জানা অজানা পুরী
পর্ব ১
লেখায়, সমীরণ সামন্ত
( কোন কিছু ভুল হলে নিজগুনে ক্ষমাপ্রার্থী )
বাঙ্গালীর ঘোরা বলতে গেলে প্রথম মাথায় আসবে, পাহাড় নাকি সমুদ্র। আমি বরাবর পাহাড় বেছে ফেলি। কারন পাহাড়ের নিস্তব্ধতা নিজের সাথে নিজেকে নতুন করে পরিচয় করতে সাহায্য করে। এবারেও সিলেকশন তেমনই ছিল। কিন্তু পকেট ফাঁকা কলশীর কলতান শুনিয়েছিল। খরচের ঝক্কি সামলাতে পারবো না ভেবেই , সমুদ্র কে আপন করে নিলাম।
পুরী, নামটা শুনলেই মনে ভেসে উঠবে সমুদ্র, কানে স্রোত আছড়ে পড়ার শব্দ। ধাইকিরিকিরি শব্দটা অনেকেরই ওখানে গিয়ে শেখা হয়ে গিয়েছে। ভুবনেশ্বর এর খুব বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট এটি। কম বেশি সব্বাই এখানে ভ্রমন কোন না কোন সময়ে করে গিয়েছে। আমি নিজে গেলাম অবশ্য প্রায় বছর ৬ কি ৭ পরে।
পুরী কে একটু অন্য ভাবে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করবো। সমুদ্র স্নান, জগন্নাথ দর্শন এগুলো তো থাকবেই। সঙ্গে সেই জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করবো, যেগুলো “ জানা অজানা পুরী “ ট্যাগলাইনের সাথে মিল খায়। সমস্ত পাঠক বন্ধুদের কাছে তাই আমন্ত্রণ রইলো। পুরীর জানা অজানা ট্যুর এ সব্বাই কে স্বাগত।
দুর্গাপূজা, নবমী। ওই দিনেই আমি বরাবর যাত্রা করি। কারন মায়ের চলে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে পারিনা। দশমী তে ভাসানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার দৃশ্য দেখে মন ভার করবো। তার থেকে ভালো বেড়িয়ে পড়া। দুপুর একটায় ফ্লাইট ছিল। ভুবনেশ্বর এ নামা হবে। সেদিন বেশ হাল্কা দেখলাম এয়ারপোর্ট। হয়তো পরের দিন একটু রাশ হতে পারে।
ঘণ্টা দেড়েক এর ফ্লাইট। জানলার সামনে দৃশ্য গুলো প্রতিবারই নতুন লাগে। এবারেও ব্যাতিক্রম হয়নি।
ভুবনেশ্বর যখন গেলাম, বেলা আড়াইতে প্রায়। বাইরে বেড়িয়ে আকাশ দেখে কেঁচে গেল মনটা। মেঘলা আবহাওয়া, সঙ্গে বৃষ্টি। কলকাতা থেকে রোদ মেখে উড়ে এলাম। আর এখানে সেই ঝমঝম বৃষ্টির আগের দৃশ্য।
ড্রাইভার ভাই বলল, নিম্নচাপ শুরু হয়েছে গতকাল থেকে, থাকবে আগামী আট দিন পর্যন্ত। মনটা আরও ভিজে কাদা হয়ে গেল। হবে নাই বা কেন। আমরা ওখানে থাকা কালীনই পানি পানি থাকবে সমগ্র পুরীর আকাশ। মনে জোর এনে এগিয়ে চললাম। রুটিন যেটাই হোক, কদিন হাওয়া বদল তো হবে রে বাবা।
ভুবনেশ্বর থেকে পুরী, গাড়ি পথে মোটামুটি ১ ঘণ্টা চল্লিশ বড়োজোর।
আমি বলেছিলাম, পুরী এবারে একটু অন্য ভাবে এক্সপ্লোর করতে চেষ্টা করবো। তাই কথামত ভ্রমনের শুরুতেই আজ দুটো জায়গায় ঘুরে তারপর শেষে পুরী ঢুকবো। তাই রাস্তায় সময়টা একটু বেশি লেগেছিল।
পিপলি গ্রাম –
শুধু গ্রাম বলা যায় না, ভারতের একটি আলাদা সংস্কৃতি নিয়ে নিজস্ব সিগনেচার স্টাইলে তৈরি এই গ্রাম। প্রায় ২০০ জনের মত শিল্পী বাস করেন। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী যাওয়ার প্রায় মাঝপথে এই স্থানটি পড়ে, ২০৩ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে।
