সফরের নাম অন্ধ্রপ্রদেশ - চতুর্থ দিন

 

সফরের নাম অন্ধ্রপ্রদেশ  
======================

চতুর্থ দিন -
©SamiranSamanta

#অন্ধ্রপ্রদেশ
#ভ্রমন


একটা ব্যপার লক্ষণীয়, এখানে সব মন্দিরগুলো সকাল ১১টার আগে খোলে না শ্রীনিবাস মঙ্গপুরাম এ আজ পৌঁছে গেছিলাম সাড়ে দশটায়। দর্শনের জন্য যখন গেট খোলেনি, খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, আগে অর্থাৎ করোনা এর প্রাক্কালে মন্দির রাত্রি ১২টা থেকে ৩টে পর্যন্ত বন্ধ থাকতো, বাকি সময়টা খোলাই থাকতো ভক্তদের জন্য। গত দিনের আপ্লালয়াগুন্তা এর দিনেও এমনটা হয়েছিল, তখন অতটা ভ্রূক্ষেপ করিনি।




তিরুপতি থেকে ১২ কিমি দূরে শ্রীমঙ্গপুরম এর কাহিনি বেশ সুন্দর। পদ্মাবতী এর সাথে বালাজির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, তিরুমালার দিকে রওনা হন। পথে অগাস্ত মুনির আশ্রমে যাওয়ার কথা স্থির করেন চন্দ্রগিরি পাহাড়ের পাশে স্বর্ণমুখী নদীর পাশে অবস্থিত আশ্রম, খুব শান্ত। মুনির কথায় বালাজি সস্ত্রীক ৬ মাস থাকেন। যাওয়ার সময় বালাজি দুটি কথা দেন।



প্রথম, যারা তিরুমালাতে যেতে পারবে না, পাহাড়ে চড়তে অসুবিধে, শারীরিক কোন রকম সমস্যার জন্য, তারা এখানেই তার দর্শন পাবেন। ( এখানের বালাজির মূর্তি অনেকটাই বড় )

দ্বিতীয়, যারা এখানে “কল্যানউৎসাভম” ( রোজ সকাল ১১টা থেকে সকাল ১২ টা ) দেখেছেন, তাদের জীবনে স্ত্রী ভাগ্য খুব ভাল।
১১টা বেজে ২৫ মিনিটে আমরা দর্শন করে বেড়িয়ে আসি।






পরবর্তী মন্দির অনেকটাই দূরে, সময় লাগবে। রোদ আসতে আসতে মাথার ওপরে উঠেছি। যেতে যেতে “ কানিপাকাম “ এর গল্পটা বলতে শুরু করি।




তিন ভাই একটি সংসারে থাকেন। একজন অন্ধ, একজন কালা, একজন বোবা। জীবনে তো বাচতে হবে, কিছু করতে হবে। একটি জমি কেনে তিনজনে, বিহারাপুর গ্রামের সামনে। জমি চাষের জন্য বন্দোবস্ত করল তিনজনে

শুধু মাটি খুঁড়লে কি চাষ হয় ? জল লাগবে তো। বেছে বেছে তারা এমন একটা কুয়ো পায়, যেটা আগে থেকেই শুকনো। সেটাই খোরা শুরু করে তিনজনে। শারীরিক প্রতিবন্ধিকতা কাটিয়ে, অনেক কষ্ট করেও সেখানে জল পেল না। অনেকটা সময় সেখানে অতিবাহিত হওয়ার পর, ফল মেলেনি। ঠিক তখনই ঘটে অদ্ভুত ঘটনা। খোরা জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসতে শুরু করল জল, তবে লাল রঙের ( আসলেই রক্ত )। তার ঠিক পরপর তিন ভাই এর সমস্যা সমস্তটাই ঠিক হয়ে যায়। গ্রামবাসীদের কানে কথা যেতে বেশি সময় লাগেনি। সব্বাই যখন এখানে এসে ভিড় করে, তখনই ঐ স্থান থেকে প্রকট হন, “ বিনায়ক “ অর্থাৎ গণেশজি।
সেই থেকে এই জায়গায় তার পূজা হয় জাকজমক করে।





