রোগী

 রোগী

-----------------------------------------------------
( সম্পূর্ণ গল্প )
কলমে – সমীরণ সামন্ত
কপি বা অন্য উপায়ে লেখা নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।
কপিরাইট সংরক্ষিত।
বানান ভুল এর ব্যাপারে, নিজ গুনে ক্ষমাপ্রার্থী।
সম্পূর্ণ গল্প কাল্পনিক এবং কিছু তথ্যের ওপর নির্মিত মাত্র।
-----------------------------------------------------






ফোনটা আসা মাত্রই সোজা হয়ে বসলাম। ওপার থেকে নরম অথচ খসখসে গলা শুনছি। আজ শোরগোল হবে স্পষ্ট, আগে থেকেই বুঝতে পারছি।
তোকে না বল্লুম, আজ আসতে, সেই সকাল থেকে বেলা বয়ে যায়। আমি পুকুর পাড়ে বসে আছি তো। কখন তুই আসবি। বসে বসে ভাবছি, এই বুঝি রিক্সর আওয়াজ এলো। দূর থেকে চেঁচিয়ে পাড়ার কেও ঠিক বলবে, ও মুন্নির মা, দেখো কে এয়েছে, তোমার নাতনি যে। আজও এলি নে ছুড়ি ? আমি কিন্তু এবার মরে যাবো। চলে যাবো এই গ্রাম ছেড়ে। দেখিস তুই। বারবার বলছি তুই আসছিস না তো ? আমি চলে যাবো, আর থাকবো না। আজ রোববার, সকাল থেকে বসে থেকে থেকে হাঁটু দুটোয় জোর লেগে গেল। আর উঠতে পারছি না। আমি আর দুদিন থাকবো। এর মধ্যে তুই যদি একবার দেখা করতে আসিস ভালো, নয়তো আমি চললাম, আর কখনও দেখা পাবি নে তোর দিদুনের।

কেটে গেল ফোনটা, কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। মোবাইল টা নিয়ে বসে রইলাম, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি। পেছন থেকে মুন্নি, ও সরি আমার মা বলে উঠলো, কি রে ঠিক আছিস তো ?

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি। যত হয়েছে আমার জ্বালা। তোমার মা, তুমি দেখতে যাও না। আমাকে কেন এই সময়ে সামনে রাখছ, জানোই তো নতুন চেম্বারে সময় কুলিয়ে পারছি না। ওদিকে দিদুন পারলে প্রতি সপ্তাহে হুমকি দেয়, আমাকে দেখবে বলে। না গেলে উলটো পাল্টা কথা শুনিয়ে দেয়। শুধু মরার হুমকি দেয় বুড়ি। মরবে কি মরবে না পরের কথা, তাই বলে এই ভাবে ব্ল্যাকমেইল লাগাতার। নিজের স্বাভাবিক মনে আঘাত লাগে যে। কাজ করবো কি করে।

পেছন ঘুরে ঝাঁজিয়ে বললাম মা কে। তোমায় কতবার না বলেছি, ছুটির দিন হলে তুমি না হয় একটু ঘুরে আসো, আমি এখানে ম্যানেজ করে নেবো, একটা দুটো রাতের ব্যাপার। আমার রাতের খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, হোম ডেলিভারি বলে বস্তু টা আছে।

মা শুধু হাসল উত্তরে। আমি জানি এই হাসির কারন টা। সমস্যা হোক বা আমার মুখচোরা কথা, কোনটাতেই মা বিশেষ কথা বলে না। বাবা হারিয়ে গেলে তার অনুপস্থিতি কতটা সমস্যা করে জীবনে বেড়ে উঠতে গেলে, সেটা সে জানে। তাই সবসময় চোখে চোখে রাখে।
আসলে আমার বাবা মারা যায়নি। পালিয়ে গেছে, মা কে ছেড়ে। সেটাও আমার জন্মের কথা শুনে।
শুনতে অদ্ভুত লাগছে। আছা, শুরু থেকেও বলি তাহলে।


--


আমার নাম রানু। পুরো নাম ডক্টর রোহিণী মিত্র। পেশায় একজন সাইকোলজিসট।
এই গুরু গম্ভীর নামটা শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। আপাতত নিজের প্রাইভেট চেম্বারে প্র্যাকটিস করছি। নিজের নাম ডাক কতটা ছড়িয়েছে জানি না, কিন্তু রোগীরা এসে খোলা মনে যখন আমার সামনে নিজেকে উজার করে দেয়, আমি তখন ওদের খোলা জানালা দিয়ে জীবনে বাঁচতে শেখাই। জীবনের মানে শুধু হেরে যাওয়া নয়, সব কিছুর সাথে লড়াই করে বেচে থাকা। সমস্তটাই মনের জোরের ফলে সম্ভব।

