জানা অজানা পুরী - পর্ব ২

 জানা অজানা পুরী

পর্ব ২
লেখায়, সমীরণ সামন্ত


পুরীর দ্বিতীয় পর্বে সব্বাই কে স্বাগত জানাই। আজকেও থাকছে জানা অজানা পুরী নিয়ে আরও একটি পর্ব। ঘোরাঘুরি এবং তথ্য একত্রিত করে তৈরি এই কাহিনী, আশা রাখছি অনেক নতুন কিছু আপনাদের কাছে তুলে ধরতে পারবো।





পুরীর দ্বিতীয় দিন। স্নান পর্ব সকাল থেকেই চলেছে। সে সব বিস্তারিত দেওয়ার মত কিছুই নেই। কারন চারিদিকে শুধু জল ( সমুদ্র ), নুনে ভর্তি। মাঝে মধ্যে ৫০ টাকা, ডাবের জল। উঠে খেয়ে আবার সমুদ্রে , আর উকি মেরে দেখে নেওয়া ডাব কাকু জুতো টা ঠিক জায়গায় রেখেছে তো ?
বাজারে গিয়ে রান্না করিয়ে সেটা দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন। তারপর গাড়ী নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি।
গ্রামের নাম রঘুরাজপুর। অথবা বলতে পারেন, শিল্পীদের আঁতুড় ঘর ( আমার মতে )। নামটা অনেকের কাছেই এই মুহূর্তে পরিচিত। এটি একটি অতিহ্যবাহী শিল্পীদের গ্রাম। পট্টচিত্র যেখানে রয়েছে প্রায় প্রতিটা ঘরে। রয়েছে গটিপুয়া নাচ এর গুরুকুল। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নাচের আদি রূপ এই গটিপুয়া।
গ্রামটিতে রয়েছে মোটের ওপর খুব কম করে প্রায় ১৫০টি পরিবার। একে অপরের ওপর নির্ভর করে এই গ্রামবাসীরা জীবন কাটায়। ২০১৯ এর ফণী ঝড়ের ফল এই গ্রামে আজও খুব স্পষ্ট। যাদের মাটির বাড়ি ছিল, বেশিরভাগটাই নষ্ট আজ। অনেকটা কষ্টে চলতে চলতে আজ আবার মাথা তুলতে চেষ্টা করছে এই রঘুরাজপুর গ্রাম ও তার শিল্প।
বিখ্যাত ওডিসি নৃত্যশিল্পী কেলুচরণ মহাপাত্র এর জন্মস্থান এই গ্রাম।




পট্টচিত্র কথা -
রঘুরাজপুরের সাথে প্রভু জগন্নাথ এর কি সম্পর্ক।
আসলে ‘পট্টচিত্র’ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই রহস্যের সমাধান।
প্রতি বছর, রথ যাত্রার পনেরো দিন আগে, জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায় প্রভু জগন্নাথ এর শরীর খারাপ হয়। রীতি অনুযায়ী, সেই সময়ে মন্দির সহ কাঠের বিগ্রহ পরিস্কার করা হয় পবিত্র জল দ্বারা। সেই সময়ে প্রভুর মূর্তির পরিবর্তে ‘পট্টচিত্র’ কে পূজা করা হয়।
এই ‘পট্টচিত্র’ আসে রঘুরাজপুর গ্রাম থেকে। প্রথম এই প্রথা প্রচলিত হয় প্রায় ১০০০ বছর আগে।

পট্টচিত্র এর গোড়াপত্তন হয় রঘুরাজপুরে। নারকোল, আম, তাল গাছে ঘেরা এই গ্রাম। ২০০০ সালে এই গ্রাম কে ভারতের প্রথম হেরিটেজ ক্র্যাফট ভিলেজ শিরোপা দেওয়া হয়, Indian National Trust for Art and Cultural Heritage (INTACH) এর তরফ থেকে।