গণেশজি রয়েছেন সবার মাঝে, তাকে ঘিরে চারকোনা আকারের পুষ্করিণী। এখানে নাকি সমস্ত পাপ নাশ হয়, অর্থাৎ ভক্ত চাইলে ক্ষমা চাইতেন পারেন গণেশের কাছে। এর একটা নির্দিষ্ট প্রকার রয়েছে।
ঠাকুর যেদিকে আছেন তাকিয়ে, তার পিছনের অংশে গিয়ে খালি পায়ে হাতে মাথায় জল ছড়িয়ে নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে, বলতে হবে সেই ভুল যেন আর দ্বিতীয়বার না হয়। বিনায়কের সামনে এসে তারপর দাড়িয়ে নমস্কার, মোটামুটি এই রকম প্রথা। ওহো, এখানে এসে অনেক বিবাদের মীমাংসা করা হয়। কেও বা কারা যদি এখানে দাড়িয়ে কাউকে কোন কথা দেন, বা পালন করবেন বলে থাকেন, তাহলে সেটা লিখিত দলিলের থেকেও বেশি মান্যতা পায়।




আসল কথাটা বলি ?
কানিপকম এ নেমে আমরা ফ্রি দর্শনের লাইনে দাঁড়ালাম। মিনিট তিরিশ পর দর্শন না করেই ফিরে এসেছিলাম। এত দূর গেলাম অথচ দর্শন করলাম না ? একি বলছি ? হ্যাঁ ঠিক বলছি।
মন্দিরের মূল দরজার সামনে যাওয়ার পর ভেতর থেকে বড্ড শব্দ আসছিল। উঁকি মেরে দেখলাম, জে সি বি ঢোকানো, কাজ চলছে। শান্তি বিঘ্ন হছে।
গণেশ এর আমি বড্ড ভক্ত, কিন্তু কেন যেন ওখানে আমার মন লাগল না।
মুখ শুকিয়ে ফিরে চলে এসেছিলাম। মনে মনে অনেকটা কিছু ভাবলেও, কিছু করার নেই।

এবার লাঞ্চ করতে হবে। মন ভালো নেই, তার জন্য পেট কে কষ্ট দেবো কেন ?
এই মুহূর্তের যাত্রা আপাতত তামিলনাড়ুর দিকে।

“অন্ধ্রা স্পাইস“ রেস্টুরেন্ট এর কথা না বললেই নয়। অনেক দিন পর একটা দারুন লাঞ্চ হল।আসলে ভালো করে ননভেজ খাবার পেলাম, শহরের বাইরে।




হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, পাঞ্জাবি চিকেন কষা  একদম পারফেক্ট কম্বিনেশনে নেওয়া হয়েছিল। বাইরে মেঘলা আবহাওয়া হয়েছিল আগে থেকেই। তারপর থেকেই গুরু গুরু বর্ষণ হয়ে চলেছে। পেটে বিরিয়ানি , মুখে মৌরি, আকাশে বৃষ্টি অসাধারণ ব্যাপার।




তামিলনাড়ুতে হাইরোডে ঢোকার আগে কার পারমিট এর একটা কাজ থাকে। ড্রাইভারদা সেই কাজটা সেরে এসে বললেন, চলেন এবার স্বর্ণমন্দির।
ছোট্ট তথ্য দিতে চাই।
আমরা অনেকেই কথায় কথায় লক্ষ্মী নারায়ন বলে থাকি। কথাটা সঠিক ভাবে বললে, “ লক্ষ্মী নারায়ণী ” বলা হয়, যার মানে লক্ষ্মী।
“ বিষ্ণু নারায়না “ মানে, নারায়ন।
স্বর্ণমন্দিরটি প্রধানত লক্ষ্মীমাতার, আর এক নাম “ নারায়ণী মন্দির “




“ স্বর্ণমন্দির “ শব্দটা শুনলেই অমৃতসরের কথা মনে পড়ে না এমন মানুষ নেই। অথচ এখানে এত সুন্দর একটা মন্দির রয়েছে, জানা ছিল না আমার। ম্যাপে মেপে দেখলাম, হু যাওয়া তো যায়।
অন্ধকার হতে তখনও ঘণ্টা দেরী। ভীর তেমন নেই, কিন্তু নর্মাল দর্শনের জন্য অনেকটা সময় লাগবে। অগত্যা সব থেকে কম দামের টিকিটটি কাটলাম, ১০০ টাকার। একটা কথা না বললেই নয়, ভগবান দর্শনের জন্য টিকিট কাটতে হয়। ( যদিও এটা চলে আসছে অনেক আগে থেকে, আমি বলার কেও নই ) কেউ কাটে বেশিদামের, কেও বা কম দামের। সেই অনুযায়ী তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়, দর্শনের দিকে। ঠাকুর দর্শন করবে, তাতেও তাড়াহুড়ো, তার জন্য টিকিট, যাতে স্পেশাল ভাবে আরও কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। এই পথে আমিও হাঁটলাম ঠিকই, মন সায় দেয় না।



