সফরের নাম অন্ধ্রপ্রদেশ - প্রথম পর্ব

                                                    ======================

                                                     প্রথম পর্ব – তিরুপতি মন্দির

                             ====================
©SamiranSamanta

#অন্ধ্রপ্রদেশ
#তিরুপতি


কোলকাতার আবহাওয়া তখনও বেশ খারাপই, তৃতীয় ঢেউ ভাগ্যক্রমে আসেনি এখনও পর্যন্ত। ডবল ভাক্সিনেসন কমপ্লিট অনেক আগেই, কিন্তু ভেতরে একপ্রকার ভয় কাজ করছে। সমস্ত কিছুকে ম্যনুপুলেট করেও যখন কিছু আসছেনা মাথায়, মনে ঠাকুরের নাম করে বেড়িয়ে পড়লাম, বালাজির স্মরনে।




ভারতের হিন্দু তীর্থগুলির মধ্যে অন্যতম বিত্তশালী, তিরুপতির মন্দির। তেলেগু ভাষায় “ তিরু “ অর্থ – লক্ষ্মী, “পতি” অর্থ স্বামী অর্থাৎ লক্ষ্মীর স্বামী তথা বালাজি রয়েছেন এই মন্দিরে।  এই স্থানটি “তিরুমালা – তিরুপতি দেবস্থানম” (TTD) নামেও খ্যাত। অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তর জেলায় অবস্থিত এই মন্দির তিনটি প্রাকারে ঘেরা, যথা – সম্পাঙ্গি, বিমান ও বৈকুণ্ঠ প্রদক্ষিণ করে মূল মন্দির।




হাওড়া ট্রেনে উঠেছিলাম বিকেল ৪টে ১৫ তে। ভুবনেশ্বর, চিলকা ক্রস করতে বড়োজোর ঘণ্টা সাত লেগেছিল। তারপরই কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ এ ঢুকে গেলাম, আর মাত্র ১৯ ঘণ্টা। হ্যাঁ মাত্র বললাম, কারন অন্ধ্রপ্রদেশ প্রচুর বড় একটা এরিয়া। ম্যাপে দেখে যেদিন ঠিক করছিলাম, সেদিনই নতুন ভাবে দেখে বুঝেছিলাম। আর ট্রেনজার্নি তে টের পেলাম হাড়ে হাড়ে। রাতের বেলা থেকেই বৃষ্টি শুরু, সফরের সাথে। ট্রেন এর দ্বিতীয় টায়ার এ শুয়ে শুয়ে জানলার কাচ যতটা দেখা যায়, দেখছিলাম, যদিও অন্ধকার আর ছিটেফোঁটা জল ছাড়া মেলেনি কিছুই। ভোর ৫টায় বিশাখাপত্তনম, মিনিট কুড়ির বিরতি। তারপর ট্রেন যে পথে এলো সেই পথেই ফিরে যেতে শুরু করল। ব্যপারটা বেশ মজার, আসলে ঐ স্থানে ইঞ্জিন পালটে নতুন পথ ধরানো হয়, যেটা উলটো দিকেই ফেরত যায়।



তিরুপতি গেলাম রাত্রি ৮ টা হবে। পরদিন দর্শন ছিল, বেলা ১ টায়
দর্শনের টিকিট আগে থেকে অনলাইনে কেটে রেখে ছিলাম। আমরা ছিলাম তিরুপতি বাস স্ট্যান্ডের কাছেই। গাড়ি পেতে অসুবিধে হয়নি।
দর্শনের জন্য বাসে গেলে ৬৫ টাকা ভাড়া, সময় একটু বেশি। তবে আমার মতে প্রাইভেট কার করে নেওয়া ভালো। মন্দির দেখে ওখানের সাইড সিয়িং করে আসতে চাইলেও ওরা সেটা করিয়ে দেয়, তাই আগে গাড়ির সাথে টাকা পয়সার কথা বলে রাখাই ভালো

