শেষটা আরও ভাল হতো - একটি ভৌতিক গল্প

  copyright :  সমীরণ





নাম না দেখেই গ্যালারী তে ঢুকে পড়লাম, এক্সজিবিসন চলছে, তাও আবার হাতে আঁকা ছবির। উহু, একবার ঢু না দিয়ে যাবো না মাস খানেক হয়েছে, এই গ্যালারীটা নতুন। ঐ যে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, তার এর পাশ দিয়ে ঢুকে গেলে একটা সরু রাস্তা, তার পেছনে একটা ফাস্ট ফুড এর দোকান যেখানে আলুর রোল বিখ্যাত, ওর পাশ দিয়ে আর একটা গলি চলে যেখানে শেষ হয়েছে, নতুন গ্যালারির ঠিকানা ওটাই।
নামটা বেশ অদ্ভুত , “ রডোডেনদ্রন “

 খুব ছোট্ট মত, দুটো রুম নিয়ে তৈরি, অপরতলা গুলো বন্ধ। কেও চাইলে বোর্ড দিয়ে সেপারেট করে নিচের রুমটা ব্যবহার করতে পারে। ভাড়াও নিতান্তই কম যেমন শুনলাম।

ভেতরে ঢুকতেই ডান দিকে টেবিলে বসে ছিলেন একটি কম বয়সী মেয়ে।
সামনে ক্যাটালগের বাঞ্ছ উঁচু হয়ে বসে আছে।
এক হতে পারে লোক বেশী ঢোকে, তাই এত বানিয়ে রাখা। অথবা উল্টোটা। যারা খুব একটা জানেনা এই নতুন জায়গার কথা, তারা চট করে আসবে কেন।

আসলে না জানার কারণও আছে। একেই জায়গাটা একটু ভেতরে। আর তারপর বছর পাঁচেক আগে ভয়াবহ অগ্নিবিপর্যয় ঘটেছিল। সেই সময় এটা ছিল একটা ছোট্ট সংরক্ষণশালা। কচি কাচা তাদের ফ্যামিলি সব্বাই ভিড় করত। একদিন হঠাৎ কীভাবে যে ঘটে গেল, প্রায় ৩০জন মত মারা যায়। ছোট বড় কেও রেখাই পায়নি।
কথা গুলো ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সকালের পেপারে সেই ভয়াবহ ছবি...চেনা যায় না কাওকে। সব্বার পরিচয় সমেত উঠেছিল সেইদিনের পুরো কভার পেজটা। কি মর্মান্তিক... থাক সে কথা।

আমি ভবঘুরে ফটোগ্রাফার, এদিক ওদিক দেখাটাই আমার কাজ। তাই নতুন সন্ধানটাও পেয়ে গেলাম এই গ্যালারির।


খেয়াল করিনি, ইনিই সম্ভবত শিল্পী।
ঢোকার সময় বাইরে একটা পোস্টারএ এনারই ছবি দেখেছি।
মুখে একটা সৌজন্য মূলক হাসি বিনিময়ের জন্য ওনার দিকে তাকালাম । কিন্তু উনি তেমন কোনও পাত্তা দিলেন না। সামান্য একটা হাসি হাসলেও তো... দেখতে যেমন সুন্দরী, ভেতরে তেমনটা নয়

ধুর দেখব না এনার ছবি, যে মানুষের এতো ঘ্যাম
কিন্তু ততক্ষণে ক্যাটালগ হাতে নিয়ে ফেলেছি। মান সম্মানে লাগবে ভেবে পিছু পা হলাম না।
ক্যাটালগ ধরিয়ে দিয়ে উনি বললেন একটাই কথা, “ প্লিজ ছবি তুলবেন না।“
বাবাহ, গলাটা বড্ড ভারী, কেমন যেন ছ্যাকা লাগে।

কথাটার মানেটা আমি বুঝি।
আমি নিজেও অল্প এক্সজিবিসন করেছি গ্রুপে

আমার মত মানুষ হোক, বা কোনও পেইন্টার, প্রত্যেকেই নিজের কল্পনায় একটা ফ্রেম বুনে সেটাকে রূপান্তর করি
ওনারা রঙ তুলির আশ্রয় নেন, আমরা ডিজিটাল লেন্স কে তাক করে

কিন্তু সাধারণ মানুষরা যখন ছবি দেখতে ভিড় করে, তারা এসব তো বোঝেই না, উপরন্তু ছবি দেখার আগেই ফ্রেম এর সামনে ক্যামেরা বা মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে নেন

খালি চোখে কোনও একটা ছবি দেখলে তার ভেতরের আসল ছবিটা ফুটে ওঠে, সবসময়
ফুটে ওঠে শিল্পীর ভাবনা, তার বুনন ক্ষমতা সেগুলো একটা ক্লিক দিয়ে বোঝা যায় না

মুখের ভাব দেখিয়ে ওনাকে আশ্বাস দিয়ে এগিয়ে গেলাম

ক্যাটালগে নাম , “ তপতী সান্যাল “, গত সোমবার থেকে শুরু হয়েছে, থাকবে ২ সপ্তাহ।
বেশ ভাল, অনেক দিন পর এমন শো
 