“ পট্ট “ মানে কাগজ, “ চিত্র “ মানে ছবি। মূলত চিত্রকর গোষ্ঠীর মানুষ, যাদের পদবী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহারানা, মহাপ্রতাপ হয়ে থাকে, এই কাজে যুক্ত। ডক্টর জগন্নাথ মহাপাত্র, ছিলেন একজন পট্টচিত্র শিল্পী। রঘুরাজ পুরে এই শিল্প কে বাঁচিয়ে রাখার পেছনের এই মানুষের অবদান রয়েছে যথেষ্ট। ‘পট্টচিত্র’ এর পট অর্থাৎ ক্যানভাসটি টি তৈরি করার কৌশল বছরের পর বছর একই ভাবে চলে আসছে।



তেঁতুল বিজের জল দিয়ে কটন এর কাপড় ভিজিয়ে শুকোতে হয়। তারপর আঠা, চক এর আস্তরন দেওয়া হয় ভালো করে। এই রকমই সাতটি শিট তৈরি করতে বেস সময় লাগে। তারপরে একত্রে ওই শিট গুলো একে অপরের সাথে বেশ কায়দা করে লাগিয়ে স্মুথ করা হয় এবং রং দেওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়।
যে রং ব্যাবহার হয় সমস্তটাই প্রকৃতি থেকে নেওয়া।
শাঁখের গুড়ো থেকে সাদা রং, পাতা থেকে সবুজ, রেড অক্সাইড অথবা লাল মাটি ( গেরু ) থেকে লাল রং।
আঠা কখনও ব্যবহার করা হয়, রং পার্মানেন্ট করার জন্য। এই আঠা তৈরি হয় নিম অথবা বেল গাছের থেকে।
বর্তমানে মাঝে মধ্যে কৃত্রিম রংও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।




পেইন্টিং এর থিম রাধা কৃষ্ণ থেকে শুরু করে কখনও জগন্নাথ, দশমহাবিদ্যা, রামায়ন, মহাভারত এর বিভিন্ন গল্প নিয়ে। তবে সময়ের সাথে সাথে থিম মাইথলজির আরও গভীরে যেতে শুরু করছে।

ফেলে দেওয়া জিনিষ, যেগুলো বেশিরভাগ ইকোফ্রেন্ডলি, সেই সব জিনিষ দিয়েও কাজ শুরু করেছে শিল্পীরা। লিকার বোতল, নারকেল এর খোলা, খবরের কাগজ, ফেলে দেওয়া কাগজ সবই এই কাজে দরকার হয়।
রঘুরাজপুরের সমস্ত শিল্পী খুব আন্তরিক। নিজের কাজ সেখানের পর্যটকদের দেখাতে কোন ভাবেই কার্পণ্য করেন না। বরং প্রতি বাড়িতে গিয়ে আপনি কাজ দেখতে গেলে আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা পাবেন।
গ্রামের পেছন থেকে ঢুকলে একজন শিল্পীর ঘর প্রথমেই পড়ে।



ঘরের পাশে বেশ একটা বড় বোর্ড বাধানো, মা দক্ষিণাকালি আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটস কালচার।
ঢোকার মুখেই দরজার পাশের সব দেওয়ালে দারুন সব পেইন্টিং। দেখলে এমনিতেই মন ভরে যাবে।
শিল্পীর নাম বিজয় কুমার বারিকি। ২০১১ তে ন্যাশনাল মেরিট অ্যাওয়ার্ড পান, ২০১৪ তে ইউনেস্কো থেকে। একটি ছবির জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান।
পট্টচিত্র থেকে শুরু করে র-সিল্কের ওপর কাজ, তালপাতার ওপর পেইন্টিং সমস্তটাই ওখানে দেখলাম।
মুগ্ধ হওয়ার মতই। এক একটা কাজ কতটা নিখুঁত হতে পারে, কতটা ধৈর্য নিয়ে সেই কাজ সম্পন্ন করতে হয়, না দেখলে , সামনে কাজ না দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। প্রতিটা কাজের সময়সীমা বিভিন্ন রকমের। কোনটা সাত দিন, কোনটা পাঁচ দিন আবার কোনটা পাঁচ সপ্তাহ বা তারও বেশি। তাই এই সব জিনিষের দামটাও বিভিন্ন।



