সফরের নাম অন্ধ্রপ্রদেশ
======================
দ্বিতীয় পর্ব – লেপাক্ষী ( প্রথম কিস্তি )
©SamiranSamanta
#অন্ধ্রপ্রদেশ
#Andhrapradesh
#Lepakshi
#লেপক্ষী
ভোর ৪টে ৩০।
সক্কাল সক্কাল অ্যালার্ম বাজিয়ে দিল ঘুমের ১২টা। ঠিক পাঁচটায় আসবে গাড়ি, তার আগে তৈরি থাকতে হবে। লেট হলে স্পট মিস হয়ে যাবে।
কি ব্যাপার ?
এত সক্কালে কোথায় চললাম ?
কোথায় আবার ? লেপক্ষী। রাস্তা মোটে ৩০০ কিমির কম বেশি।
অ্যাঁ ?
হুম, শরীর মন একটু পাগলা গোছেরই ছিল আসলে ঘোরার জন্য। যতই দূরে হোক, হাতছাড়া করা যাবে না। অন্ধ্র ঘুরতে আসার অন্যতম কারনের মধ্যেও এই স্থানটি পড়ে আমার লিস্টে।
খুব সকাল, আবহাওয়া মনোরম। ভোররাতে কাছেই নন্দীর একটা স্ট্যাচু কে চক্কর লাগিয়ে গাড়ি আসতে আসতে শহর ছাড়ার পথে। বেশ কয়েক কিলোমিটার যেতেই পাহাড়ি দৃশ্য ডায়ে বায়ে। আলো আধারি তে দৃশ্য বেশ অন্যরকম সুর টানছে। সিকিমের মত ইঞ্চি বাই ইঞ্চি মাপের রাস্তার ভয় নেই, তবে কিছু বাঁক বেশ।
বনের মধ্যে একটা রাস্তা পড়বে, দুই দিকেই চন্দন গাছের সারি। বেআইনি কারবার রুখতে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম সারি সারি চারচাকার গাড়ি পড়ে রয়েছে বিধস্ত ভাবে। টাটা সুমো, ইনোভা, সেডান এর মত বড় গাড়ি, মাঝখান থেকে সবুজ পাতা গাছ গজিয়ে উঠেছে। দেখলে বেশ লোভ লাগবে।
“ ওগুলো কাদের জানেন ? যারা এই চোরা কারবারে ধরা পড়েছে পাচার করতে গিয়ে, তাদের গাড়ি, কেও ছাড়াতেও আসে না। “, ড্রাইভারদা বলল। চুপ মেরে গেলাম কথাটা শুনে।
মন মেজাজ তিরিং করে লাফিয়ে উঠলো, বাম পাশে দারুন একটা দৃশ্য। পাহাড়ের উঁচুতে কত গুলো ছোট্ট বড় পাথর, নিজেদের সাথে ব্যাল্যান্স করে বসে আছে, ঠিক এক পাশে পড়েছে ঊষার কিরন। দেখলে মনে হবে, কেও হালকা ধাক্কা মারলেই টুক করে গড়িয়ে পড়বে, যদিও সেটা অসম্ভব।
দেখতে দেখতে ঘণ্টা তিনেক কেটে গেছে, রাস্তা শেষ হওয়ার নাম নেই। অগত্যা এক জায়গায় দাড়িয়ে চা নিলাম সব্বাই। ৫ টাকা করে, স্বাদ আমাদের এখানের অত নয়, তার থেকেও বেটার মনে হোল। এটা অবশ্য উরু উরু মনের এফেক্ট হতেও পারে।
হাতে দুটো চিপস এর প্যাকেট নিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম।
চলছে তো চলছেই…গাড়ি
এমন সময় ড্রাইভারদা বলল, রাস্তাটা একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। কথাটা শুনে আমার তো মাথায় হাত। এতক্ষণের রাস্তা যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে ? উনি কি সত্যি জানেন না, তাহলে এলেন কেন ?
