©SamiranSamanta
#অন্ধ্রপ্রদেশ
#Andhrapradesh
সকাল ৮টা।
বিছানায় শুয়ে রয়েছি, এখনও বেশ টায়ার্ড। কাল রাতে ফিরতে ফিরতে ১০টা পার হয়ে গেছিল।
একদিনে লেপক্ষী দেখে আবার হিলস, মোটের ওপর ৬০০ কিমির বেশি জার্নি এক দিনে, জাস্ট
ভাবা যায়না যদিনা ঘোরার ভূত মাথায় চাপে। রুমে ফিরে কোন রকমে ফ্রেস হলাম। খেতে
যাওয়ার কথা মাথায় থাকলেও শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছিল। এক ঘুমে সকাল।
আগে থেকেই জানতাম এমনটা হওয়ার ছিল, সেই প্ল্যানিং করা থেকেই মাথায় ছিল। তাই আজকের
শিডিউল এ রেখেছিলাম লোকাল ভিসিট। তবে সেখানেও রয়েছে দারুন একটা মন্দিরের ভিজিট,
বেশ রহস্যময়।
৯.৪৫ বেজেই গেল, রুমে চাবি মেরে গাড়িতে উঠেই, “ গুড মর্নিং “
প্রথম ঠিকানা, আপ্লালয়াগুন্তা।
বালাজি ভগবান এর একটি ছোট্ট গল্প এখানে রয়েছে। ( যারা পুরো গল্প জানেন না, কমেন্ট
করে বলুন। সম্ভব হলে শুধু গল্পটা নিয়ে একটা আলাদা পোস্ট করবো )
বরাহস্বামীর কাছ থেকে অনেক টাকা ধার হিসেবে নিলেন বালাজি, সঙ্গে ইন্টারেস্ট দেবেন।
এবার সমস্যা হোল, বালাজি কীভাবে টাকা উপার্জন করবেন, কেই বা তাকে কাজ দেবে ? টাকা উপার্জন
না হলে সে ঋণ শোধ করবে কি করে ?
অনেক রাস্তা ঘুরে উনি চলে আসেন আপ্লালয়াগুন্তা নামক গ্রামে।
হাঁটতে হাঁটতে আসার সময় খিদে পেয়ে যায়। এই মুহূর্তে বালাজি ভগবান মনুষ্যরূপ ধারন করেছে, তাই মানুষের মতই সমস্ত ব্যাপার তার সাথে ঘটছে। সঙ্গে পয়সা নেই, কোথায় খাবে ?
একজন মহিলা কে দেখতে পান, ওনাকে বলেন, কিছু খেতে দিতে। আর প্রথমেই বলে ফেলেন, তার কাছে কিন্তু কোন পয়সা নেই, কিছু দিতে সে এখন পারবে না।
মহিলা নিজেও গরিব ছিলেন। কিছুটা সময় একটু ভেবে, মহিলা মনুষ্যরূপী বালাজি কে খেতে দেন রুটি। বালাজি সেটাই খুব সন্তুষ্ট হয়ে যত্ন করে খেয়েছিলেন।
তিরুমালায় পরবর্তী কালে উনি দেবতা রূপে পূজিত হওয়ার পর অনেকের কাছে এই স্থানের আসল কথা প্রকাশ্যে আসে। তখন থেকেই এখানে ওনার একটি বড় মূর্তি পূজিত হন।
তুলসি পাতার বড় বড় বাণ্ডিল মন্দিরের সামনে বিক্রি হছিল। দিন দুয়েক ধরে মুড়ি খুজছিলাম, বাঙালি মানুষ তো। কত দোকান খুজেছি, কিন্তু বোঝাতে আর পাছি না আমি কি চাইছি। “ মুড়ি “ শব্দটাই ওদের অজানা। ওখানে তো তেলেগু চলে। এই মন্দিরের সামনে কিন্তু মুড়ি পেয়েছি। জিজ্ঞেস করে জানলাম, “বুরগুলা” মুরির তেলেগু সংস্করণ।
মন্দিরের ব্যাপারে তেমন ভাবে কিছু বলার নেই। তবে যে সময়ে আমরা গেছিলাম, তখন পূজা অর্চনা শেষের পথে। একটি ভীর হয়েছিল বইকি। আসতে আসতে সকল ভগবান কে দর্শন করলাম।
আধাঘণ্টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়লাম যখন, রোদ মাথার ওপরে। প্ল্যানিং ঠিকই ছিল, কারন এর পরের স্থান একটি ফলস, কইলাসকোনা।