গাড়িতে সমস্ত কিছু রেখে হাঁটা লাগালাম মন্দিরের পথে। চেকিং পেড়িয়ে এগিয়ে চললাম, প্রায় ফাঁকা বললেই হয়।
শুরুতেই একটি স্থানে পূজাঅর্চনা চলছিল। পূজাতে নিয়ে আসা হয়ে ছিল, একটি ঘোড়া, একটি গরু, একটি হাতি। আমরা যখন ছিলাম, হাতিকে নিয়ে ওদের কিছু নিয়মাবলী চলছিল
বেশ সুন্দর লাগছিল, যখন হাতি পুরোহিতদের কথা শুনে শুনে কাজ করছিল। ঠিক তারপরই গোটা একটা আনারস দিতেই, পুরোটা মুখে নিয়ে নিল হাতিটি। আমিতো বেশ অবাক। মহে হছিল, দাড়িয়ে থাকি ওখানে। কিন্তু অন্যদিকে তো যেতে হবে, অন্ধকার হতে আর বেশি বাকি নেই।




পাথরের রাস্তায় জল জমে রয়েছে। পাশে মারবেল এর রাস্তা বেশ স্লিপ করছিল
বেশ অনেকটা হাটার পর, বামদিকে গনপতির মন্দির। সম্পূর্ণটা রুপো দ্বারা তৈরি। “কানিপকম “ এর মন খারাপটা অনেকটাই এখানে কেটে গেছে। লাইনে আসতে আসতে গিয়ে, মাথার ওপর ঘণ্টাটা তিনবার বাজিয়ে, প্রবেশ করলাম। মন ভরে বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দেখলাম। অন্য সময় হয়তো এতোটা ভালো করে দেখা হয় বলে মনে হোল না।

বাইরে বেড়িয়ে বাধানো এক প্রকার রাস্তায় উঠলাম। ওপরের অংশও বেশ ছায়া করা। কোথাও আলোর কাজ, কোথাও টালি দিয়ে সুন্দর করে গোছানো। রোজ পরিস্কার পরিছন্ন চলে, দেখেই বোঝা যায়। হাঁটা রাস্তা মিনিট দশেক, খুব ভালো লাগছিল। ঘুরে ঘুরে চোখের সামনেই , স্বর্ণমন্দির দেখছি, আসতে আসতে কাছে আসছি। ইনস্ট্যান্ট ফটো, লাড্ডু , মন্দিরের ছবি এরকম অনেক ধরনের কাউন্তার রয়েছে এই পথে।
মন্দিরের গণ্ডী তে পৌঁছানোর পর, কি বলবো। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। এবার বুঝলাম, কলেজস্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক কাদের দেখে অনুকরন করত এত দিন। সাউথ সিনেমার সাথে সাউথ এর মন্দির, তখন জাস্ট এই কথাটাই মাথায় এসেছিল।
এত অপূর্ব কাজ, এতোটা সুন্দর, বলে প্রকাশ করা যাবে না। সোনার ওপর আলো পড়লে এমনিতেই চকমকানিতে মন ভরে যায়। এটা তো একটা বড় মন্দির, চারিদিকে পরিকল্পিত ভাবে আলো দেওয়া, বিভিন্ন কোনে।





বিগ্রহ সহ সমগ্র স্থানটি একটি জলাশয়ের মাঝখানে রয়েছে। জল অল্প পরিমানে রয়েছে, দেখতে বেশ লাগছে। কত কত পয়সা পড়ে রয়েছে, তার ঠিক নেই। এখন সম্ভবত মানা করে দেওয়া হয়েছে, এমন ভাবে টাকা পয়সা ফেলার বিরুধ্যে।
সোনালি রঙের পাখী, সিংহ এর মূর্তি রয়েছে মন্দিরে, দারুন কাজ গুলো।
ঠাকুর দর্শন সম্ভব হোল জল বেষ্টিত পরিখা ঘুরে আসার পর।