ডিজিটাল ক্যামেরাটা ঢুকিয়ে দিলাম। আজ
একটা যে লেন্স এর ফিল্টারটা কিনেছি, সেটা ঠিক আছে কিনা ভাল করে দেখে, চেইন আটকে এগিয়ে গেলাম ক্যানভাসের ভিড়ে।
দর্শক বলতে আপাতত আমি একা।
দারুণ সাজিয়ে রেখেছেন ক্যানভাসগুলো। কোনটা ৪ বাই ৬, কোনটা ১০ বাই ১৪। কোন সাইজের পাশে কোনটা মানসয়ই হবে, সেটার ব্যাপারে এনারা নিখুঁত।

প্রায় মিনিট কুড়ি পর বেড়িয়ে হাটা মেরে নন্দন পর্যন্ত এলাম। হলদিরাম স্টপেজ থেকে বাস ধরেছি, আলিপুর যাওয়ার জন্য। সীট পাওয়া মাত্র,বসে বসে চিন্তা করতে লাগলাম ছবি গুলোকে নিয়ে।
ওনার থিম ছিল, হিউম্যান ফেস। ব্যাকগ্রাউন্দ কে একটু এদিক ওদিক করে আসল ধ্যান দিয়েছেন মুখ আঁকার সময়। কোনটা একটা যুবতীর যে অফিস বেরিয়েছে, কোনটা একজন বয়স্ক লোকের, যিনি জাহাজে কাজ করতেন, কোনটা বিধবা কোনও এক মহিলার, যিনি কাঁথা বুনছেন।
প্রত্যেক ছবি অত্যন্ত নিখুঁত আর দেখলে মনে হবে, ঠিক যেন সামনে থেকে দেখছি

তবে একটা ব্যাপার এখন মনে পড়ছে, ছবিগুলোতে প্রত্যেকটাই কিছু একটা আছে। কিছু একটা খুব বেমানান, অথচ ধরতে পারছি না।


ফ্ল্যাটের চাবি হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে দরজা খুলছি। পাশের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটে সম্ভবত কাল আসবে। সকালে যখন ঘর ছেড়ে বেরছি, জিনিস পত্র শিফট চলছিল
নিচে একটা ম্যাটাডর দাড়িয়ে ছিল,ভর্তি অবস্থায়।

ঘরে আপাতত আমি একাই থাকি। নিজের বলতে মা আর বাবা। বনগাঁ এর একটি গ্রামে থাকে, পৈতৃক ভিটে ছেড়ে আসতে কেও রাজী নয়। আমি নেহাত কাজের জন্য এখানে আসতে হোল। পয়সা সবে জমাতে শুরু করেছি, মাসে মাসে মা কে পাঠিয়ে দি বাকিটা।
এভাবেই কেটে যায় আমার দিনকাল।

মিনতি দিদি সক্কাল ৯টায় ঢুকেই চা জলখাবার করে দেয়। তারপর রাতের আর দিনের ভারী খাবার বানিয়ে, বাসনপত্র গুছিয়ে, একটু ঘর মুছে চলে যায়।
ঘরের আর তেমন কাজ পড়ে থাকে না যে করবো। ইছে করলো একটা মুভি দেখতে বসলাম, বাটিতে আমূল গুড়ো দুধ। কখনও ইছে হোল গল্পের বই নিয়ে সারাটা দুপুর কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ মনে পড়ে, বিকেল চারটে বেজে গেছে। তড়িঘড়ি করে স্নান সেরে খেতে বসে পরি। কখনও বা ল্যাপটপে অডিও স্টোরি চালিয়ে ইছে মত কিছু বানালাম। মুখে স্বাদ আনতে মাঝে মধ্যে নিচে যাই। সামনের কেবিন থেকে ফিস চপ বা চিকেন পকরা। একটু চা বা কফি বানিয়ে ফেলে আবার বসে যাই।

আলসেমির চর্চা ছেড়ে একটু কাজের কথা বলি, নয়তো আমার পেট চলবে কি করে। আমি একজন ফ্রি লান্সার। সমস্ত কাজটাই ফটোগ্রাফি সেকশনের।
ক্লায়েন্ট এর চাহিদা অনুযায়ী ফটো তোলা, সাবজেক্ট অনুযায়ী সেগুলো পাঠানো। কখনও রোল মডেল এর ফটোগ্রাফি করা, কখনও বা স্টক ফটো সাবমিট। তখন না থাকে দিনের ঠিক, না সময়ের। বেশ চলে যায় সেই অনুযায়ী।

আজ সকালে মিনতি দিদি এলো না। ফোনে জানতে পারলাম, শরীরটা খুব খারাপ। কামাই জিনিসটা দিদির রুটিনে নেই, কিন্তু আজ ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। আগামী দুই তিন দিন আসতে পারবে না বলল, পরিবর্তে একজন কে পাঠিয়ে দেবে।
নতুন কেও কিছুদিনের জন্য এলেও, আমি জানি অসুবিধে একটু আমার হবে।
আজ সকালটা যেভাবে হোক ম্যানেজ করে নিতে হবে আমাকে।

সকাল ১০টা।
স্নান করে সারা ঘরে গঙ্গাজল ছড়িয়ে একটু ধুপ দেওয়া আমার অভ্যাস। আজ ধুপ নিয়ে দরজার সামনে যেতেই, বাইরে থেকে কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে।
নতুন ফ্ল্যাট থেকে আসছে না শব্দটা ?
শুনেছিলাম মাঝবয়সী দম্পত্তি ও তাদের মেয়ে। নতুন ঘরে নতুন লোকজন এলে একটু হুল্লোড় হই বইকি।
আমি বরাবর শান্তি প্রিয় মানুষ। এসব চিৎকার চেঁচামেচি একটু এড়িয়ে চলি।