আমার সংসারে আমি আর মা। এই দুইজন ব্যাস। মা কে ছাড়া আমি আর কিছু বুঝিনা আসলে। তবে তার জীবনেও অনেক উথাল পাথাল ঘটনা রয়েছে।
মা পালিয়ে বিয়ে করেছিল বাবার সাথে। সেই সময়ে পালিয়ে বিয়েটা অন্যভাবে দেখা হতো। এখনও হয় অবশ্য।
মামাবাড়িতে তেমন কেও মানেনি। একমাত্র দিদুন ছাড়া। মায়ের দিক থেকে একমাত্র দিদুন কথা বলে সমস্ত ঝামেলা মিটিয়েছিল। তবে দিদুনেরও একটা ভুল হয়েছিল। আমার বাবাকে চিনতে। বুঝতে পারেনি আমার বাবা আসলেই মা কে ভালবাসেনি, তার ভেতরে ভিন্ন চিন্তা পোষণ করে রেখেছিল।
পরিনতি ঘটলো ঠিক দুই বছরের মাথায়। আমার জন্মের খবর শুনে একদিন রাতে বাবা চলে গেল ঘর থেকে। সেই রাতে বাবা যেই গেল, আর এলো না ফিরে। বড় হয়ে দিদুনের মুখে সমস্তটাই শুনেছি। সেই থেকে আমি আর মা, এই আমার জগত। ভবিষ্যতে কোন ছেলেকে ভালবাসবো কিনা জানিনা, তবে এক পুরুষমানুষ যদি আমার মায়ের মত মা কে ছেড়ে যেতে পারে, তাহলে তাদের ভরসা করা টা কিন্তু বেশ শক্ত আমার মনে হয়।

কোলকাতায় দিদুনের চেনা একজনের ফ্ল্যাটে এসে মা থেকে গেল। তারপর আমি হলাম। যতদিন না স্কুলে ভর্তি হলাম, দিদুন আমাদের সাথে থেকে সব কিছু গুছিয়ে দিতে থাকলো। আজ আমার বয়স ছাব্বিশ পেড়িয়ে গিয়েছে। সেই দিদুন আজ বুড়ি। সেই রকম কাজ করতে পারে না। তবে আমায় খুব ভালবাসে, তাই সবসময় একটু দেখতে চায়



যতই আমি বুড়ি বলি, আমিও জানি, এই বুড়ির অবদান আমাদের জন্য কত খানি।
একটু তো দেখতেই চাইছে আমায়, সেটাও কি পারবো না তাকে দিতে। শেষ বয়সে তার আর আছে টা কে। দুই মামা তো আলাদা থাকে নিজেদের ফ্যামিলি নিয়ে। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া আর কেই বা দেখবে, আমার বুড়ি কে।


সবই আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন আসলে কথা দিয়ে কথা রাখাটাই সমস্যার হয়েছে। নতুন চেম্বার, নতুন মানুষজন, নতুন রোগী
সাধারনের তুলনায় একটু বেশি সময় ধরে থাকি। যাতে পরিচিতিটা সেই ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কাউন্সেলিং সেশন এর ব্যাপারে আমি কখনোই ঘড়ি দেখি না। ঘড়ি দেখে আর যাই হোক, মনের চিকিৎসা করা যায় না। প্রতিটা কেসই নতুন আমার কাছে। আর ততটাই ইন্টারেস্টিং বটে।
দিদুন কে আমি এই সপ্তাহে যাবো বলেছিলাম ঠিকই। কিন্তু একটা ক্রিটিক্যাল কেসের জন্য আটকে গেলাম। পার্সোনাল লাইফ আর প্রফেশন লাইফ গুলিয়ে ফেলার মত আমি মেয়ে নই। কিন্তু এই কেসটা সব থেকে নতুন ও আধুনিক। দিদুন কে এই সমস্যার কথা বোঝাবো কি করে। বোঝাতে চাইও না, কারন ঐ বুড়ি আছে বলেই আমি এতদুর পর্যন্ত এগোতে পেরেছি।
থাক না একটু শান্তিতে।

--

আজ রোববার সেই রোগী কে টাইম দিয়েছি। রোববার আমার ছুটি থাকলেও, ঐ যে বললাম এই অবাক সমস্যার সাজেশন আমি নিজেও গত দুই সপ্তাহ ধরে খুঁজে পায়নি। আজকের সেশনে ওনাকে আরও একটু বেশি সময় দিয়ে দেখবো, ভেতর থেকে কিছু বের হয় কিনা।
তার আগে প্রাথমিক ব্যাপারটা সব্বাই কে বলে রাখা দরকার। এমন ক্রিটিক্যাল রোগী এই প্রথম, ওনার ব্যাপারটা না বলে থাকতে পারছি না।


পেসেন্ট এর নাম বিশেষ কারনেই গোপন রাখছি। ধরে নেওয়া যেতে পারে, তার নাম কুয়াশা। একজন মাঝবয়সী হাউসওয়াইফ। বয়স ৩৯, নিঃসন্তান। সতেরো বছরের সংসার জীবনে স্বামীর মুখের ওপর কথা বলা কাকে বলে কুয়াশা জানে না। জানার কথা নয়। কারন ওনার স্বামী যথেষ্ট সাছন্দে ওনাকে রেখেছেন। সরকারী অফিসার বলে ওনার নিজের এলাকায় একটা সুনামও রয়েছে। বিয়ের পর কোলকাতার পুরানো ফ্ল্যাটে ওঠেন । ঘরের মধ্যে তিনজন প্রাণী মাত্র। কুয়াশা, স্বামী এবং তার শাশুড়ি মা। সমস্তটাই ঠিক ছিল। ঘরে না ছিল অভাব, না ছিল অশান্তি। কুয়াশার স্বামীর বক্তব্য অন্তত সেরকমই ছিল। পাশাপাশি হাড়ি কড়া থাকলে যে ঠোকাঠুকি টা লাগবে, সেটা স্বাভাবিক ভাবে তাদের ঘরেও চলে। এর থেকে বেশি কিছু ছিল না অসহ্যের মধ্যে। কুয়াশা কে জিজ্ঞেস করেও তেমনটাই ডেটা পেয়েছি আমি।
সমস্যা শুরু হয়েছে ঠিক দুই বছর হোল।


