ওই যে বললাম, দর দাম করতে পারলে আপনি গেইনার। আমার কাজের জগতে এই জিনিষ গুলো নিয়েই অল্প বিস্তর কাজ করেছি। তাই একটু আইডিয়া রয়েছে এই ব্যাপারে।

এরপর আরও একটি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হল। এখানে শেষমেশ জল পাওয়া গেল
ভুল বললাম, শুধু জল না, অনেক টুকটাক খাওয়ার পাওয়া যাবে। দাম তা ভালই চড়া, যেটা খুব স্বাভাবিক। তবে আমরা একজন এর কাছ থেকে মুরিমাখা খেয়েছিলাম। ওই খিদের চোটে দারুন লাগছিল। এই দ্বীপের মোস্ট ইন্টারেস্টিং পার্ট হল, পেছনের দিকে একটু এগোলে পাওয়া যাবে সমুদ্র। স্থানীয় ভাষায় ক্লাসিক বিচ।
মিনিট খানেক হাঁটা। সুন্দরবন এর মত ফিলিং। ঠিক তারপর সমুদ্রের গর্জন
মন ভরিয়ে দেয়। পা ব্যাথা থাকলেও টানে টানে সেদিকে কিছুটা যাওয়ার পর মন জুড়িয়ে যাওয়ার মত দৃশ্য চোখে পড়ে। এই জায়গায় কেও থাকে না। সম্পূর্ণ ঘুরতে এসে ছবি তোলা ব্যাস। তবে মাস্ট ভিজিট এটা। কারন অনেকেই এই জায়গায় আসতেই ভুলে যায়। সে জন্যই এই জায়গা বেশ একাকী, লোকজনের আশা যাওয়া বেশ কম। ঠিক যেন ভার্জিন বিচ।

বিকেল পৌনে চারটে বাজতে চলল। ফিরতে হবে পুরী।



 

কিভাবে এখানে আসা যাবে -

সাতাপাডা পুরী থেকেই বেড়িয়ে নেওয়া যায়। সারাদিনের গাড়ী করতে হয়। খরচ ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
রম্ভায় পৌঁছতে হলে ট্রেনে বালুগাঁও বা রম্ভা আসতে হবে। রেল লাইন আর ন্যাশনাল হাইওয়ে দুই-ই চলেছে হ্রদের গা ঘেঁষে। রম্ভায় সব ট্রেন থামেনা। বালুগাঁও থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে রম্ভা। রম্ভা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বরকুলে অটো যাচ্ছে। বালুগাঁও স্টেশনে নেমেও বরকুলে আসা যায়। বালুগাঁও থেকে টাংগি হয়ে ৩৫ কিলোমিটার দূরে মংলাজোরি।

  

#পুরী #চিলকা #রম্ভা #ডলফিন #সাতাপাডা #চিলকাভ্রমণ #আলারনাথ
#সমীরণসামন্ত
 


YOUTUBE LINK = https://youtu.be/N5omyfbRb64


Comments