আজ কয়েকটা ফটো স্টাফ লাগবে, সল্টলেকের দিকে গেলে পাওয়া যাবে মনে হয়
খাওয়া দাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়লাম। ফ্ল্যাটে তালা বন্ধ করার সময়, পেছনে মনে হোল কে একজন দাড়িয়ে আছে।
তাকাতে দেখলাম নতুন মুখ, একটা যুবতী মেয়ে। বেশ দেখতে, বয়স ২০ এর কাছাকাছি। ওপরে ধুসর টপ, নিচে একটা ত্রাউজার। আনন্দ করে ময়লা জিনিস পত্র ডাস্টবিনে ফেলতে এসেছিলো।  
নতুন মুখ, নতুন মানুষ, নতুন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।
লজ্জায় যাতে আর না পড়তে হয়, নিচে নেমে গেলাম তাড়াতাড়ি।



বিকেলের সূর্য পড়ে গেলে ছবি তেমন আর ভাল ওঠে না।
এখন বাজে প্রায় পৌনে পাঁচটা। বাড়ি ফিরতে আধা ঘণ্টা। গিয়ে একটু লাইট মিউজিক নিয়ে বসবো, আর আজকের কাজটা এডিট করে পাঠিয়ে দেবো।

গেট পেরিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। ওপর তলায় আমার ফ্ল্যাটের লাগোয়া সিঁড়িটা টপকে এগোলাম। ফ্ল্যাটের সামনে কে যেন দাড়িয়ে আছে। থমকে গেলাম এক পলকা।

অন্য দিন হলে ফ্ল্যাটের বাইরের জিরো ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রাখি, আজ তাড়াহুড়োর চক্করে ভুলে গেছি, তাই ওখানটা বেশ অন্ধকার লাগছে। বুঝতে পারছি না কে সে।

উনি যে মহিলা এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ, কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা বলেই মনে হয়। অন্ধকারে বুঝতে পারছি না। আমার পায়ের শব্দে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। অন্ধকারে উনি যে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন , সেটা বুঝতে পারছি। ভেতরে একটা অস্বস্তিও কাজ করছে । কে ইনি... শরীরের ভেতরে এমন উথাল পাথাল করছেই বা কেন। ধড়াস ধড়াস !

“ কে ওখানে ? “
ভেতরে ভয় নিয়েই প্রশ্ন করলাম নিচে দাড়িয়েই।

কিছু মুহূর্ত পর উত্তর এলো, “ আমি চারু “, গলাটা বেশ গম্ভীর অথচ সুন্দর।
“ কে চারু ? কাকে চাই ? “
“ আজ্ঞে, আমি আপনার কাছেই এসেছি “, মহিলা বলে টা কি, আমার সাথে কিসের দরকার?
“ কি ব্যাপারে বলুন তো ? আমি আপনাকে চিনি না একদম। “
“ আজ্ঞে, মিনতি দি আমাকে পাঠিয়েছে। “


নিঃশ্বাস ফেললাম সজোরে। ওহ, এই ব্যাপার। কিসব ভাবনা চিন্তা করছিলাম আমি। সত্যি, এতটাও ওভার থিঙ্কিং ভাল নয় আমার জন্য। মুখে একটা হাসি টেনে ফ্ল্যাটের দিকে নিশ্চিন্তে গেলাম।
মনে পড়ে গেলো, সকালে ওদিকে পাশের ফ্ল্যাটের মেয়েটা দাড়িয়ে ছিল, এখন আর নেই।


চারু বলে মেয়েটি রান্না ঘরে যা ঢুকল বেরোল প্রায় অনেকটা সময় পর।
অচেনা একজনের উপস্থিতি
পছন্দ করছি না, কিন্তু কিছু করার নেই। মিনতি দি চলে এলেই ভাল।
বেশীদিন এমন চললে বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবো মিনতি দি কে।
ঘরের সব কাজ করে দিলো, অথচ সময় বড্ড অল্প লাগলো। এতটা তাড়াতাড়ি হয়তো ইনি এই কাজেই বড্ড পটু, বয়সটাও কম।

ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ খুলে কার্ড রিডারটা ঢুকিয়ে দিলাম। ফটো কপি যতক্ষণে হয়, মিনিমাইজ করে রাখলাম স্ক্রিনের উইন্ডো। চোখটা বন্ধ করে পেছনে হেলান দিলাম।
“ কাল কখন আসব ? “, চারু বলে মেয়েটি বলল।

কাল তো খুব সকালে বেড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপার আছে, এই সময়েই আসতে বললে হয় না ?
“ কাল তুমি এই আজকের মতই এসো, একটু পরে এলেও ক্ষতি নেই। “, কথাটা বলে ওর দিকে তাকানো মাত্রই চমকে উঠলাম।
স্পন্দন উথাল পাথাল করতে থাকলো ভেতরটা, কারণটা অজানা। সত্যি জানিনা। সেই একটু আগে সিঁড়িতে যেমন হয়েছিল।
এই প্রথম ওর মুখের দিকে তাকালাম, নাহ আমি চিনি না। কিন্তু খুব চেনা লাগছে চারুর মুখটা। কিন্তু কেন ?