“ অনেক বছর এদিকে আসিনি দাদা, বছরে খুব কম লোক আসে এই খানে এত দূরে। সামনের এক দেড় ঘণ্টার রাস্তা একটু জিজ্ঞেস করলেই মনে পড়ে যাবে আমার। “, ড্রাইভারদা বলল।
কথাটা শুনে বুকে জল এলো, সঙ্গে মন খারাপ, কারন রাস্তা এখনও অনেকটা।
ইন্টারনেট তো কাজ করছে না যে ম্যাপ দেখবো, তাই সমস্তটাই ছেড়ে দিলাম ওনার হাতে।
জায়গাটি কর্ণাটক বর্ডারের খুব কাছে, ২০ কিমি মাত্র। মুলত ওখানে কর্ণাটক থেকেই পর্যটক আসে। এত দূর থেকে ওখানে যাওয়ার লোক বছরে ১০টা হবে কি না সন্দেহ। ব্যাঙ্গালর থেকে আসতে চাইলে ১৪০ কিমি দুরত্ত কভার করতে হয়।
হাইওয়ে ছাড়িয়ে গাড়ি দৌড় মারছে। শান্তি পেলাম চোখে যখন পড়ল একটা সবুজ বোর্ড, লেখা রয়েছে “লেপক্ষী ১০ কিমি “।
টানা ৬ঘণ্টা পর সে যে কি সুখের অনুভূতি, সে আর নাই বা বললাম।
অনন্তপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম, রয়েছে রামায়নের সুন্দর গল্প।
রাবন সীতাকে চুরি করেন ও আকাশপথে পাড়ি দেন, সঙ্গে নিজের রথ। সেই মুহূর্তে জটায়ুর চোখে ঘটনাটি ধরা পড়ে, আর সে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় রাবনের সাথে। শেষমেশ আহত হয়ে পড়ে যান জটায়ু। এদিকে রাম ও লক্ষণ সীতা কে খুজতে খুজতে মাটিতে পড়ে থাকা জটায়ুর সাথে আলাপ হয়। সেই মুহূর্তে জটায়ুর অবস্থা খুব করুন। কোন রকমে সমস্ত ঘটনা রামের কাছে খুলে বলার চেষ্টা করেন। রাম সেই মুহূর্তে জটায়ুর অবস্থা দেখে মুখে বলেন, “ লে পক্ষী “, অর্থাৎ পাখী, ওঠো, ওঠো।
সেই থেকেই এই স্থানের নাম লেপক্ষী।
প্রথমেই দেখতে পেলাম একটা বড় আকারের জটায়ু পাখী। অনেকটা ওপরে রয়েছে, নিচে একটা বড় গোলাকার পাথর। আশ্চর্য রকমের নিখুঁত কাজে সম্পূর্ণ এই স্থানে ওপরে ওঠার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পাখীর কাছাকাছি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ, কারণটা দেখলেই বোঝা যায়, পুরোপুরি বিপজ্জনক।
ওপরে পৌঁছানোর সময় ঘাম হয়েছিল, কিন্তু ওপরে যাওয়ার পর শান্তি। শুধু দৃশ্য দেখে নয়, অতো উঁচুতে খুব সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, ফুরফুরে।আমেজ তরি করছে।
বড় বড় পাথরের গোল চ্যাঁই, বসে আছে চুপটি করে। ওপরে দাড়িয়ে বেশ অনেকটা সবুজ জায়গা দেখা যায় এক নজরে, মন ভরে যায়।
মজার ব্যাপার, একটা পায়ের ছাপ রয়েছে, স্বাভাবিকের থেকে একটু বড়। বেশ ইন্টারেস্টিং। জটায়ুর মূর্তিটা এখান থেকে অনেক কাছে, আকারের ভারিত্ত এবার কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
ছিল ছোট্ট একটা মন্দিরের মত স্থান, ভেতরে কোন সময়ে হয়তো বিগ্রহ রেখে পূজা হত। জায়গাটি বেশ সুন্দর। অনেকটা সময় কাটিয়ে নিচে নামলাম।
২০০ মিটার দূরে রয়েছে, ভারতের সব থেকে বৃহত্তম মনলিথিক স্ট্যাচু, নন্দী। পারফেক্ট অনুপাতে তৈরি এই স্ট্যাচু ১৫ ফুট লম্বা, ২৭ ফুট চওড়া। এই স্থান থেকে দূরে থাকা জটায়ু পাখিকে বেশ সুন্দর দেখা যায়, দেখে মনে হয় ওরা সবার অগোচরে নিজদের মধ্যে কথা বলে। নন্দীর স্ট্যাচু যেদিকে মুখ করে রয়েছে , যেন দূরে থাকা নাগলিঙ্গ এর দিক নির্দেশ করছে।
এই মুহূর্তে তাই চললাম বীরভদ্র মন্দিরে, যেটা এখানে আসার আসল ও অন্যতম কারন।