স্বামীটি প্রথম প্রথম ব্যাপারটা পাত্তা দেয়নি।
কুয়াশা নাকি ঘরের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করে। এমন কিছু একটা অনুভূতি তার মধ্যে জাগে, যেখানে সে মনে করে, তার রুমে সে ছাড়াও আরও অন্য কেও আছে। শুধু সেটা নয়, ইদানীং তাকে নাকি তার শাশুড়ি মা খুব জ্বালায়। মানে সেই ট্র্যাডিশনাল দজ্জাল মহিলা হিসেবে নয়।
কুয়াশা যখন ঘরে শুয়ে থাকে, দূর থেকে শাশুড়ি গামছা গুটিয়ে ছুড়ে মারে। আবার কখনও আবার বাথরুম এ কুয়াশা থাকলে বাইরে থেকে ছিটকিনি টেনে দেয়। একে ভাত খেলে খাবার থালা লাথি মেরে ফেলে দেয়। এমন অদ্ভুত কাজ ঠিক কি কারনে করে আপাতত বুঝতে পারিনি। রাতারাতি তার শাশুড়ি এমন ভাবে পালটে গেল কেন, সেটাও জানতে হবে। কোন ভাবে উনি কি কিছু করেছেন বা কোন আঘাত পেয়েছেন যার বহিঃপ্রকাশ এটা। মনের ভেতরে ঐ বয়স্কার কি চলছে সেটা জানতে হবে আমায় আগে।
তাই ঠিক করেছিলাম, ওনার শাশুড়ি কে সেশনে একবার ডাকব।
ফ্যামিলি ম্যাটারএ অনেক ক্ষেত্রে একটা সুস্থ কাউন্সেলিং দরকার, সব কিছু ঠিক করার জন্য। সব্বার সাথে কথা না বললে সমস্যার শেকড় পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে না।

লাস্ট সেশনে ওনার স্বামীকে তাই বলেছিলাম, পরের সপ্তাহে যেন উনি ওনার মা কে আনেন।
কথা শুনে উনি বেশ চমকে গিয়েছিলেন। কি বলতে কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। নিজের ভাব প্রকাশ প্রায় চেপেই গেলেন। তারপর যেটা বললেন, সেটা শোনামাত্র আমার মাথা ঘুরে গেল। আর তখনই ঠিক করলাম, নেক্সট সপ্তাহ নয়, এই রোববারই একটা সেশন করা দরকার। আর সেটাই আশা করছি শেষ সেশন হবে কুয়াশার জন্য।

--

কুয়াশার স্বামী জানালেন, কুয়াশার সমস্যা শুরু হয়েছে ঠিক বছর দুই আগে। তার মা মারা যাওয়ার পরের মাস থেকেই

অর্থাৎ কুয়াশা এতদিনে যে বলে আসছিল, তার শাশুড়ি তাকে খুব জ্বালায়, তার আগে একবারও বলেনি যে, তার শাশুড়ি মারা গিয়েছে।
ইনফ্যাকট এটা আমার জেনে নেওয়ার কথা, কিন্তু বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা শুরুতেই এভাবে পেঁচিয়ে আছে।
কুয়াশা একা ঘরে সবসময় থাকে। শাশুড়ির মৃত্যু ঐ ফ্ল্যাটেই হয়। হ্যাঁ স্বাভাবিক ভাবেই হয়।
ঘরে কোন কিছুর অনুভূতি এসব ক্ষেত্রে কোন না কোন ভাবে ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কিছুদিন আগেও যে মানুষটা হেটে বেড়াত, সে আজ নেই। ভাবলেই ভয় লাগে তায় আবার যদি মৃত্যু ওখানেই হয়। ভয় পেয়ে গেলে ব্রেইন হ্যালুসিনেট করায়। এর ফলে মানুষ উলটো পাল্টা জিনিষ দেখে, যার বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই

কিন্তু প্রশ্ন টা অন্য জায়গায়।
যে শাশুড়ি জীবিত অবস্থায় এমন ব্যবহার করেনি, সেই মরে যাওয়ার পর এমন দজ্জাল ব্যবহার করছে কেন ? মানে কুয়াশার এমন ভ্রম আসার কারন কি ?
যাকে সে নিজের শাশুড়ি মনে করছে, আসলেই কি সে তার মৃত শাশুড়ির ভ্রম ? নাকি আমি নতুন কিছুর সন্ধান পেতে চলেছি ? আমার ভাবনা সঠিক পথে এগছে কিনা একদম বুঝতে পারছি না
গণ্ডগোল টা যদি শাশুড়ির মধ্যে থাকে, সেটা সমস্যার। মড়া মানুষের কাউন্সেলিং আমি তো করিনা।