সময়ের দিক থেকে বিচার করলে, যে পরিমান দাম ওনারা ধার্য করেন, সেটা খুব বেশি তা আমি বলবো না। সত্যি কথা বলতে, শিল্পের দাম এভাবে বিচার করা একেবারেই উচিৎ নয়। ওনাদের রাত দিনের পরিশ্রম, যে আন্তরিকতা দেখতে পাওয়া যায়, তাতে একটু হেল্প করাই যেতে পারে।
বিজয় কুমার বারিকি মহাশয়ের ঘরের কাজও বেশ চোখে পড়ার মত। কত ধরনের জিনিষ রয়েছে, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দেখে মনে হবে এটা কোন ঘর নয়, সংগ্রহশালা। ওনার বাবা মা ও একটা সময় এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, এখনও আছেন।
যেহেতু শুরুর দিন থেকেই মেঘলা, তাই সেদিনও তার বিরাম ছিল না। অনেকটা সময় কাটিয়ে গ্রামের পথে আমরা বেড়িয়ে পড়েছি। পায়ের নিচে জল, পায়ে পায়ে সরে যায়। ভালো লাগছে গ্রাম ঘুরে দেখতে। প্রতিটা ঘর পাশাপাশি লাগোয়া। নিজেদের ঘরের আইডেন্টিটি বোঝাতে নিজস্ব আঁকা দেখতে পাওয়া যায় দেওয়ালে। আর সেদিক ফিরে তাকালেই , দালানে বসে দেখতে পাওয়া যায় কোন এক শিল্পী কে, নিজের হাতে শিল্পীসত্তাকে ফুটিয়ে তুলছে। যদি হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যায়, একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা থাকবে আপনার জন্য। সেটা ফিরিয়ে দিতে আপনি হয়তো পারবেন না।




এমন ভাবেই আমরাও গিয়েছিলাম আরও দুই তিন জন শিল্পীর বাড়ি। ঘুরে দেখেছি কাজ। এই সব কাজের ত্রুটি বিচার করাটাই এতো মুস্কিল, আমি যেদিকেই তাকাই, শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শিল্পীর রাজ্যতে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য রাখতে পেরে ভেতর থেকে একটা দারুন ভালোলাগা কাজ করছিল।


গটিপুয়া নৃত্য ও কিছু কথা -

শিল্পী বিজয় কুমার বারিকি ঘরের লাগোয়া একটি ঘর রয়েছে। শুরুতেই সেখানের দেওয়ালেও বেশ দারুন রকমের চিত্র। তবে থিম টা আলাদা। নৃত্যের কিছু ভঙ্গি, সঙ্গে গুরুর সাথে কিছু প্রকারভেদ।
স্থানটি একটি গুরুকুল।
নাম, অভিন্ন সুন্দর গটিপুয়া নৃত্য পারিষদ।
ভুবনেশ্বরে নাচের অনেক অ্যাকাডেমি রয়েছে। কিন্তু আসল শিক্ষা কিভাবে হয়, কিভাবে গুরুর ঘরে থেকে সমস্ত কিছু আয়ত্ত করতে হয়, আঁতুড়ঘর তথা নাচের আখড়া কিভাবে ওদের কে ধীরে ধীরে নৃত্যশিল্পী বানিয়ে তোলে, এই সব পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে হলে, এখানে আসা অত্যন্ত ভাবে জরুরী। বিশেষত যাদের এই সবে বিষয়ে ভালোলাগা রয়েছে, তাদের তো অবশ্যই।