দক্ষরাজার কথা অনেকেই জানেন নিশ্চয়। পার্বতীর সাথে শিবের বিয়ে দেবে না বলে অহঙ্কার। দক্ষযজ্ঞ, শিবের তাণ্ডব আর সেই ক্রোধেই এক ভগবানের উৎপত্তি, বীরভদ্র।
পাঁচটি শিবলিঙ্গের মধ্যে মন্দিরের ভেতরই রয়েছে তিনটি, পাপবিনাশ ঈশ্বর, রামলিঙ্গেসর, হনুমান লিঙ্গ। এছাড়াও রয়েছে ভগবান বিষ্ণু, গনপতি, ভদ্রকালী এর মূর্তি। মেইন মন্দিরে ঢোকার শুরুতেই ডানদিকে , দুর্গামাতার একটি মূর্তি, ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হোল, সেটা খুব পেছনে। অর্থাৎ কেও সামনা সামনি গিয়ে দেখতে একটু অসুবিধে হবে, তাই তার সামনে আয়না এত সুন্দর করে প্লেস করা রয়েছে, সম্পূর্ণ দুর্গা মা অন্য এক রূপ পেয়েছে, প্রতিবিম্বের মাধ্যমে।
মন্দিরের আর্কিটেকচার খুব ইম্পরট্যান্ট, বিশেষত যারা এই সব সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করে। মিউরাল পেইন্টিং তো ভর্তি, ওপর দেওয়ালে। কোথাও রয়েছে অর্ধনারীশ্বর কোথাও অর্ধ শিব অর্ধ বিষ্ণু।
এখানের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, ৮ ফুটের বিখ্যাত ঝুলন্ত পিলার ( হাঙ্গিং পিলার ) , আর এক নাম “অন্তরীক্ষ স্তম্ভ”। নিচের প্রায় এক ইঞ্চি জায়গা বাকি রেখে পুরোটাই ফাঁকা, মাটির সাথে স্পর্শহীন, সত্যি তাই। একটা কাপড় নিয়ে আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, তার ভিডিও করেও রেখেছি। ব্যাপারটা কিন্তু দারুন। কতটা সূক্ষ্ম ক্যালকুলেশন থাকলে এমনটা বানানো সম্ভব, সেটাই ওখানে দাড়িয়ে ভাবছিলাম। দুরদুর থেকে আসে এখানে, শুধুমাত্র এই পিলারের আকর্ষণে।
মন্দিরের পূর্বে রয়েছে আমার পছন্দের সেরা ব্যাপারটা, যার জন্য এত দূরে দৌড়ে আসা। একটি শিবলিঙ্গ, গ্রানাইট পাথরের তৈরি।
ব্যাস এতুকুই ?
তিষ্ঠ বৎস।
শিব লিঙ্গের মাথায় ছাতার মত রয়েছে সাতমুখী সাপের ফনা, তিনটি পাকে লিঙ্গকে আঁকড়ে ধরে আছে। ভারতের সবচেয়ে বড় নাগলিঙ্গ হিসেবে এটিকে ধরা হয়।
এখানে আমার কিছু কথা বলি। বেশ কিছু বছর আগের কথা। নেট সারফিং করতে করতে হঠাৎ করে এই ছবিটা আমার চোখে পড়ে, তখনও জানতাম না এটা আমাদের ভারতেই আছে। খুব ভাল লেগেছিল দেখে, এক প্রকার আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল ভেতর থেকে।
এই বারের ট্যুর প্ল্যান করতে গিয়ে গুগুল আমায় এই ছবিটা দেখাল। চক্ষুচড়ক হওয়ার জোগাড়। ঠিক করলাম, যত দুরেই হোক, আমি যাবই যাবো এখানে। সেই ভাবনা আর এই আসা, দেখেও সার্থক। নিজের চোখে এমন এক প্রকার কাজ, জাস্ট কল্পনার বাইরে। স্কাল্পচারের এত সুন্দর কাজ স্বচক্ষে না দেখলে জীবন বৃথা মনে যেন।
একটা ব্যাপার আমার খুব বিরক্তিকর লেগেছে। কিছু টুরিস্ট এসেছে এই স্থানে, ওপরে উঠছে, আর বড় ছোট ছেলে মেয়ে সব্বাই ঐ গ্রানাইটের অংশে হাত দিছে। জায়গাটি অনেকটাই উঁচুতে। পবিত্র জিনিষ পবিত্র ভাবেই দেখলে ভালো হয়। এই ব্যাপারে ওনারা কিছু স্টেপ নিলে পারতেন। হয়তো নিজের ভাললাগার ওপরে কারোর হস্তক্ষেপ আমার মন খিমছে ধরেছে, এমনটা অনেকে বলতেই পারেন। তবুও মনে করি, একটু বুঝে শুনে স্তাপত্ত্য গুলোর মর্যাদা দিলে ক্ষতি কি ?
এখানে দেখার স্থান গুলোর একটা লিস্ট করছি মোটামুটি।
- জটায়ু
- নন্দী টেম্পেল
- বীরভদ্র টেম্পেল
- হাঙ্গিং পিলার
- মিউরাল পেন্টিং
- অসম্পূর্ণ কল্যান মন্তপ
- বিরাট শিবলিঙ্গ
©SamiranSamanta
Comments
Post a Comment