যাকগে, আজ বিকেল ওদের আসার কথা।
ওরা গেলেই আমি দিদুনের কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করবো। দেখি মা কে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।

---


সোমবারের সকাল। ব্যাস্ততা একটু বেশি হয় সপ্তাহের শুরুতে। সেই ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে আমি সকালের প্রথম বাসটাই ধরেছি। মা কে বলেছিলাম, ভোরে ডেকে দিতে। ও হ্যাঁ, মা কে নিয়ে আসতে পারিনি। বলল, একটু দেখে আয়, পরের বার দিদুন কে দেখতে সে একাই যাবে। এই কথা মা অবশ্য বরাবর বলে আমায় পাঠিয়ে দেয়। আমিও কিছু বলিনা। মায়ের বাহানা যেমনই হোক না, আসলেই গ্রামে সে আর মুখ দেখাতে চায় না। হাজার হোক পালিয়ে বিয়ে করার পর নিজের ঘর তো আর টেকাতে পারেনি।

বাস ছেড়ে দিয়েছে এই আধাঘণ্টা হয়েছে। দিদুনের কাছে পৌছাতে ঘণ্টাখানেক লাগবে আর। কালকের সেশনটা নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে এই ফাঁকে।

গতকাল স্বামী স্ত্রী চেম্বারে এসে গিয়েছিল ঠিক বিকেল পাঁচটা নাগাদ।
প্রথমে কুয়াশা তারপরে তার স্বামী, এই ভাবে দুই বার আলাদা করে সিটিং নিলাম। বেশি সময় লেগেছিল কুয়াশার ক্ষেত্রে। আর সেটাই খুব কার্যকরী হয়েছিল। ডেটা মাইনিং করতে গিয়ে এমন সমস্ত তথ্য উঠে আসতে শুরু করেছিল, সেটা বেশ চিন্তা করতে বাধ্য করেছিল আমায়। এটাই হয়তো আমার প্রথম জটিল কেস ছিল। অনেকটা সময় ধরে আমিও একটু ব্যাপার গুলো নিয়ে ভাবলাম। পুরনো কেস স্টাডি করলাম। তারপর এলো একটা সমাধান

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে দম্পতিদের অ্যাডভাইস দিয়েছি, আশা করছি ওদের জীবন আবার সুখকর হয়ে উঠবে। তিনমাস পরে আর একটা ডেট দিয়ে দিয়েছি রিভিজিট এর জন্য। রাতের ঘুমের জন্য হালকা মাত্রার একটা ওষুধ এবং মুড সুইং যাতে না হয়, সেটার একটা দিয়ে দিলাম। বাকিটা আমার কথা শুনে চললেই হবে।

কুয়াশার সমস্যার সমাধান জানতে হলে আগে জানতে হবে, আমাদের ব্রেইন কে। বেসিক্যালি এই ব্রেইন এর সাথে মনের সম্পর্ক গভীর
আজও এর রহস্যের শেষ নেই। মানুষের মধ্যে সবথেকে কঠিন পার্ট, যেটা আজও অবোধ্য, সেটা হোল মানুষের মন, যেটা খাতা কলমে কোন গনিতের মত নয়।
যে ছেলেটা একটু আগেও মাঠে খেলতে এসেছে সে হয়তো বাড়ি গিয়ে রাতে গলায় দড়ি দিল, অথবা যে মেয়েটা পাড়ায় নতুন উঠেছে, সে রাতে সুইসাইড করেছে। কিন্তু কেন ? একটু আগে পর্যন্ত ওদের মধ্যে এমন লক্ষণ তো দেখা যায়নি, বোঝা যায়নি। তাহলে এমন ভয়াবহ পরিনতি কিকরে হোল।

এই সমস্তটাই ব্রেইন আর মনের ওপর। যেটা বাইরে থেকে বোঝা তো দূরস্থ, ব্যাক্তি নিজেই বুঝতে পারে না আসলেই কি ঘটতে চলেছে, এর পরের ভাবনাটাই বা কি, আদেও তার ভাবনা কি ঠিক ?
একটু সহজ ভাবে বুঝিয়ে বলি।
তিনটি পার্টে বিভক্ত করা যায় মানুষের মস্তিষ্ক কে। সচেতন, অচেতন আর অবচেতন। প্রথম ব্যাপারে বলতে গেলে, যেটা আমরা সম্পূর্ণটাই জেনে বুঝে করি, যেটা করার মধ্যে আমাদের ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণ ভাবেই সজাগ, সেটা সচেতন অংশ। এই যেমন কেও আমার লেখাটা এই মুহূর্তে পড়ছে, এটাও সচেতন অংশ কাজ করছে। অচেতন মানে টা বলে দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু এই দুটি ছাড়াও তৃতীয় নামটি যেটা নিলাম, সেটাই সমস্ত কিছুর পাণ্ডা।