ফলস এ যাওয়ার পথে ঘন স্টেপ এর অনেক সিঁড়ি। গাছগাছালি আর সিঁড়ির কোনায় রয়েছে, বান্দর। এখানেও তারা সপরিবারে বিরাজমান, অনেক গুলো ফ্যামিলি যদিও।
যাওয়ার পথে ডানদিকে পড়ে পিঁপড়ের বড় ঢিবি, পূজা করা হয়।
এদিকে লোকজনের আতাগম দেখে বুঝলাম, সব্বাই রেডি হয়েই এসেছে স্নানের জন্য। হুম, সামনে গিয়ে দেখলামও তাই।
পুলিসি তৎপরতায় হুইসেল বাজিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে চার পাঁচ জন কে পাঠিয়ে দেওয়া, স্নানের জন্য। একটা ব্যাপার খারাপ লাগল, জায়গাটা বেশ নোংরা। ঐ যে বলে না বসতে দিলে শুতে চায়, এখানে সেই অবস্থা। ওপরে যারা স্নান করছে করুক, নিচেও সংখ্যার আধিক্য অনেকটা বেশি। সাবান শ্যাম্পু গায়ে, এতোটা পর্যন্ত তাও সহ্য করা যায় ( প্রকৃতির সৌন্দর্যে স্নান করতে এলে, আমার মতে ঝরনার শুধু জলটাই যথেষ্ট )। কিন্তু সেইগুলোর খাপ, প্লাস্টিক, ছেরা ওখানে ফেলছে। জল যেখান থেকে বয়ে নামছে নিচে, তারই বাকে বাকে জমছে প্লাস্টিকের যতসব আবর্জনা, ছেড়া কাপড়, আর বাকি কিছু নাই বা বললাম।
পুলিশের অনেক লোক সেখানে উপস্থিত রয়েছে, কিন্তু এই ব্যাপারে ওনারা কেন সক্রিয় নন, বলতে পারবো না।
একটু হলেও এই নোংরামো আমার মন ভার করে দিয়েছিল ওখানে।
মন ভালো কি করে করা যায় ?
নাহ, লাঞ্চটা সেরে ফেলি।
তবে এরপরই যেখানে ঢুকবো, সেটা ছোট্ট
একটা গ্রাম। প্রচণ্ড রকমের রহস্য ঘেরা তথ্য রয়েছে। পরিচিতি সবার কাছে তেমন ভাবে
পায়নি, অথচ বড় বড় ফিল্মস্টার, বড় মাপের লোকজনের আসা যখন তখন লেগেই রয়েছে, কিন্তু
কেন ? কি আছে এখানে ? তিরুপতি এয়ারপোর্ট থেকে ১৭ কিমি দুরত্তে এই গ্রামের নাম গুডিমাল্যাম।
“গুডি“ অর্থাৎ টেম্পেল “মাল্যাম” মানে আন্ডারগ্রাউন্দ, এক কথায় মাটির নিচের মন্দির, প্রায় ৬ ইঞ্চি ভেতরে। পরশুরাম এর নামে এই মন্দির, ২৬০০বছরের পুরানো।
গ্রানাইট ব্লকে তৈরি আসল মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে রয়েছে বেশ কিছু বিগ্রহ , দেবসেনা সুভ্রাম্নয়, মা আনন্দাবালি, সূর্য ভগবান। রহস্যের ব্যাপারে পরে আসছি। আগে বলি, আসল বিগ্রহের কথা।
ব্রম্ভা, বিষ্ণু, মহেশ – এই তিনজনের মধ্যে একবার তর্ক বিতর্ক জুড়ে যায়, তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। অনেক ঝামেলার পর, স্থির হয়, শিব সর্বশক্তির অধিকারী, বিষ্ণু ঠিক তার পরের স্থানে, আর তারপরে ব্রম্ভা।
এই মন্দিরের পাথরের স্থান পেয়েছেন তিন শক্তি, এক সাথে “ ত্রি মূর্তি” নাম নিয়ে ।
সিঙ্গেল পাথর “ একা-শিলা” নামে পরিচিত, এই পাথরের সবচেয়ে ওপরে রয়েছেন শিব, পুংলিঙ্গের আকারে (ভারতে সর্বপ্রথম শিবালয় কিন্তু এই মন্দিরটাই ), তার নিচে বিষ্ণু “পরশুরাম“ অবতারে এবং সবথেকে নিচে ব্রম্ভা “যক্ষের” রূপে।
তিন শক্তি একত্রে একই স্থানে, এই প্রথম দেখলাম।