চারুর মুখে ক্লান্তি ভরা হাসি, যেটা খুব একটা স্বাভাবিক লাগছে না আমারও। সিঁড়িতে যখন অন্ধকারে তাকিয়েছিল তখনও না জানা এক প্রকার অনুভুতি হয়েছিল, আর এখন। এখন চোখে চোখ রাখতেই যেন বুকের ভেতরটা কেমন করছে, আর একটু হলেই হৃৎপিণ্ড বেড়িয়ে আসবে।

দরজা থেকে চারু বেড়িয়ে গেছে।
তখনও আমি বসে আছি ওখানে, জড়ো বস্তুর মত।
এমন অভিজ্ঞতা কই আগে তো হয়নি, তাহলে আজই কেন ? এমনটা হওয়ার কারণই বা কি ?
কোনও রকমে উঠে দরজার বন্ধ করে দিয়ে যখন চেয়ারে বসলাম। কাজের মুড টা নষ্ট হয়ে গেছে।   

কখন চোখ লেগে গেছিল বলতে পারবো না। ঘড়ির কাঁটায় চোখ ফেলতে দেখলাম রাত্রি দশটা বেজে কুড়ি।
ঘুম ভেঙেছে অবশ্য পাশের ফ্ল্যাটের আওয়াজে। তবে এবারে কোলাহল ছাপিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। এক কথায় ঝগড়া।

দরজার ওপারেই ওনারা দাড়িয়ে দাড়িয়ে চিৎকার করছেন। মূলত একজন ভদ্রলোকের আওয়াজ আলাদা করে পাছি, গলাটা বেশ মলিন আর সুন্দর। খুব সুন্দর বাচকস্বর।
যদি ঝগড়াই হয়, তাহলে ঘরের সমস্যা ঘরেই মেটাতে হয়, বাইরে সব্বার সামনে আনলে সেটা হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এনারা সেটা বুঝতে পারেন কি না জানিনা। নতুন জায়গায় আসা মাত্র এমন কেও করে নাকি।

বাইরে যাওয়াটা কি উচিত হবে ? প্রথম আলাপ যদি এই ঝগড়ার মধ্যিখানে হয়, তাহলে আসলেই কি সেটা ভাল দেখাবে।
মেয়েটার গলা পেলাম, সম্ভবত। সকালে যাকে দেখেছি সেই হবে।
দেখি যাই, কি হয়েছে।

দরজা খুলতেই দেখলাম, একজন ভদ্রলোক আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ঐ দিকে কথা বলছেন। আর ঐ দরজায় দাড়িয়ে আছে, ঐ মেয়েটা সঙ্গে একজন মাঝবয়স্কা, সম্ভবত মা।

আমার উপস্থিতি ঐ দুজনকে চুপ করিয়ে দিলেও, ভদ্রলোক তখনও বলে চলেছেন জোরে জোরে , “ তোমরা আমায় ভুল বুঝছ, বুঝতে পারছি না কি করে বোঝাবো তোমাদের... “
মাথায় হাত দিলো ভদ্রলোক, কথাটা বলার পর। নিজে থেকেই আমার দিকে ফিরলেন।
একটু অবাক হলেন আমাকে দেখে, দরজা খোলা অবস্থায়।
কিছু বলতে যাবো আমি, তক্ষণই, হ্যাঁ ঠিক তক্ষণই বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে শুরু করে দিয়েছে। এটা ঠিক সেরকমই , যেমনটা চারু এর বেলায় হয়েছিলো।


ওনার তাকানোর চাহনি দেখে আমি আর বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারিনি। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।

আমার কি হয়েছে ? মানসিক কোন রোগে ভুগছি নাকি আমি ? নিজের অজান্তেই ? যাকে দেখছি তাকেই চেনা চেনা মনে হছে, অথচ তাকে আমি এই প্রথম দেখলাম।
কি করে সম্ভব ? কি করে এমনটা আমার সাথে শুরু হোল, তাও আজ থেকে। কিছু বুঝতে পারছি না আমি।
টলতে টলতে এসে চেয়ারে চুপ করে বসে পড়লাম। শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।
 

-----------------------------------------------------------------------------

 

 

 

 

 

 

 

 



মনটাকে একটু শান্ত করতেই হবে। গান শুনলে কেমন হয়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে কিছুসময় ইউটিউব ঘাটতে ঘাটতে সময় কখন ১১টা ছুঁয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। ততক্ষণে আমার ভেতরের চঞ্চলতা কাটিয়ে উঠেছি, প্রায় ভুলেই গেছিলাম কি ঘটেছিল আমার সাথে ঘণ্টা খানেক আগেও।

রুটি, একটু আলুভাজা, সঙ্গে কয়েকটা চিকেনের টুকরো। খেয়ে উঠে রোজের হাঁটা আমার অভ্যাস, রাত্রি যতই হোক। নিচে গিয়ে একটু পায়ে চারি করি।
হেডফোনটা কানেক্ট করে নিলাম মোবাইলের সাথে।

দরজায় চাবি দিয়ে এগোতে যাবো, দেখলাম সামনের বারান্দায় মেয়েটি দাড়িয়ে। হুম, পাশের ফ্ল্যাটে যে এসেছে, সেই। যাকে সকালে দেখলাম, আর একটু আগেও।