জগন্নাথ এর অলঙ্করন থেকে শুরু করে রথ সাজানো, প্রায় সমস্ত কাজেই পিপলির সাজ সজ্জা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্থানীয় ভাষায় এই শিল্পের নাম ‘ ঝানডুইয়া ’।
গ্রামে ঢোকার পথে শুরুতেই একটা শপ পড়ে। বৃষ্টির দিনে অমন একটা রঙচঙে দোকান দেখে কার না মনে হয় উঠি। ওনাদের স্টক টাও বেশ ভালো। জগন্নাথ এর ছবি, ছাতা, কুশন, মূর্তি, কুশন কভার এছাড়াও অনেক ধরনের জিনিষ ছিল। এরা মোটামুটি ডাইরেক্ট ওখানের লোকজনের থেকে বানিয়ে বিক্রি করে নিজেরা। তবে একটা ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। যতই ভালো হোক, গোছানো দোকান হোক, দাম টা কিন্তু খুব কম নয়। সেক্ষেত্রে দর কষাকষি চলতেই পারে। আখিরে লাভ আমাদেরই হয়েছিল।
বেশ কিছু জিনিষ কেনাকাটা করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। বৃষ্টি তখনও একটু পড়ছে। একটা ব্যাপার, আমি আসলে এই গ্রামের ভেতরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা হয়তো সম্ভব নয়, লোকাল কেও ছাড়া। পিপলি গ্রামটি শুনেছি যেমন রঙবেরঙের, তেমনই সুন্দর। পিপলির এই শিল্প কে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০০ মহিলা এই প্রকল্পে যুক্ত আছেন। তাদের সাথে দেখা, সরাসরি ইনট্যারাক্ত করার ইছে ছিল। পরের বার সেটা আগে থেকে প্ল্যানিং করেই আসতে হবে, আর হ্যাঁ বৃষ্টি যখন থাকবে না তখন।
সাক্ষীগোপাল মন্দির -
এর পরের গন্তব্য এই মন্দিরে। আর এক নাম সত্যবাদী গোপীনাথ মন্দির। পুরী থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থিত।
এই স্থানের একটি কথিত গল্প রয়েছে।
একজন দরিদ্র যুবক একটি গ্রামে থাকতো। ভালোবেসে ফেলে একটি মেয়েকে। মেয়েটি সেই গ্রাম প্রধানেরই কন্যা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রধান সেই গরিব ছেলের সাথে মেয়েটি বিয়ে দিতে চাননি।
বেশ অনেক দিন কেটে যায়। একবার গ্রামবাসী সমেত সব্বাই কাশীর মন্দিরে যান। সেখানে এই গরিব যুবকটিও গিয়েছিল। সেখানে একটি অজানা রোগে কাবু হয়ে পড়েন গ্রামপ্রধান। বাকি গ্রামবাসীরা তাকে ওখানেই একঘরে করে দেন। এদিকে গরিব যুবক টি এগিয়ে যায়, এবং গ্রাম প্রধানের সেবা করেন।
শেষমেশ গ্রাম প্রধান সুস্থ হন এবং তিনি সেই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সেই ছেলেটির সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবেন বলেন।
গ্রামে একটা সময় সব্বাই ফিরে আসে। দরিদ্র যুবক নিজের বিয়ের কথা বলেন প্রধান কে। এদিকে সেই লোকটি বেঁকে বসেন। তার বক্তব্য, কোন প্রমান আছে কি, যে উনি কাশি তে থাকাকালীন নিজেই বিয়ের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ? যদি কেও থাকে, তাহলে তাকে তার সামনে হাজির করা হোক।
এই শুনে যুবকের মন ভেঙ্গে যায়। যে সময় গ্রামের কেও ছিল, উনি তো সেই সময়েই এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাহলে ? না কোন প্রমান নেই, কোন সাক্ষী নেই।
এই ভেবে সেই যুবকটি গোপাল কে স্মরন করেন।
ভগবান গোপাল তুষ্ট হয়ে সেই যুবক কে বলেন যে উনি যাবেন সাক্ষী দিতে। তবে একটা শর্ত আছে।