রঘুরাজপুরের এই গুরুকুল প্রতিষ্ঠা হয় অনেক দিন আগে হলেও রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয় ২০০৩ সালে।
গুরু লক্ষ্মণ মহারানা এর বয়স যখন ৩৫, তখন তিনি তাঁর বাবা, গুরু জগন্নাথ মহারানা এর কাছ থেকে এই স্থানের দায়িত্ব নেন। গুরু লক্ষ্মণ মহারানা পরবর্তী সময়ে এই গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন তাঁর ছেলে বসন্ত মহারানা কে, যখন তাঁর বয়স ১৮। এভাবেই বংশ পরম্পরায় এটা চলতে থাকে।
পরিচয় হল হাসি খুশি একজন মানুষের সাথে, গুরুকুল টি যার এই মুহূর্তে, বসন্ত কুমার মহারানা।
সত্যম সুন্দর মহারানা, সুভম সুন্দর মহারানা এরা গুরু বসন্ত মহারানা এর পরবর্তী তথা চতুর্থ জেনারেশন।
গুরুকুলের সমস্ত ছাত্রদের সবসময় একটা কথা শেখান হয়, কখনও মিথ্যা বলবে না, কখনও কারোর ক্ষতি করবে না, কখনও কারোর সম্পর্কে খারাপ ভাববে না। এই শিক্ষা পেয়েই ছাত্ররা আসতে আসতে নিজেদের মধ্যে শক্তির আধার খুঁজে পায়।
ওড়িয়া শব্দ ‘গটি’ অর্থাৎ একা বা সিঙ্গেল, ‘পুয়া‘ অর্থাৎ ছেলে। এককথায় একটি ছেলে।
বহুবছর ধরে এই নাচ চলে আসছে। যেখানে ছোট্ট ছেলেরা মেয়েদের জামা কাপড় পড়ে নৃত্যকলার মাধ্যমে প্রভু জগন্নাথ ও প্রভু কৃষ্ণ কে পূজিত করে আসেন।
কৈশোর থেকে যৌবনকাল আসার আগে পর্যন্ত ছেলেরা এই কলার সাথে যুক্ত থাকে।




নিজদের কে স্ত্রীলোকের মত দেখানোর জন্য ছেলেরা চুল কাটত না। চুলে ফুলের মালা এবং সঙ্গে লাল সাদা পাউডার মেকআপ একত্রে ব্যবহার করতো। কাজল কে চোখের বাইরে চওড়া করে পড়া, কপালে লাল টিপ, চন্দনের কলকা সাজ কপালের চারিদিকে, পায়ে আলতা, এ সমস্তই সজ্জার মধ্যে পড়ে। এছাড়াও গয়নার মধ্যে বাহুবন্ধ, ব্রেসলেট, নোস রিং, কানের এই সব। সমস্তই পবিত্র মনে করা হয়। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী একটি ড্রেস রয়েছে, “ কানচুলা “। একটি উজ্জ্বল রঙের ব্লাউজ সঙ্গে উজ্জ্বল কাপড়ের শাড়ি। কোমরে এমব্রয়দারী করা সিল্কের কাপড়, “নিবিবন্ধ” বলা হয়। আধুনিক যুগের প্রভাবে এই সাজ পোশাক আজ অনেক তাই পরিবর্তিত।
ইতিহাস ঘাটলে দুই ধরনের গল্প শোনা যায়, এই নৃত্যকলার জন্মের ব্যাপারে।
মুঘল সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই মেয়েদের বাইরে বের হওয়া প্রায় বন্ধের পথে। সেই সময়ের দেবদাসী প্রথা সেই জন্য বিলুপ্তির দিকে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পূজারী ঠিক করলেন, গরীব পরিবার থেকে ছোট্ট ছেলেদের আনা হবে যারা এক দিকে যেমন পূজার কাজেও থাকবেন তেমনই এই প্রথা কে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
অপর আরও একটি গল্প শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর।
পুরীর রথ যাত্রার সময় উনি চেয়েছিলেন একটি গানের উৎসব হোক প্রভুর মন্দিরে। নাকচ হয়ে যায় সেই প্রস্তাব। দেবদাসীরা ঋতুকালীন এই উৎসবে যোগ দিলে তাতে উৎসব পবিত্র হবে। তারপরই ডাকা হয় ছেলেদের।