মন্দিরে ঢুকে রাস্তা মাটির বরাবর একটু ঢালু। মনে হয়েছিল কোন প্রবেশদ্বারে ঢুকলাম মাটির নিচে। অনুভূতি একটু অন্যরকম। আমাদের দুজন কে দেখে ওখানে বসা পুরোহিত মশাই নাম গোত্র জেনে পূজা দিয়ে দিলেন।
প্রতি ষাট বছরে চমৎকার ঘটনা ঘটে।
স্বর্ণমুখী নদীর জল এই স্থানে চলে আসে, আর বিগ্রহের মূর্তি কে স্পর্শ করে। ৪ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল গ্রামবাসীরা।
এর থেকেও আরও একটা ঘটনা যেটা ঘটে প্রতি বছরে।
সূর্যদেবতা নিজের কিরন সর্বপ্রথম এই পাথরের চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ নেয়, তারপর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি ঘটে সূর্যের উত্তরায়ন থেকে দক্ষিণায়ন ঘটার সময়কালে ( ভূগোলে কত আগে এইসব পড়েছি )।
ঠিকরে আলো পড়ার সময় আমরা পৌঁছে ছিলাম মন্দিরে। ঢোকার মুখেই একটি ষাঁড় কে বেঁধে রেখেছে। ওকে খাওয়ালে পুণ্যি মেলে, সেই জন্য সামনে খাওয়ার রাখা আছে।
সেই জায়গাটা ঠিক পেরোনোর পর বামদিকে একটি পাথরের ফলকে লেখা মন্দিরের ব্যাপারে। সেটায় হুমড়ি খেয়ে প্রায় দুটি ছেলে রয়েছে, একজনের হাতে খাতা। ইংরেজি লেখা প্র্যাকটিস করছে মনে হোল। শৈশব, কত সুন্দর না ? দেখে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম আমি।
মন্দিরটির রহস্যময় তথ্য খুলছি এবার।
আন্ডারগ্রাউন্দ এ বিগ্রহ তো রয়েছেই, কিন্তু গ্রামবাসীরা মনে করে, এই মন্দিরের নিচে আরও একটি স্থান রয়েছে, সিক্রেট চেম্বার। সারা মন্দির জুড়ে নয়টি পাথর রয়েছে, যার পিছনে নয়টি প্যাসেজ। প্রতিটা প্যাসেজ মন্দিরের একদম নিচে, সিক্রেট চেম্বারের দিকে মিলিত হয়। মন্দিরের দেওয়ালের সাথে মিশে রয়েছে সেই নয়টি পাথর, চৌকো গ্রানাইটের হাজার হাজার পাথরের মধ্যে। আর্কিটেকচার এর দিক থেকে কিছু পাথর এমনও আছে, যেগুলো অপ্রয়োজনীয় ভাবেই একটার ওপর একটা রাখা, কারণ অজানা। গ্রামবাসীদের দাবী, তারা একটা পাথর খুঁজে পেয়েছে, যেটা সরালেই ভেতরের রাস্তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সেটা দেখা অবশ্য আমার হয়নি।
বিগ্রহের পাথরের লিঙ্গ এর শেপ সম্পূর্ণ পুরানো যুগের, পুরুষাঙ্গর মত, সর্বপ্রথম লিঙ্গ এর আকার। পরবর্তী সকল লিঙ্গ এর অনুকরনে অদলবদল করে বানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হোল, বিগ্রহের পাথরের মেটারিয়াল টা কিসের, তা আজও কেও জানে না। কত জিওলজিস্ত এলেন, একটাই কথা, এই পাথর পৃথিবীর কোন পাথরের সাথে মিল খায় না। কিছু এক্সপার্ট বলেন, এটা সম্ভবত উল্কাপাতের ফলে ঘটেছে, বাইরের গ্রহ থেকে পাথর টা এসেছে।
পাথরটা তো শিব নিয়ে এসেছেন, উনি কি বাইরের কোন গ্রহে থাকতেন ? তারমানে উনি কি... না না, আমি তর্ক বিতর্কে যেতে চাই না।