আমাদের ব্রেইন এর এই শক্তিশালী অংশ নিয়ে বলার আগে একটা প্রশ্ন করি।
যদি তোমাকে বলি তুমি পাঁচ বছর বয়সে নিজের জন্মদিনে কি জামা পড়েছিল ? কারা এসেছিল ? তুমি প্রথম কবে সমুদ্র ঘুরতে গিয়েছ ছোট বেলায় ? প্রথম স্কুলের দিনটা কি হয়েছিল ?
আমি জানি একটারও উত্তর দিতে পারবে না, কারন সেই স্মৃতি তোমার এতটুকুও মনে নেই। কারোর মনে থাকার কথা নয়।
কিন্তু সেই সময়ে যেগুলো ঘটে ছিল সেগুলো কিন্তু তুমি তোমার চোখ দিয়েই শুট করেছিলে। কম্পিউটারের ভাষায় বলতে গেলে, সেই শুট করা ফাইল টি ভিডিও আকারে তোমার মস্তিষ্কের একটি অংশে এখনও সেভ রয়েছে। আসলে যেকোনো মানুষ চোখে যেটা দেখবে একবার, সেটা সারাজীবন এর জন্য সেভ হয়ে যায় কোন না কোন জায়গায়।
সেই জায়গার হদিস একমাত্র অবচেতন মন দিতে পারে। সেই স্মৃতি থাকে একমাত্র অবচেতন মনের হেফাজতে।
এই অবচেতন মন কে সঠিক পথে যদি নাড়াচাড়া করা যায়, তবেই একমাত্র সমস্ত তথ্য বেড়িয়ে আসবে। তুমি নিজেও অবাক হয়ে যাবে।

কুয়াশার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটেছে। সাব কন্সাস মাইন্ড অর্থাৎ অবচেতন মন ওর সামনে এমন কিছু ছবি তুলে ধরেছে, যেটা ওর সচেতন মন চিন্তা করতে পারছিল না। বুঝতে না পারার জন্য বাকি ইন্দ্রিয় সেগুলো কে সত্যি মনে করছিল। প্রচণ্ড স্ট্রেস নিয়ে ফেলছিল কোন না কোন ভাবে। স্বাভাবিক ভাবেই ইন্দ্রিয় নিজের কাজ সঠিক ভাবে করতে ব্যর্থ হছিল বারবার। এই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী প্রতিটা মানুষের ইতিহাস, অর্থাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। তার প্রথম জীবনে ঠিক কি ঘটেছিল, যার প্রভাব এই বয়সে এসে পড়ছে।

কুয়াশার সাথেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গিয়েছে। যখন ওর বয়স অত্যন্ত ছোট ছিল।
ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর দিদির কাছে মানুষ হয়েছে সে। মায়ের অভাবটা তেমন ভাবে বুঝতে দেয়নি তার দিদি। যতটা পারে আগলে রেখেছিল। কুয়াশাও দিদি কে অন্তপ্রান দিয়ে ভালবাসা দিয়েছিল।
তবে কালের সাড়াতে দিদির এক জনের সাথে কলেজে সম্পর্ক তৈরি হয়। এদিকে কুয়াশার মন ভেঙ্গে যায়
দিদি কে ছেড়ে সেই বা থাকবে কিকরে। কিন্তু ও এটা জানত না, ওর দিদি ওকে একা ছাড়বে না কোথাও। বিয়ে ঠিক হয়ে যায় একটা সময়। দিদি নিজের প্রেমিকের কাছে শর্ত রাখে, নিজের বোন কে একসাথে রাখার। রাজি হতে বেশি অসুবিধে হয়নি।
সমস্তটাই ঠিক থাক চলছিল, তবে পাঁচ বছর পর্যন্ত।
নিঃসন্তান হওয়ার কলঙ্ক কোন মেয়েই মেনে নিতে পারে না
কুয়াশার দিদিও পারেনিসমস্ত দোষ কুয়াশার কুয়াশার প্রতি নজর রাখতে গিয়েই ওর দিদি আর নিজের জন্য কিছু ভাবেনি, এমনটাই মনে করতে শুরু করল দিদির স্বামী। এদিকে শ্বশুর বাড়ি থেকে অপমান, লাঞ্ছনার শিকার হওয়া দিদি ভয়ানক পরিস্থিতিতে। না আছে স্বামীর সুখ, না রইলো শ্বশুরবাড়ির সম্মান। গায়ে হাত তোলা পর্যন্ত চলতে থাকলো দিদির সাথে।
ঘরের বাসন মাজা, ঘর ঝাট দেওয়া সবই চলতো। কাজের লোক তাড়িয়ে নানা ভাবে অপদস্থ করতো। কাপড় গুছিয়ে রাখা থাকলেও সেটা আবার দলামলা পাকিয়ে মুখের ওপর ফেলে দিত। রাতের খাবার অনেক সময় ওর খাওয়ার আগেই শেষ হয়ে যেত। ঘরের মধ্যে মাঝে মধ্যে আটকে রেখে দিত ওর দিদি কে।
এই সমস্ত কিছুই কুয়াশার চোখের সামনেই হতো। ছোট বয়সে সেগুলো ওর চোখের মাধ্যমে মনে গেঁথে গিয়েছিল
অবচেতন মনে সেই ছবি লুকিয়ে যায় কুয়াশার অজান্তে। কেউকি বুঝতে পারেনি কুয়াশার মধ্যে এক প্রকার ক্ষোভ তৈরি হয়ে গিয়েছে শাশুড়ি ব্যাপারটায়।
 