আরও একটি গল্প শোনা যায় মহাপ্রভুর ব্যাপারে।
চৈতন্য মহাপ্রভু, একবার পুরী এসেছিলেন, জগন্নাথের চন্দন যাত্রার সময়ে। তখন প্রতাপ রুদ্র দেব এর সময়কাল চলছিল। সমস্ত ভক্তবৃন্দ তখন পূজা দেখতে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। মহাপ্রভু মূলত শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন। উনি দেখলেন ভক্তরা সেই সময়ে যে নৃত্য অথবা জ্ঞান প্রদর্শন করছেন, সেটা মুলত জগন্নাথের জন্যই। কোথাও ভগবান কৃষ্ণ কে উপলক্ষ করা হয়নি। এই ভাবনাই গটিপুয়ার জন্ম দেয়। মঙ্গলাচরণ, মোক্ষ নৃত্য সম্পূর্ণ ভাবে কৃষ্ণের এর জন্য সমর্পণ হয়।



৪ থেকে ৫ বছর যখন বয়স, ছেলেরা গুরুকুলে প্রবেশ করে।
বাড়ির লোক দুটি ব্যাপার খুব ভাল বুঝতেন। তাদের নিজেদের অবস্থা খুব কঠিন, খাওয়ার জোগাড় তারা রোজগার করতে অপারক। তাই এখানের থেকে গুরুকুলে গেলে তারা জীবনের শুরুটা ভালো পাবে। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে ‘গটিপুয়া‘ একমাত্র স্পেশাল মানুষদের জন্যই তৈরি, যারা কিনা ভগবানের সন্তান।

একটা সময় ছিল, যখন ওড়িশা তে মহিলা নৃত্যশিল্পী ছিলেন, “ দেবদাসী “ নামে। আরও একটি নাম আছে, “ মহরি “।
প্রভু জগন্নাথ এর সেবায় এনারা ছিলেন। এর প্রমান পুরীর কোনারকের মন্দিরে পাওয়া যায়। স্তম্ভের বেদিমূলের স্কাল্পচারই তাঁর প্রমান। ষোল শতকে এই প্রথার পরিবর্তন হতে শুরু করে। মেয়েদের পরিবর্তে ছেলেরা হাল ধরে, জগন্নাথের সেবা অর্পণের জন্য।
গতিপুয়া নৃত্য মহরিদের নৃত্যকলা থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল। বিশেষত এক্ষেত্রে নাচ করার সাথে সাথে গানটাও তাদের মুখ থেকেই করতে হতো।



একজন গটিপুয়া নৃত্য শিল্পী হতে গেলে কিছু গুন থাকা আবশ্যক। গুরু বসন্ত কুমার মহারানা এর কথা অনুযায়ী, ছেলেটির ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন সুন্দর হতে হবে, মুখে থাকতে হবে গুড লুকিং ফ্রেম ( ফটোজেনিক ফেস হিসেবে নয় ), বড় চুল এবং তাকে হতে হবে কুইক লার্নার।
এই নৃত্যে দক্ষ হতে গেলে চারটি গুন দরকার, এক কথায় ‘চতুঃ বিদ্যা’।
যথা – গান, ইন্সট্রুমেনট বাজানো, নাচ এবং সঙ্গে অভিনয়।
যেকোনো কলাশিল্পের মধ্যে এই গটিপুয়া কঠিন কলা হিসেবে ধরা হয়।
ঝুলন যাত্রা, চন্দন যাত্রা, দোল যাত্রা অথবা অন্য যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই নৃত্যকলা পুরীতে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়।
‘ গটিপুয়া ‘ পারফর্মেন্স কখনও দেখলে ওই ছোট্ট ছেলেদের চাইল্ডইস ব্যাপারটা দারুন উপভোগ্য। ঠিক ছোট্ট বেলায় রাধা কৃষ্ণ এর যেরকম লীলা ও গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, এই সময়ে দাড়িয়ে আপনি হয়তো সেটাই লাইভ দেখছেন।