দুটি ফ্ল্যাটের লাগোয়া একটা কমন প্যাসেজ আছে, যেখানে দাড়িয়ে থাকা যায়, বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। মেয়েটি সেখানেই দাড়িয়ে। ঠিক যেন কাঁপছে দাড়িয়ে দাড়িয়ে।
কাঁপছে না কাঁদছে ?
হেডফোনটা কান থেকে নামিয়ে
, “ এক্স কিউজ মিঃ, আপনি ... “

গলার স্বর শোনা মাত্র চমকে উঠলো মেয়েটি।
সামনের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকাল। সেই চোখে জল। মায়া হোল ওর জন্য। ছোট্ট একটা ফ্রেমলেশ চশমা, চুল গুলো সামনের দিকে অল্প করে নামানো। স্বাভাবিক ভাবে দেখতে গেলে যুবতী প্রচণ্ড সুন্দরী। মনে গলে গেল এমন সৌন্দর্যে।
এসব ভাব্বার সময় নেই ছি ছি, নিজেই হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিলাম।

একটু তাড়াহুড়ো করে চোখের জল মুছে নিল। ভেজা হাত বাড়াতে হয়তো একটু সঙ্কোচ বোধ করছে, তাই মুখে অযাচিত একটা হাসি টেনে বলল, “ আমি স্নেহা, আপনার পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছি। “
“ বেশ, সেটা আমি দেখতেই পেয়েছি। “

“ দেখতেই পেয়েছি “ কথাটা শুনে মেয়েটির মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেল, হঠাৎ করে। ঠিক যেন দপ করে জ্বলেও নিভে গেল প্রদীপটা। বাড়িতে এতো চেঁচামেচি ঝামেলার পর হয়তো একটু নিঃশ্বাস নিতে এসেছিল এখানে, আমার কথায় হয়তো আবার সেই কথাগুলোমনে পরে গেছে। গতিক ভাল লাগলো না আমার।

“ খারাপ ভাবে নিও না বন্ধু, আমি ওভাবে কথাটা বলতে চাইনি। “
“ জানি আমি, তবে কি জানেন। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, কোনটা এড়িয়ে যাবো, বুঝতে পারছিনা। “, স্নেহা বলল আবার।
“ কি হয়েছে তা কি বলা যেতে পারে এই নতুন বন্ধু কে ?”

নতুন কারোর সাথে আলাপ হলে আমি সচরাচর বন্ধু বলেই সম্বোধন করি। এখানেও সেটাই করেছি।

স্নেহা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল বন্ধ।
বলল, “ বন্ধু বলে যখন ডাকলেন, একটু নিচ থেকে হেঁটে আসলে কেমন হয় ? আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। “

হেডফোনটা আর আজ কানেক্ট করার দরকার পড়বে না যা মনে হোল।

কিছুটা হাটতে হাটতে স্নেহা যেটা বলল, আমি কিন্তু বেশ চমকে গেছি। ওর নিজের ভাষায় যেমন করে বলল,
“ আমরা আগে থাকতাম জামশেদপুরে। বাবা আর মা র লাভ ম্যারেজ। আসলে বাবার ফটোগ্রাফি এর শখ ছিল খুব। কোনও এক সুত্রে মা এর সাথে পরিচয়, আর ক্রমে পরিণতি। আর এখন আমি। ঝগড়া কি জিনিস, সেটা কানেই শুনেছি, কাল পর্যন্ত কখনই এটা চোখের সামনে হতে দেখিনি আমার ঘরে। কিন্তু ... “

থেমে গেলো স্নেহা।
“ কি হয়েছিল আজ ? ”, বললাম।

আজ আমরা শিফট করলাম এইখানে, খুব সকালে। আসার পথে বাবাকে তার নতুন অফিসে ড্রপ করি
সম্ভবত ওটা রবীন্দ্রসদন, খুব বিখ্যাত জায়গা শুনেছি কোলকাতার। কিন্তু সন্ধে বেলা... “
কিছুটা চুপ করে, চোখের জল ঝরাছিল। শান্ত হতে বেশ কিছু মিনিট লেগেছে।
“ সন্ধে বেলা হঠাৎ করে একজন অচেনা লোক দরজায় কড়া নাড়ে এই ফ্ল্যাটে। দরজা খোলা মাত্র এমন ভাবে ঢুকে পরে যেন... যেন ওটা ওনার ফ্ল্যাট। শুধু তাই না, আমাকে আর মা কে নাম ধরে ডাকছে। “

হকচকিয়ে গেলাম, বুঝতে পারলাম না কি বলতে চাইছে স্নেহা।
“ মানে ? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। “

“ আমরাও বুঝতে পারিনি। একজন অচেনা লোক বলা নেই কউয়া নেই, এমন ভাবে ব্যাক্তিগত স্থানে ঢুকে কীভাবে পড়ে ? হতে পারে আমরা কোলকাতায় প্রথম এসেছি, কিন্তু এমন ব্যাপার তো পৃথিবীর কোথাও হয় না। “

“ তুমি বলতে চাও, লোকটি তোমার বাবা নন। অথচ নিজেকে সেই পরিচয় দিয়ে চলেছেন ?”
“ একদমই তাই। আমার বাবাকে আমি চিনি না ? আমার মা চেনে না ? ইনি কে ?”
“ বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার। আমি একটু আগে যাকে দেখলাম, ইনি কি সেই ?”
“ হ্যাঁ।“