যুবকটি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন, আর গোপাল যাবেন পিছনে পিছনে। যাওয়ার সময় পেছনে তাকানো চলবে না।
কথা মত সেই যুবক হেটে হেটে চলে আগে আগে। রাস্তা যখন বালিয়াড়ি হয়, অঘটন ঘটে তখন। সামনে থাকা যুবকটির হঠাৎ গোপালের পায়ের শব্দ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিছু না ভেবেই সে তাকিয়ে ফেলে পেছনে। ব্যাস, ওখানেই গোপাল ঠাকুর পাথর হয়ে যান। স্থানীয় মানুষ অবাক হয়ে যায়, এই যুবকের ডাকে গোপাল সারা দেন বলে।
পরবর্তী সময়ে ওখানেই তৈরি হয় সাক্ষীগোপাল মন্দির।
সেই যুবক বিয়ে করেন সেই মেয়ে কে। সেই মন্দিরের প্রথম পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি।
আর গ্রামের নাম হয় সাক্ষীগোপাল।
এই মন্দিরের একটি নিজস্ব সময় রয়েছে। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম ৪টে বেজে পঞ্চাশ নাগাদ। মন্দির বৃষ্টিতে সেদিন খুলল ৫ টায়।
‘ জয় গোপালা ‘ রব উঠছে বেশ ভালো ভাবে। ক্যামেরা ছাতা জুতো সব বাইরে। বেস্ট হয় গাড়িতে রেখে আসা, নয়তো এসে না পাওয়ার সম্ভাবনা একটু রয়েছে। কেউ না নিলেও পাশে অনেক হনুমান আছে, তারা ব্যাবস্থা করে দেবে।
ভেতরে বেশ কয়েকটি বিগ্রহ রয়েছে। বড় একটি দরজা। খুলতে দুইজন লাগে। ঢুকেই বামদিকের মন্দিরে রয়েছে সাক্ষীগোপাল। কালো রঙের বিগ্রহ। যে শিলের গল্প বললাম সম্ভবত সেটাই।
অনেককেই দেখলাম যাওয়া মাত্র জীবনপঞ্জি, কুষ্ঠী বানাতে বসে গেল। তার জন্য দর কষাকষি অবশ্য অব্যাহত। দান ধ্যান এর কথা বার্তাও চলছে।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মত। মন্দিরের সর্বত্র টাকা। মানে যেখানেই নমস্কার করতে গেলাম, অমুক টাকা দাও এই ভালো হবে, তমুক টাকা দাও এই ভোগ দেবো, ওই ওই নাম লেখাও এই পূজা হবে... এগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া শক্ত। তবে আমার বাড়ির লোক এক জায়গায় দান করার পর, আমি দূর থেকে নমস্কার করেছি মাত্র। সব্বার কাছে আলাদা আলাদা করে টাকা চাওয়ার মানে আমি জানিনা। তবে যখন ওনারা দেখল, আমি দূর থেকেই চলে যাচি, একজন তো বলেই ফেলল, ‘ আরে প্যায়সা নেহি লাগেগা, দর্শন করলো ‘। তার মানে ওরা নিজেরাও জানে , এখানে ওরা কিভাবে কি করে, তার জন্য দর্শনার্থীরা ভুক্তভোগী।
অভিজ্ঞতা যেটাই হোক, দর্শন হোল। আর কি চাই। পুরী যাওয়ার পথে এই মন্দির দেখে না দুখলে নাকি পুরী ঘোরা অসম্পূর্ণ।
এবার যাত্রা সমুদ্রের দিকে, পুরী।
৭টার সময় রুমে চেক ইন করে একটু রেস্ট। হ্যাঁ আমরা এখন পুরীতে।
কোথায় ছিলাম , কেমন অভিজ্ঞতা , সমস্ত কিছু আসবে পরবর্তী অন্যান্য পোস্টে। তার আগে পুরী কাহিনী সময়ান্তরে আমি দিতে থাকবো। যারা পুরী গেছেন, যারা যেতে চান, দুই তরফের মানুষদেরই আমার পোস্টে স্বাগত জানাই। বেশ কিছু নতুন পুরাতন কাহিনী আমি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আশা করছি আপনাদের ভালো লাগবে। নেক্সট বার পুরী গেলে অবশ্যই নতুন ভাবে ঘুরতে সুবিধা হবে, একটুকু বলতে পারি।
পোস্ট ভাল লাগলে আমার চ্যানেল এ একটা ভিজিট করতে পারেন ভিডিওর জন্য
link - https://youtu.be/rwBMIezy7Es
Comments
Post a Comment