মন্দিরটি অনেকটা ওপরে, মাঝে একটা চেকপয়েন্ট পড়ে, জায়গার নাম সম্ভবত আলিপিরি। সেখান থেকে মন্দিরের ওপরের অংশের এক ঝলক দেখা যায়, সবুজের মাঝে একটি উজ্জ্বল হয়ে দাড়িয়ে। চোখে পড়া মাত্র মনটা ভরে যায়, “ গভিন্দা গভিন্দা “।
প্লাস্টিক ব্যাগ বা বোতল কোনোভাবেই এখানে নিতে দেওয়া হয় না। চেকপয়েন্ট আসা মাত্র প্রতিটা দর্শনার্থী কে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হয়। ছেলে মেয়ে আলাদা ভাবে চেক করে, গাড়ি পুরো চেক করা হয়। টিকিটের প্রিন্ট চেক করে দেখা হয়, যদি সব ঠিক থাকে তবেই মন্দিরের দিকে পাঠানো হয়।




গাড়ি পথে মন্দিরে যাওয়ার সময় এই রাস্তা বেশ উপভোগ্য। সম্পূর্ণটাই পাহাড়ি ওপরের দিকে যাওয়ার রাস্তা, এক পাশে সম্পূর্ণ বন। স্পীড লিমিট রয়েছে, তার কারন বন্য পশু পাখী যখন তখন রাস্তায় চলে আসতে পারে। ড্রাইভারদার কথা অনুযায়ী, আমাদের যাওয়ার দিন তিনেক আগে তিনটে লেপার্ড কে ফুটেজ ক্যামেরায় কাছাকাছি দেখতে পাওয়া গেছে। কথাটা যেমন রোমহর্ষক, সেই মুহূর্তে গাড়ির ভেতরে থেকে ভাবতেই এক প্রকার আলাদা অনুভূতি কাজ করেছিল





রাস্তায় মাঝে মধ্যে বামদিকে, তিরুপতি শহরটি কে এক ঝটকায় দেখা যাচে, বার্ডস আই এর মত, অপূর্ব সে দৃশ্য। কোথাও শার্প টার্ন, কোথাও অল্প। গলায় তেমন ঘাম নেই, এতোটাই মনোরম আবহাওয়া।
মিনিট চল্লিশ পর, গাড়ি নামাল একটি স্থানে। বলে রাখা ভালো, বাসে করে এলে বাস একটি জায়গায় দাড় করিয়ে দেয়, সেখান থেকে অনেকটা রাস্তা কভার করে তবেই ঢোকার গেট এ আসা যায়।
চামড়ার সমস্ত কিছু, জুতো, ঘড়ি, মোবাইল, ক্যামেরা আর বাকি সব গাড়িতে রাখলাম। সঙ্গে নিলাম টিকিট, আই ডি প্রুফ আর কিছু টাকা, ব্যাস।




ঢোকার গেট, আনুসঙ্গিক কিছু স্থান যেখানে দর্শনার্থীদের লাইন পড়ে, তবে এতোটা ফাঁকা, ভাবতে পারিনি। ধীরে ধীরে আমরা এগোতে শুরু করেছি। মেইন চেকিং এ পৌছাতে অনেকটা ঘুরে ঘুরে আসতে হয়, যেহেতু আমাদের কাছে রয়েছে ফ্রি দর্শনের টিকিট, নয়তো সোজাসুজি ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে দর্শনের টিকিট মুল্য অনুযায়ী। এই চেকিং এ আসতে নরমালি সময় লাগে কম করে ঘণ্টাখানেক, সেখানে আমাদের লাগল মিনিট কুড়ি প্রায়
কোথাও দাড়াতে হয়নি, এগিয়ে চলেছি হুর হুর করে।
এই স্থানের পর থেকে কোন ফুল মালা পর্যন্ত ওনারা পড়ে থাকতে দেন না মেয়েদের। তার কারন, ফুল ভগবানের জন্য, একমাত্র ভগবানই ফুল রাখবেন নিজের কাছে।
এক প্রকার লাইনে আসতে আমাদের লাগল ১২টা ৪৫। সেখানেই অপেক্ষা একটু করতে হয়েছিল, প্রায় ১.৩৫ বেজেই গিয়েছিল।
লাইন ধরে আসতে আসতে এগিয়ে চললাম। বামদিকে পাথরে খোদাই করা কিছু অক্ষর, সমান তেলতেলে হয়ে গিয়েছে
, বারবার হাত পড়ে। বালাজি দর্শনের আগে তিনটি প্রাকার ঘুরে ঘুরে যখন আসল জায়গায় পা পড়বে, ভেতর থেকে সত্য প্রকারের অনুভূতি চলেই আসবে।
বড় বড় গেট পেরিয়ে লাইন এ দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনছি ঠাকুরের নাম উচ্চারন, দর্শনার্থীদের মুখ থেকে, বেশ জোরে। আসতে আসতে এগিয়ে চললাম “ বালাজি “ দর্শনের জন্য।

অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবো না, তবে এটুকু বলতে পারি, গায়ে কাঁটা দিয়েছিল প্রতিটা মুহূর্ত, যতক্ষণ আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
শুনলাম ওনার মূর্তি কেও বসিয়ে দেননি। সেই আদিকাল থেকে জানা যায়, মূর্তি নিজেই প্রকট হয়েছে, যার মাথায় রয়েছে কেশরাশি, যার নিজের ঘাম হয়, একদম মানুষের মত। খুব জাগ্রত ঠাকুর বলে মানা হয়ে থাকে।

কোন কিছু দান করতে হলে “ হুন্ডি “ এর ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে লাইন দিয়ে গিয়ে দেওয়া যায়। কেও মুঠো ভরে খুচরো পয়সা নিয়ে এসেছে, কেও বা ছোট্ট কিছু।
বাইরে বেরানোর আগে একটি স্থানে ঠাকুরমশাই রো ধরে বসেছিলেন। কাছে যেতেই একটা করে ছোট্ট লাড্ডু দিয়ে দিলেন। আহা, অমৃত। বলে রাখি, ফ্রি কাউন্তার এর লাড্ডু এটা নয়, এটা উপরি পাওয়া
ছিল মাত্র




সত্যি বলতে লাড্ডুর প্রতি এক প্রকার লোভ ছিল আমার। তাই দর্শনের পর, লাড্ডুর কাউন্তার খোঁজার জন্য দৌড় মেরেছিলাম প্রায়। মন্দির থেকে বেড়িয়ে বামদিকে সোজা হাঁটলে যেখানে ধাক্কা, তার ঠিক ডানদিকে
প্রতি টিকিট পিছু একটা লাড্ডু রয়েছে। চাইলে আলাদা করে লাড্ডু কেনাও যায়।
৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা বিভিন্ন রেঞ্জের ওজন অনুযায়ী লাড্ডুর দাম।

দর্শনে সন্তুষ্টি পাওয়ার পর এই ভক্তের পেটে টান পড়েছে মনে হোল। যাওয়া যাক অন্নপ্রসাদ খাওয়ার জন্য।
মন্দির থেকে বেড়ানো মাত্র সামনে স্বামী পুষ্করিণী ( ভেঙ্কটেসর কুণ্ড )। জল তেমন একটা দেখিনি, তবে এখানে স্নান করেই দেবদর্শন করা হবে, এমনই প্রথা। ওর পাশ থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে অন্যদিকে। কিছুটা যাওয়ার পর দেখতে পাওয়া যাবে একটি বড় জায়গা। প্রসাদ সেখানেই বিতরন করা হয়।
সকাল, দুপুর, রাত্রি এই তিনটি ধাপে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে অনেক ভক্তদের বসানো হয়। টেবিলে বসে কলাপাতায় প্রথমে থাকে ঠাকুরের ভোগ। সেটা খাবার সাথে সাথেই আসে আরও কিছু, পেট মন দুই ভরে যাবে।




সময় কখন কেটে যায়, বোঝা যায় না। আমাদেরই তাই ৪টে বেজেছিল দেখতে দেখতে। ভাগ্যিস প্ল্যান করিনি সাইড সিয়িং এর, তাহলে যেত আর কি। সদ্য বিয়ে করা নববিবাহিতরা এখানে আশীর্বাদ নিতে আসে


বলে রাখা ভালো, সাইড সিয়িং এর প্ল্যান সেদিনই থাকলে, সময় বাঁচিয়ে কাজ করতে হবে। কারন, টিকিট ছাড়া তিরুমালাতে অর্থাৎ ওপরে আর কখনোই ঢোকা যাবে না। তাই, যেদিন দর্শন, সেদিনই ওপরে ঘোরার হলে, একটু তাড়াতাড়ি। আমার মতে , যাদের দর্শনের সময় সকাল ১১ টার মধ্যে আছে, তারাই এই প্ল্যানটা করুক। বাকিদের ক্ষেত্রে এতোটাই লেট হতে পারে যে গাড়ির চুক্তির টাকা বিফলে যাওয়ার চান্স অনেকটাই রয়েছে।
এখানে একটা অপশন আছে। ওপরে অর্থাৎ তিরুমালাতে, যদি এক দিন থেকে যাওয়ার চিন্তা করেন, তাহলে অনেক দিক দিয়েই সেফ।   