এমনটা তো প্রথম শুনলাম জীবনে। কৌতূহল না চেপে বললাম, “ তোমার বাবা কি তারপর এসেছে রাতে ? “
“ না আসেনি। কিন্তু রাত্রি ১০টা নাগাদ আবার লোকটা আসে। বারংবার আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করলো। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচি তে আবারও চলে যায়, কিন্তু আমার বাবা এলো না... এখনও। তবে একটা ব্যাপার না আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। “
“ কি ব্যাপার ? “

“ লোকটির গলা পুরো আমার বাবার মত, শুধু তাই না, হাইট পুরো সেম। এমনকি পরনে জামাকাপড় টাও “
“ এসব কি বলছ তুমি স্নেহা ? “
“ আমি ঠিকই বলছি। আমার বাবা কে কি ঐ লোকটা খুন করে... “
“ আহ, এমন ভাবছ কেন। অতিরিক্ত ভাবনা আর অতিরিক্ত মেদ দুটোই শরীরের জন্য খারাপ। “ , রসিকতার সাহায্য নিলাম ঠিকই, কিন্তু কাজ হয়নি।

বেশ কিছু সময় একটু চুপ করে কাটল।
অনেকটা সময় বাইরে কাটালাম দুজনে, বাইরে। এই প্রথমবার এমন অচেনা বন্ধুর সাথে।
“ মা ঘরে অপেক্ষা করছে, এবার মনে আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে। “ কথার মধ্যে একটা মাদকতা ছিল, যেটার ঘোরে আমি পরে যেতাম হয়তো আর একটু হলে।
হঠাৎ পুলক জাগলে যা হয় আর কি...

ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে পেছন ফিরল স্নেহা।
“ কথা বলে ভাল লাগলো আপনার সাথে। “
একটা স্নেহের হাসি মুখে লাগিয়ে ঢুকতে যাবো, ঠিক তখন “ কাল যদি পুলিশ স্টেশনে যেতে হয় আপনি যাবেন ? আমি এখানে কিছু চিনি না আসলে। “
প্রত্যুতরে আবারও একটা হাসি বিনিময় করলাম শুধু।

 



ঘরে ঢুকে শুয়ে বাথরুমে ঢুকে একটু ফ্রেশ হলাম।
নাহ ! ঘুম আসছে না আমার
আসবে বলেও মনে হছে না। এমন একটা অদ্ভুত রকম ব্যাপার, মাথার মধ্যে পাক খেতে শুরু করেছে। এটা কি করে সম্ভব ?
কোনও একজন অচেনা মানুষ, নিজেকে পরিচিত বলে দাবি কখন করবে ?

যখন সে তাদের কারোর ক্ষতি করতে চায় ?
অথবা জোর করে কোনও একটা কাণ্ড ঘটাতে চায়। কিন্তু সেটা এই ভাবে কি সম্ভব ? ক্ষতি করতে চাইলে তো রাত্রে সবার অগোচরে লুকিয়ে আসাও যায়। এমন সব্বাই কে জানিয়ে নিজেকে বিনা তথ্যে কনভিন্স করা, আদেও কি মানা যায় ?

তাছাড়া লোকটাকে প্রথম দেখে আমার ভেতরে ভেতরে এমন হছিল কেন। লোকটার মধ্যে কি কিছু সমস্যা আছে নাকি আমার ভ্রম ?
কাজের মেয়েটা ? কি যেন নাম ? চারু। ওকে দেখেই বা আমার এতো চেনা লাগছিল কেন ?
নিজের সমস্যা এর সাথে সব ঘেঁটে তালগোল পাকানোর জোগাড়।
ভাবতে ভাবতে চোখ বুজিয়ে এসেছে।


একটা অন্ধকার স্থান। ঠিক একটা ফ্ল্যাটের মত। একটা বাল্ব ঝুলছে, জ্বলন্ত। সেই আলোয় নিচে বসে আছে কোনও একটি লোক। আমার দিকে পিঠ করে, তাই দেখতে পারছি না। ওদিকে মুখ করে উনি কি করছেন, বুঝতে পারছি না।
কিছুটা উবু হয়ে বসে কিছু একটা করছেন
বাম হাতে বোর্ড এর মত কিছু ধরা, যেন লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করছেন।
বুঝতে পারছি না, ঠিক এমন সময় অন্ধকার জায়গা গুলো কেমন একটা কুয়াশা মত ধোয়া তৈরি হয়েছে। ধোয়া আর আকার গুলো ঠিক যেন... ঠিক যেন মানুষের মুখের মত। হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঠিক দেখছি মানুষের মুখের মত। একটা একটা করে কত গুলো মানুষের মুখ তৈরি হয়েছে। হ্যাঁ, কত গুলো ধোয়ারূপী মানুষ তৈরি হয়ে আছে। ঘিরে ধরছে ঐ লোকটাকে। অথচ লোকটার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের খেয়ালে সেই কাজ করে যাছে।
একী ? একী ?
জ্বলন্ত বাল্বের গা বেয়ে লাল লাল তরল মত... ওটা কি রক্ত ? গলা শুকিয়ে গেছে আমার। কিছু বুঝতে পারছি না কি করবো। দমবন্ধ পরিস্থিতিতে ঠিক বাল্বের নিচে দেখলাম, ঐ লোকটা আমার দিকে ফিরে বসেছে। মাথা নিচু করে। হাতে ওটা কি ? কি দেখলাম আমি হাতে ?
কিছু জানিনা, আমাকে পালাতে হবে...
আমাকে পালাতে হবে, পালাতে হবে, পালাতে হবে...