সমস্ত কিছুর শেষ হয় সেদিন, যেদিন ওর দিদি কে হল ঘরে পাখার সাথে ঝুলতে দেখল কুয়াশা
একটা কাগজ ছিল নিচে পড়ে। আইনি বিষয়ে কিছু লেখা ছিলনিজের জামাইবাবুর একটা স্বাক্ষর ছিল কাগজের একপাশে। কুয়াশা বুঝতে পারেনি সেটা।
এরপর সরকারি একটি সেবা নিকেতনে কুয়াশা নিজেই চলে যায়। সেখানেই কাটে তার বাকি জীবন। সেখানেই কোন ভাবে আলাপ হয় একটি ছেলের সাথে, যে তার স্বামী। আর তারপরের ঘটনা যেটা ঘটেছে।


কুয়াশার শাশুড়ি বদমেজাজি একেবারেই ছিল না। বরং কুয়াশাই মাঝে মধ্যে অদ্ভুত ব্যাবহার করতো তার ওপর। কিন্তু অবাক করা বিষয়, পরবর্তী সময়ে সে সেই ব্যাপারে একদমই ভুলে যেত। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর কুয়াশা তাকে খুব মনে মনে মিস করতো।
ঘরের মধ্যে অনেকটা সময় একা থাকতে থাকতে কুয়াশার মনে নেগেটিভ প্রভাব পড়তে শুরু করল

ব্যাপারটা স্পার্কের মত কাজ করল সন্তানহীনটা ব্যাপারটা।
দিদির সাথে ঠিক এই কারনেই বাজে ব্যাবহার হতো।
কুয়াশার মনের ভেতর অবচেতনে সেই ব্যাপারটা জেগে উঠতে শুরু করল আস্তে আস্তে।
চিন্তার মাত্রা এতোটাই প্রবল হয়,একটা সময় নিজের শাশুড়িকে ভাবতে গিয়ে দিদির শাশুড়ির কথা মাথায় চেপে বসে, আর নিজেকে দিদির জায়গায় দেখতে শুরু করে।

ওনার স্বামীর সাথে কথা বলে জেনেছি, ঘরের মধ্যে যখন উনি থাকেন, তখন কুয়াশার ভেতরে কোন সমস্যাই দেখতে পাওয়া যায় না
কিন্তু অফিসে বেরোনোর পর থেকে কুয়াশা নিজের মধ্যে আর থাকে না। নিজের দিদিকে নিজের মধ্যে দেখতে গিয়ে এক প্রকার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এ ভুগতে থাকে। যার ফলস্বরূপ এমন কিছুই ঘটে।
ঐ ঘরে কোন সমস্যাই নেই। না আছে কোন আত্মা, না আছে কোন তৃতীয় সত্ত্বা। সমস্তটাই ওর মনের কল্পনা। সেই কল্পনার প্রভাব কখনও জোরালো হয়ে গেলে নিজের সামনে শাশুড়ি কে দেখতে পায়। এটা একপ্রকার ভ্রম, যেটা ওর মাথায় তৈরি হয়, যার কোন অস্তিত্ব নেই।

এগুলোর সমাধান যতটা সহজ মনে হয়, ততটা নয়। তবে এই অবস্থায় কুয়াশা কে একা না রেখে মানুষের সাথে মিশতে দেওয়া খুব ভালো
নিজেকে কিছু কাজের সাথে ব্যাস্ত রাখতে হবে। দরকারে একটু কোথাও থেকে ঘুরে এলে তো খুব ভাল।
নিঃসন্তান এর ব্যাপারে আমি আমার বন্ধু কে সাজেস্ট করে দিয়েছি, গাইনো স্পেশালিষ্ট।
আসলে আমি যে রুটিন দেখলাম ঐ ভদ্রলোকের, আমার মনে হয় না ওনারা এতো বছর ধরে নিজেদের সময় দিতে পেরেছেন
সঠিক ভাবে চেষ্টা করলে মনে হয় এই ব্যাপারটা ঘটত না।
আজকের দিনে এই ব্যস্ততম জীবনে অধিকাংশ স্বামী স্ত্রী নিজদের ক্যারিয়ার হাব নিয়ে এতোটা ব্যাস্ত থাকে, নিজেদের ভাবনা, দায়িত্বগুলো ভুলেই যায় প্রায়। সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে চেষ্টা করলে নিঃসন্তান হওয়ার কোন কারণই নেই। এটুকুটাই বুঝতে বুঝতেই বছর কেটে যায় এই সকল দম্পতিদের।



--


বড্ড জোরে হর্ন দিছে।
বুঝলাম শেষ স্টপ দিয়ে দিয়েছে বাস।
এখান থেকে ভ্যান রিক্সা করে কুড়ি মিনিট পরেই মামাবাড়ি।

গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলল রিক্সা। পাইলট সীটে একটি চ্যাংড়া ছেলে, বয়স আন্দাজ কুড়ি একুশ।
কি নাম বললেন যেন দিদি, এই প্রথম শুনলুম। আপনি রাস্তা চেনেন তো ঠিক, ছেলেটি বলল।
প্রথম থেকেই ছেলেটি চিনতে না পারার কথা বলেছিল, আমি ওকে ভরসা দিয়ে বলেছিলাম, আমি চিনিয়ে দেবো। আমার মনে হয় ছেলেটি এই লাইনে প্রথম
দর কষাকষির চক্করে যায়নি দেখেই অবাক হলাম।