শিব পুরাণের ১৯ নম্বর চ্যাপ্টারে বলা রয়েছে, শিব যেখানে থাকতেন সেই জায়গা খুব সুন্দর এবং চকচক করত। সেখানে প্রচুর ভিন্ন ধরনের জিনিষ রয়েছে ( বঙ্গানুবাদ করতে ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী ) তারমানে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং।
মন্দিরের ভেতরে ঢোকার আগে একটি বড় থাম আকৃতি কে কেন্দ্র করে ঘুরে ঘুরে স্থানটি দেখতে হয়। ওপরের ছাদের অনেক অংশ ফাঁকা, সূর্যের আলো ঢোকার জন্য। ছবি দিতে পারছি না বলে বোঝাতে পারবো না, তবে আমার কিন্তু সম্পূর্ণ ঐ ভেতরের স্থানটি একটা স্পেসশিপ এর মতই লাগল।
লিঙ্গ সর্বশক্তির অধিকারী। রকেট এর লম্বা অংশটি তেও সমস্ত শক্তির আধার রাখা হয়। কোথাও বেশ মিল রয়েছে দেখছি।
সূর্যের কিরনের সাথে ঐ দ্বার খোলার একটা কানেকশন আছে নিশ্চিত। আরও অনেক নিখুঁত কিছু ব্যাপার রয়েছে, সমস্তটা বললে পরের গুলো আর বলা হবে না। মোটের ওপর আজকের দেখা সেরা মন্দিরের মধ্যে একটি।
নিঝুম, চুপচাপ একটি গ্রাম, মানুষজন একদম সিদেসাধা, দেখেই বোঝা যায়। অথচ এমন জায়গায়, এত বড় একটা রহস্য। লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে রয়েছে দারুন একটি আশ্চর্য মন্দির।
এর পর চলে এলাম পদ্মাবতী আম্মাবারি মন্দির। বিরাট বড় মন্দির।
এখানে টিকিট অনলাইনেও কাটা যায়। তবে আমি গিয়ে ফ্রি দর্শনে লাইন দিয়েছিলাম। নাহ, তেমন সময় খুব লাগেনি। একদিকে তুলাযন্ত্র, মানষিক পূরণের জন্য রয়েছে। কয়েকজন মা বাবা তার সন্তানের ওজন করাছেন। একটা ব্যাপার ভালো লাগল, ওখানের পরিবেশটা বেশ সুন্দর। যেটা হাসি পেলো দেখে, স্পেশাল দর্শন এ যারা এসেছেন, ভেতরে ঢোকার পর ফ্রি দর্শন এর লাইনের সাথে মিলে মিশে একাকার।
মন্দিরের বাইরে বেশ কেনাকাটার জিনিষ রয়েছে। একদিকে সিন্দুর, চুড়ি অপর দিকে তন্ত্রবিদ্যার জিনিষপাতি, যেমন পাখীর শুকনো মুণ্ডু, নখ, পালক, হাড্ডি আরও অনেক কিছু।
বেশ ভয়ানক কিন্তু জমজমাট একটা পরিবেশ। হই হুল্লোড়ে পূর্ণ করে এখানে কেনাকাটা ভালই হয়। ও হ্যাঁ, ফ্রি লাড্ডু পেয়েছি এখানেও। তবে ওটার স্বাদ আগের থেকে বেটার না, ঘি যেন বেশি মনে হোল।
বেশিক্ষণ থাকতে আর ইছে করেনি আজকে, এমনিতেই টায়ার্ড। গাড়িতে উঠে পৌঁছে গেলাম শেষ ডেস্টিনেশেন, ইস্কন এর মন্দির।
“ইস্কন“ শব্দটাই আলাদা মাত্রা বহন করে সবার কাছে। মন্দিরে গেলাম প্রায় সন্ধের মুখোমুখি। আলো রঙবেরঙের জ্বলছিল, বেশ মজার লাগছিল দেখতে। মাঝে মধ্যে ভাবছিলাম, মহম্মদ আলি পার্কের প্যান্ডেল না তো ?
একদম ওপরে রয়েছে কৃষ্ণ ও রাধার বিগ্রহ, সঙ্গে সখীরা। মাথার ওপরের ছাদে রয়েছে কৃষ্ণের বিভিন্ন সময়ের চিত্রকথা। দিনের শেষে ওখানে গিয়ে বসে থাকলে ক্ষতি নেই। মন প্রান জুড়িয়ে যাবে, ভেতরে ধ্বনি উঠবে, “ কৃষ্ণ কৃষ্ণ “।
আজকের দর্শনীয় স্থান -
- আপ্লালয়াগুন্তা
- কইলাসকোনা ফলস
- গুডিমাল্যাম মন্দির
- পদ্মাবতী আম্মবারি মন্দির
- ইস্কন
©SamiranSamanta
Comments
Post a Comment