ছিটকে উঠে পড়লাম, এক মুহূর্তে স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেছে।
গায়ে দরদর করে ঘাম ছুটেছে। শ্বাস প্রশ্বাস এখনও উচ্চ পর্যায়ে। পাশ থেকে জলের বোতল টা নিয়ে গলাটা ভেজালাম। শান্ত হতে একটু সময় লেগেছিল।
একি দেখলাম আমি ? এমন ভয়ানক স্বপ্ন এর আগে এমন ভাবে আমাকে ভয়াবহ রূপ দেখায়নি। কেন এমন হোল, বুঝতে পারছি না।
জানালার ফাঁক থেকে আলো ঢুকেছে ঘরে। সক্কাল হয়ে গেছে ।
কিন্তু এতো শোরগোল কেন বাইরে ?
কান্নার শব্দ আসছে না ?



পাশের ফ্ল্যাটে পুলিশ। সকাল থেকেই অনেক কাহিনী চলছে, বাইরে গিয়ে তাই বুঝলাম। আমি হয়তো সবার শেষে জানতে পারছি, এতক্ষণ ঘুমাছিলাম কিনা।
স্নেহা বসে আছে, তার মায়ের সাথে, সিঁড়িতে।
একটু আগে পর্যন্তও যে সে কেঁদেছে মায়ের কোলে, ওদের দেখলে বোঝা যায়।
আমায় দেখে স্নেহা সজোরে উঠে দাঁড়ালো , “ ঐ লোকটা সুইসাইড করেছে কাল। “
হতবাক আমি।
জিজ্ঞেস করলাম, “ কোন লোকটা ? যে তোমাকে নিজের বাবা বলে পরিচয় দিয়েছে ? “
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্নেহা বলল, “ আমাকে আর মা কে মর্গে ডেকেছে, সনাক্তকরণের জন্য। “

“ পুলিশ কি করে জানল, ঐ লোকটা এই ঘরে থাকতেন ? তোমাদের চিনলই বা কি করে ? “, সোজা প্রশ্ন করে বসলাম।

“ ওনার পকেট থেকে একটা লেটার পাওয়া গেছে, যেখানে সমস্ত ডিটেল রয়েছে। “
“ তারমানে সুইসাইড লেটার ? “
“ হয়তো তাই। কিন্তু উনি আমার বাবা নন, কতবার বলবো। “, কথাটা শেষ করতে করতে চোখে জল এসে গেছিলো স্নেহার, কোনও রকমে সামলে নিয়েছে নিজেকে।

এই পরিস্থিতিতে আমার বোধহয় একজন ছেলে হিসেবে, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ওদের পাশে দাঁড়ানোটা জরুরী।
শান্ত করে ওনাদের দুজন কে নিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম মর্গে।




পুলিশি তত্ত্বাবধানে ওরা দুজন মর্গের সেই রুমটায় যায়।
যে গতিতে মা মেয়ে গিয়েছিল, কিছুক্ষণের মাথায় ওদের ফিরে আসাটা ছিল ততটাই ভয়ঙ্কর।
স্নেহার মা কিছুটা টলমল অবস্থায়, হয়তো শরীর খারাপ লাগছে।
বাইরে আস্তে আস্তে এসে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন। ওনাকে দেখে কোনও কিছুর বোঝার উপায় নেই। ওদিকে স্নেহার চোখ দিয়ে জল আর থামছে না। শুধুই কেঁদে চলেছে, আর কোনও কথাই বলতে পারছে না।

“ কি হয়েছে ? “ এই কথাটাও আমায় বলতে সময় দেয়নি।
মেয়েটি দৌড়ে কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে মুখটা পুরো বুকের মধ্যে ঘষছে, আর কাঁদছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কখনই পরিনি, জানিনা কীভাবে সামলাবো।
কান্না জড়ানো গলায় তারপর যেটা শুনলাম, শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো।
“ আমার বাবা মারা গেছে, এটাই আমার বাবা। “

কিছু মুহূর্তের জন্য আমি স্নেহাকে মানসিক ভারসাম্যহীন ভাবলেও, তারপর যেটা শুনলাম আমার ভাবনা চিন্তার মোড় ঘুরতে শুরু করলো অন্য দিকে।

স্নেহার ভাষায়, “ এটাই আমার বাবা। কিন্তু কাল যে এসেছিলো, তাকে দেখতে অন্য একটা মানুষের মত লাগছিলো। শরীর, পেটের গড়ন, এমনকি খুরিয়ে খুরিয়ে হাঁটা সমস্তটাই আমার বাবার মত ছিল, কিন্তু দেখতে অন্য একটা লোক। যেন মনে হয়েছিলো, আমার বাবার শরীরে অন্য একটা মাথা বসানো। “

ভাবনা চিন্তাকে এক রেখায় আনার চেষ্টা করছি এখন।
জিজ্ঞেস করলাম, “ তুমি যেটা বলছ আমি বুঝলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটাই আমি... “
“ বিশ্বাস করো আমায়। এই যে আমার কাছে বাবার শেষ চিঠিটার কপি দিয়েছে। আসলটা রেখেছে ওরা, তুমি পড়ে দেখো। “