এই ছেলে, তুমি কি নতুন এসেছ এই রিক্সার লাইনে ?
হ্যাঁ দিদি, নতুন বটে। ইস্কুলে কোন রকমে ক্লাস এইট, টেনেটুনে মাধ্যমিক। তারপর এদিক সেদিক বাবার সাথে কাজ করতে করতে শেষমেশ এই পথে। তবে যাই বলেন দিদি, এই পথে কিন্তু ইনকাম ভালো না হলেও সময় কেটে যায়। বহু মানুষ কে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দি, তাদের সাথে গল্প করতে করতে মন ভালো হয়ে যায়। দেখতে দেখতে সারা দিন কেটে যায়, আর আমি দুটো পয়সা রোজের নিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে দি।

ছেলেটি একটু গল্প করতে ভালোবাসে। তাই একটু বেশি বকবক করছে, তবে যতটুকু বলেছে, খুব মিষ্টি লাগছে কথা বলে। গ্রামের ছেলেরা একটু অমন টাইপের হয়। যে ছেলে সারাদিনের পয়সা রোজগারের পর মায়ের হাতে দেয়, বাইরে ফুর্তি করে না, সেই ছেলে আর যাইহোক, মনের থেকে সৎ।

আপনাকে বাস থেকে নামার পরই ভাবলাম, দিদিভাই কে আমি তার গন্তব্যে পৌঁছে দেবো কুনি। ছেলেটি আবার বলা শুরু করল। দিদিভাই, আপনি জলদিঘি গ্রামের কথা বললেন না ? ওখানে কার বাড়ি যাবেন ?

তুমিতো আমার গ্রামটাই চেন না, কার বাড়ি যাবো বললে চিনবে কি করে ?

আমি চিনি না, কারন এই এক বছরে মানে আমি যতদিন এই লাইনে এলাম, আপনি প্রথম যে ওখানে যেতে চাইছে। সেই জন্য ঐ দিকটা আমার তেমন ভাবে জানা নেই।
একটু অবাক হয়ে বললাম, ওদিকে তেমন কেও যায়না নাকি ? ঐ গ্রামটা তো বেশ বড়। এখন কি যাওয়ার রাস্তা অন্য দিক থেকে করে নিয়েছে নাকি ? আমার তো তেমন ভাবে মনে পড়ছে না।    

 
সত্যি আমি ভাবতে শুরু করলাম। ছেলেটি বলে কি। এই এক বছরে একটাও পাসেঞ্জার পায়নি জলদিঘির ? কি হোল টা কি গ্রামের ? বেশিক্ষণ কথাটা ভাবতে হয়নি। তার আগেই পেছন থেকে হর্নের শব্দ পেলাম। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে
আমরা যে রাস্তায় যাচি, আসলে সেটা এতোটাই সরু, কাউকে পাশ দিতে হলে কোন একটি কোন মাথা পর্যন্ত পেছন পেছন করে যেতে হবে। এছাড়া তেমন কোন উপায় নেই।
কে এতবার করে হর্ন মারে রে, বিরক্তি বোধ হছিল।
রিক্সায় বসে পেছনে তাকাতেই চমকে গেলাম। অমল মামা না ?
মানে মায়ের বড়দা। সেও আমাকে দেখেই চমকে উঠেছে চিনতে পেরে

গাড়িতে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞেস করল, কি রে খুকি, কেমন আছিস মা ?

কীভাবে নিজের আনন্দটা প্রকাশ করবো জানিনা। রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়লাম। মামা কে অনেকদিন পর সামনে থেকে দেখে আপনে আপ মাথা নিচু হয়ে গেল। রাস্তায় দাড়িয়ে প্রনাম হয়তো এর আগে কাউকে করিনি। এই মামারাই তো মাকে সাপোর্ট করেনি, পালিয়ে বিয়ে করার জন্য। যাকগে সেসব কথা।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এতদিন পর মামাবাড়ির কথা মনে পড়ল বল।
কিন্তু রিক্সায় কেন যাচিস ?
আমাদের গ্রামে এখন ঘরে ঘরে বাইক স্কুটি হয়ে যাওয়ার পর, কেও আর রিক্সায় যাতায়াত করে না।  
বুঝে গেলাম রিক্সা ভাইয়ের পাসেঞ্জার না পাওয়ার কাহিনী।

সম্পূর্ণ টাকা মিটিয়ে আমি পাইলট ভাই কে ছেড়ে দিলাম। হ্যাঁ জানি, এটাই হওয়ার ছিল। আমার দিকে মিটিমিটি চেয়ে রিক্সা ঘুরিয়ে নিল ছেলেটি

বাইকে আমি বসে পড়লাম মামার পেছনে।

মামা, দিদা কি করেছে গো ? পুকুর পাড়ে বসে আছে ?