আমরা সেই গুরুকুলে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় কাটিয়েছি।
পারফর্মেন্স কাকে বলে, গটিপুয়া আসলেই কি ধরনের নৃত্য, এই ছোট ছেলে গুলো আসলেই কি করতে পারে, এই গ্রামে আসার আগে পর্যন্ত আমাদের কাররই জানা ছিল না। অসম্ভব সুন্দর একটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম।
কোলকাতা ছাড়াও ভারতের অনেক জায়গায় ওনারা শো করে থাকেন। এই সংস্কৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই সব মানুষরা রয়েছেন।
একটি ঘরে তিনটি দেয়াল আলমারি, সমস্তই ভর্তি, পুরস্কারে, ন্যাশনাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল।




আরও একজন মানুষের সাথে পরিচয় হল, গুরুর গুরু, অর্থাৎ বসন্ত বাবুর বাবা, গুরু লক্ষণ মহারানা।
পরের বার এলে আমরা ওখানে একবেলা থেকে খাওয়া দাওয়া করে নৃত্য দেখে তারপর যাবো। এমনটাই গুরু লক্ষণ বাবু বললেন।
পুরো গ্রামটাই মোটামুটি ভাবে ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। যেহেতু সফরের শুরু থেকেই বৃষ্টি আমাদের সাথে ছিল, তাই পায়ের নিচে জল সরিয়ে আমরা আসতে আসতে গারামের গভীরে গেলাম।
খুব ভাল লাগছিল গ্রামটি ঘুরে দেখতে। প্রতিটা ঘর পাশাপাশি লাগোয়া। ঘরের বাইরের দেওয়ালাএ যে যার মতন আঁকা রয়েছে।
ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাওয়া যেতে পারে দালানা বসে থাকা শিল্পী তার নিজসস্য শিল্পী সত্ত্বা ফুটিয়ে তুলছে।
যদি হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে যায়, একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা থাকবে আপনার জন্য। সেটা ফিরিয়ে দিতে আপনি হয়তো পারবেন না।
এমন ভাবেই আমরাও গিয়েছিলাম আরও দুই তিন জন শিল্পীর বাড়ি। ঘুরে দেখেছি কাজ। এই সব কাজের ত্রুটি বিচার করাটাই এতো মুস্কিল, আমি যেদিকেই তাকাই, শুধু তাকিয়ে ছিলাম। শিল্পীর রাজ্যতে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য রাখতে পেরে ভেতর থেকে একটা দারুন ভালোলাগা কাজ করছিল।





এই সম্পর্কে আমার ভিডিও ইউটিউব এ রয়েছে, চাইলে ঘুরে আসতে পারেন।
LINK :  https://youtu.be/yKOjZHLt3mo

কিভাবে এই স্থানে আসবেন
পুরী থেকে প্রাইভেট কার বুক করে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে খরচা ১০০০ থেকে ১৩০০ এর মধ্যে পড়বে। অথবা অটো বুক করতে পারেন। খরচা মোটামুটি ৭০০ - ১০০০ এর এদিক ওদিক। বাকিটা সিজন বুঝে ওরা দাম রাখে।
চেষ্টা করবেন দুপুরের খাওয়া সেরে মোটামুটি ২ তোর মধ্যে এখানে আসার। হাতে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। আর যদি সক্কাল সক্কাল আসতে চান, সেটাও হবে, তবে ১১ টায়।

কেমন লাগল জানা অজানা পুরীর এই পর্ব ?
আপনাদের কোন কিছু জানানোর থাকলে কমেন্ট অবশ্যই করে পোস্ট টি সব্বার কাছে পৌঁছে দেবেন। দেখা হবে আবার পরবর্তী পর্বে।
ধন্যবাদ।

#পুরী #গটিপুয়া #রঘুরাজপুর #পট্টচিত্র
সমীরণ সামন্ত

Comments