একটি গরু ওখানে রয়েছে, সম্পূর্ণটাই রূপাতে তৈরি। ফেরার পথে লক্ষ্মী ঠাকুরের একটি মূর্তি রয়েছে, পূজিত হয়। সেটাও দর্শন করতে ১০টাকা লাগে। বিগ্রহ আসলে ৭০ গ্রামের সোনা দিয়ে তৈরি। কিছু ভক্ত, দূর থেকে দাড়িয়ে অনেক্ষন ধরে দেখে যাচিল। এই দেখে পুজারি চিৎকার করে, ওদের ভাষায় কিসব বলল জানিনা, তবে সারমর্ম এটাই, টিকিট কাটুন সামনে আসুন।
ভাবনা চিন্তা অদ্ভুত, কিন্তু কিছু বলার নেই। কে কথায় দাড়িয়ে ঠাকুর দেখবে, সে টাকা দিতে ইছুক কিনা সেটা তো তারই ব্যাপার। যাকগে, পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে চলে এলাম আমি, ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। আমার বাংলা ওখানে কোন কাজে আসবে না। 

ঐ স্থানটি বেড়িয়ে আসার পথে, যেদিকে গনপতি ছিলেন, তার ওপর পাড়েই রয়েছে ভেঙ্কটেশ এর বিশাল বড় মূর্তি। আমরা যখন গেছিলাম, সবে মাত্র সন্ধ্যাআরতি শেষ হয়েছে। সম্পূর্ণ সামনে গিয়েই দর্শন করতে পেরেছি। সত্যি কথা বলতে, এখনও পর্যন্ত এই মন্দিরের বালাজির হাইট সব থেকে বেশি মনে হয়েছে।
এখানে প্রতিটা জায়গা বেশ পরিস্কার পরিছন্ন দেখলাম। বাবু হয়ে কেও যদি যেখানে সেখানে বসেও পড়ে, কোন অসুবিধে হবে না। অনেকটা বড় জায়গা ঘিরে তৈরি হয়েছে এই মন্দিরের চত্বর।

একটা কথা হাড়ে হাড়ে বুজেছি, এখন বলেই এত ফাঁকা পেলাম মন্দির। এটা যদি আগে হতো, তাহলে এত ভালো করে দর্শন, অসম্ভব। এত খোলামেলা ভাবে ঘোরা, নিশ্বাস নেওয়ার সময় থাকতো কি না সন্দেহ, পেছনের ভক্তদের ঠেলায় এগিয়ে যেতে হতো।

যারা এখান থেকে কিছু কিনতে চান, ব্যাবস্থা রয়েছে, জোর করে।
জোর করে কেন বললাম ?
ফেরার রাস্তাটা এমন ভাবে করা হয়েছে, বিভিন্ন শপে ঢুকতেই হবে। ওখান থেকে ঢুকে তারপর আবার বেড়িয়ে আর একটা শপ। কারোর ইছে থাক না থাক, ওখানে ঢুকলে মন অন্য রকম হয়ে যেতেই পারে।
সমস্ত দাদাদের উদ্দ্যেসে বলি, মন্দিরে ঢোকার আগেই মানি ব্যাগটা কাউন্তার এ রেখে আসবেন, অথবা গাড়িতে ফেলে আসবেন। কারন, মানিব্যাগ যদি থাকে, দিদি বা বউমনি যদি সেটা টের পায়, শেষ। যেকোনো একটা শপে আপনাকে দাড়াতে হবেই, বধ হয়ে যাবেন, কনফার্ম।
এত নিশ্চিত কেন ? এই আমাকেই দেখুন।



সামনে একটা দুর্গ মত ছিল, সঙ্গে আর একটা মন্দির। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, তাই ওদিকে আর নামিনি। সি এম সি এর গেটটা দেখলাম। এখানেই ডাক্তার দেখাতে মানুষজন আসে দরকারে।



অনেকটা রাত্রি হবে আজ ফিরতে, তামিলনাড়ু চেকপোস্ট ক্রস করে, অন্ধ্রপ্রদেশ ঢুকতে সময় লাগবে বেশি। তারপর রাতের খাওয়া।
বাকি কথা, আবার পরের পোস্টে।      

 

আজকের দর্শনীয় স্থান -
- শ্রীনিবাস মঙ্গপুরাম
- কানিপাকাম
- নারায়ণী মন্দির


©SamiranSamanta


Comments