মাথায় কি বাজ পড়ল ? নাতো।
তাহলে ?
আমি কি ভুল প্রশ্ন করলাম ? মামা অমন করে চমকে উঠলো কেন ?
নাকি বাইকের শব্দে আমার কথা কানে যাছে না মামার।

ও মামা, দিদা কি করছে ?
এই বারে একটু জোর গলাতেই জিজ্ঞেস করলাম। নিশ্চয়ই শুনতে পেয়েছে সে।
গাড়িটা একটু স্লো করে দিল, চালাতে চালাতে।
খুকি, তুই কি কিছু জানিস না ? তাহলে আজ এলি কেন এখানে ?
তোকে দেখে আমি ভাবলাম তো তুই সব জেনে বুঝেই এসেছিস।

কি হয়েছে মামা ? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
ততক্ষণে মামাবাড়ি চলে এসেছি। বাইক টা মাঠের ঢাল থেকে নামিয়ে নিচে রাখল। আমি নামার পর মামা নিজের হেলমেট খুলে বাইকে লাগাল পেছনের দিকে। মুখ যখন তুলল, দেখলাম মামার চোখে জল। অথচ এর কারণটা আমি কিছুতেই টের পায়নি এখনও।

মামাবাড়ির ভেতর থেকে এক ধরনের আওয়াজ আসছে। ঠিক মেলানো মেশানো, বুঝতে পারছি না ওটা ঠিক কিসের । এক প্রকার মিশ্র শব্দ। আস্তে আস্তে আমি মামা কে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচি।
কানে অদ্ভুত সব শব্দ আসছে আবারও, আরও স্পষ্ট হছে। ভেতরে কোন এক মন্ত্র উচ্চারণ হছে। আবার কেও বা কারা কাঁদছে। কান্নাটা হালকা হছে, এর মধ্যে কোন জোর নেই। নাক মোছার শব্দ পাছি। ঠিক যেন একটা শোকসভা মত।
দুই পা অবশ হয়ে যাবে হয়তো, কারন আমি আর এগোনোর সাহস পাছি না।


দালান পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম, এক ঝাক লোক
বসে আছে গোল হয়ে। একপাশে একজন পুরোহিত মশাই কাজ সম্পন্ন করছেন। আর ঠিক মাঝে একটি ফটো ফ্রেম বসানো। ফ্রেম জুড়ে রজনির মালা, কপালে চন্দনের ফোঁটা, পাশে অনেকগুলো ধূপ জ্বলছে।

--


দিদুনের অনেক বয়েস হয়েছে। তবুও আজকের দিনে সে বসে রয়েছে, তার একমাত্র মেয়ের ফটো ফ্রেমের সামনে। আজ আমার মায়ের  প্রথম বাৎসরিক কাজ।
দিদুন আমায় দেখার পর, চোখে জল আর ধরে রাখতে পারেনি
সাত রাজার ধন সে পেয়েছে যেন। মা চলে যাওয়ার পর আমি একমাত্র মুন্নির শেষ অংশ।
তোর মায়ের আজ প্রথম বাৎসরিক, আর তুই আসবি না ?
ফোন করে তোকে ভয় না দেখালে তুই কি আসতি মায়ের কাজে ?
তোর তো মনে হয়, মা তোর সাথে আছে সবসময়। কিন্তু দিদিভাই, তোর মা আর নেই রে। একবছর আগেও বিশ্বাস করিসনি। সেদিন মায়ের দেহ নিচে নামানোর পর সেই যে মায়ের কাছে বসলি, আর উঠছিলি না। তোকে সরানো কোন ভাবেই যায়নি, যতক্ষণ না তুই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলি কাঁদতে কাঁদতে।
বলেই ফুঁপিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরল।

বড় মামা হয়তো নিজের ভুল বুজেছে।
নিজের বোন কে কাছে আগলে রাখতে পারলাম না আমরা। তাই তোকে রাখবো কাছে।
কথা গুলো বলতে বলতে মামা খুব কাঁদছিল। পেছনে ছোটমামাও চুপ করে দাড়িয়ে ছিল। ওরা সব্বাই অনুতপ্ত।

গত বছর যখন জানতে পারা গেল, আমার বাবা অন্য কোথাও বিয়ে করেছে, মা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। হাজার হোক, নিজের স্বামী, নিজের প্রথম ভালবাসা। শেষ করে দিল গলায় দড়ি নিয়ে। আমাদের ঐ কোলকাতার ফ্ল্যাটেই।

--

দিদুনের গালে চুমু দিয়ে আমি ব্যাগটা রাখতে গেলাম পাশের ঘরে। আমার কিন্তু এই সবে কোন দুঃখ নেই। কারন আমি জানি আমার মা মরেনি। দিদুন যেটাই বোঝাক, আমার মা আমার ঘরেই আছে, সে চুপ করে থাকে
দরকার পড়লে অল্প কথা বলে। আমার সামনে আসে। যখন ক্লান্ত হয়ে যাই, মা বিছানায় বসে, আমিও মায়ের কোলে মাথা রাখি।
হোম ডেলিভারি খাবার আসে, মায়ের খাবারটাও আমি নিজেই খাই এবেলা ওবেলা করে।

নাহ, খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নিতে হবে
কাল সকালে কলকাতায় ফিরে আবার রোগী চিকিৎসায় নিজের চেম্বারে ঢুকতে হবে যে। মা ঘরে একা আছে।


                                                            -- সমাপ্ত --

Comments