তিরুমালাতে থাকার ব্যাপারে কিছু তথ্য -
অনলাইন এ টিকিট বুক যদি হয়ে থাকে ( বুকিং প্রসেস অন্য পোস্ট এ দেবো ), তৎক্ষণাৎ থাকার জায়গা বুক করুন, একই ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে
থাকার জায়গা খুব সীমিত, বাজেট কম বেশি রয়েছে, সঙ্গে সেই অনুযায়ী সুবিধা তবে দেবস্থানে থাকলে খাওয়া দাওয়ার একটু অসুবিধে হতে পারে, তাই শুকনো, ড্রাইফ্রুট জাতীয় কিছু নিয়ে রাখলে ভালো

তিরুপতি যাওয়ার আগে কিছু কথা -
-> ডবল ভাক্সিন অবশ্যই লাগবে
যদি সেটা না থাকে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নেগেটিভ রিপোর্ট মাস্ক তো অবশ্যই, এটা বলে দিতে হয় না
-> পরিচয়পত্র হিসেবে আধারকার্ড অরিজিনাল বা কপি নিয়ে গেলে ভালো

-> দর্শনের দিন মেয়ে ও ছেলেদের ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী জামা কাপড় পড়া বাধ্যতামূলক

-> দর্শনের সময়ের দেড় ঘণ্টা আগে বেড়ানো ভালো, কারন অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের বেশি হলে ঢোকার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে

-> মাথায় বা শরীরের অন্য কোন স্থানে ফুল নিয়ে যাবেন না, গেটপাশেই ফেলে দিতে হবে, মন খারাপ করলেও কিছু করার নেই


আমি কীভাবে গেলাম ?
হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে ডাইরেক্ট তিরুপতি
ট্রেনে যাওয়া যায়। কিন্তু সেটা না থাকলে ?
অল্টারনেটিভ উপায় ? যেটা আমি অবলম্বন করেছিলাম।
ট্রেন পথে নেমেছিলাম, রেনিগুন্তা। তিরুপতি থেকে ১০ কিমি দূরত্ব মাত্র। মোট সফর ২৬ থেকে ২৭ ঘণ্টা।
প্লেনে যেতে চাইলে, দমদম থেকে ডাইরেক্ট তিরুপতি এয়ারপোর্ট। খরচা একটু বেশি পড়বে।
এছাড়া চেন্নাই এয়ারপোর্ট থেকে তিরুপতি আসা যায়। সেক্ষেত্রে ফ্লাইট ভাড়া কম, কিন্তু ফোর হুইলার ভাড়া সেই পরেই যাবে।

মন্দির দর্শন করবো কি করে ?
বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস সবসময়ই আছে। আরামদায়ক ও মনোরম জার্নির জন্য প্রাইভেট কার স্ট্যান্ড রয়েছে, খুব বেশি বারগেনিং করার দরকার পড়বে না, কারন রেট ওখানে যে যেটা বলবে, পাশাপাশি প্রায় একই। ফিক্সড না হলেও ওদের গাড়ি অনুযায়ী সমস্তটাই কম বেশি ঠিকই আছে।
ওপরে পাহাড়ি রাস্তায় অটো আলাও নেই, তাই ওটার কথা মাথায় আনবেই না।

কি খাবো ?
ধোসা, ইডলি মুলত মহারাষ্ট্র এর খাবার হলেও ভেজ হিসেবে ওখানে এগুলোর চল খুব বেশি। বাঙালি হোটেল বাস স্ট্যান্ড এ রয়েছে। ওটা ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ভাত সঙ্গে দই
একসাথে পাওয়া যায়, আলাদা করে বললে চার্জ বেশি নন ভেজ এর রেস্টুরেন্ট কিছু রয়েছে।  

১৯৭৯ সালের ঘটনা।
একবার, তিরুপতি মন্দিরে মাঝরাতে ঘণ্টা বেজে ওঠে, ঠিক তখন যখন মন্দির ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। কে বাজিয়েছিল ঘণ্টা ? মিডিয়ার
 থেকে কিছুটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে কেন সেই ঘটনা। বলবো এই গল্প, অন্য পোস্টে।





©SamiranSamanta


Comments