মৃত মানুষের শেষ চিঠি। না এটা একটা কপি। কিন্তু লেখার আঁচড় গুলো ? এগুলো তো শেষ বেলায় এসে লেখা।


“ আমার মৃত্যুর জন্য আমি কাকে দায়ী করবো ? জীবনে ঐ দুজন ছাড়া আমার আর কে আছে। নিজে ফটো তোলা আর এক্সজিবিসন দেখা ছাড়া একটা সময়ও ওদের ছাড়া কাটাইনি। আজ নতুন ফ্ল্যাটে অফিস থেকে একটু ঘুরে আসার পর যখন ঢুকলাম, ওরা আমায় চিনতে পারছে না। আমি নাকি ওর বাবা নই। ওর মা পর্যন্ত আমায় অস্বীকার করছে। আমায় ঘরে ঢুকতে পর্যন্ত দিলো না, কত করে ওদের বোঝালাম, কিন্তু বুঝল কই ওরা।
হয়তো আমার ভাগ্য আমার সাথে পরিহাস করছে। এই ভাগ্য নিয়ে বেঁচে থেকে আর কি হবে... “

শেষের কথাগুলো চাবুক মারছিল পিঠে। সত্যি নিজের আপনজন যদি নিজের মানুষকেই চিনতে না পারে, কতটা কষ্ট লাগে।
কিন্তু একটা কিছু এই চিঠির মধ্যে পেয়েছি, কিন্তু ধরতে পারছি না। স্নেহাকে পাশে বসিয়ে বেশ কয়েকবার চিঠিটা পড়া শুরু করলাম।

“ হুম হুম, মনে হছে কিছু একটা আছে। ঐ শব্দটায় কিছু একটা আছে “, মনে মনে গুনগুন করে বলতে থাকলাম। পাশে স্নেহা শুনতে পেয়ে আমায় বলল,  “ কি বলছ তুমি ?”

“ না কিছুনা, তুমি আমায় একটা কথা বলতে পারবে ? তোমরা একসাথে আসার সময় রাস্তায় কিছু ঘটেছিল ?”
“ না তেমন কিছু ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। “
“ ঠিক করে ভেবে বল স্নেহা। আছা, তোমার বাবা কে ড্রপ করার পর তোমরা তো ফ্ল্যাটে চলে এলে। তোমার বাবা অফিস থেকে ডাইরেক্ট কি ফ্ল্যাটে এসেছিলেন ?”
কিছুটা ভেবে নিল স্নেহা, “ ডাইরেক্ট এসছিলেন কি না বলতে পারবো না। তবে বাবার তো ফটোগ্রাফির শখ। বলেছিল অফিসের সামনেই আছে যখন আজ একবার কিছু এক্সজিবিসন হছে কিনা দেখে যাবে। “


কোথাও যেন কিছু একটা গণ্ডগোল লাগছে। কোথাও একটা মিসিং লিঙ্ক রয়েছে। কাল তো আমি নিজেই গিয়েছিলাম ওদিকে, চারিপাশে কিন্তু কোথাও কোনও এক্সজিবসন চলছে না। উহু, একটা জায়গা ছাড়া।

 

 






অফিসিয়ালি ওদের কাজ কর্ম মিটতে আরও বেশ কয়েক ঘণ্টা। স্নেহা কে কথা দিলাম, “ আমি শীঘ্র আসবো তোমার কাছে। ততক্ষণে তুমি তোমার মা কে সামলাও। “
একটা ট্যাক্সি ধরে বেড়িয়ে পড়লাম “রডোডেনদ্রন “ এর উদ্যেশ্যে।
স্নেহার বাবা শখের ফটো তোলেন, আর আমি পেটের দায়ে। যদিও এটা আগে আমার শখের মধ্যেই পড়ে, তাই আমি জানি একজন শখের ফটোগ্রাফার কীভাবে ভাবতে পারে।

রাস্তায় হাটতে হাটতে কোথাও ফ্রেম আ বিষ্কার করেলেই, দাড়িয়ে তুলে নেবে স্ন্যাপ।
দূর থেকে যেটা কেও দেখতে পায় না, সেই চোখ থাকে একজন ফটোগ্রাফারের।
সামান্য ভাত খেতে গিয়েও নিজের ঘরে আবিষ্কার করতে পারে কত না তোলার মত ফ্রেম।
সেই মানুষটার যদি সময়ের অভাব হয়? যদি কাজের ব্যাস্ততায় এই শখ গুলো পূরণ করতে না পারে ?
তখন সে এমন একটা জায়গা খুঁজবে যেখানে শুধুই ছবি আর ছবি। নিজেকে খুঁজে পাবে নিজের জগতে, সে এক আশ্চর্য অনুভুতি। ছবির দেশে সে, আর তার কল্পনা।


রডোডেনদ্রন এ পৌঁছে ডান বাম না তাকিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলাম। কালকের মতই সাজানো গোছানো।
তবে বসার জায়গায় তাকে দেখলাম না যিনি কাল ছিলেন, তপতী সান্যাল।
ঠিক তক্ষণই মনে মনে কিছু একটা হোল, বোঝাতে পারবো না। কেও যেন টেনে নিয়ে গেল আমাকে গ্যালারির ভেতরের দিকে।
অবাক হওয়ার পালা শুরু হোল এবারেই।



সেই বয়স্ক লোকটার ছবি।
যাকে আমি কাল দেখেছিলাম এখানে। শুধু এখানে নয়, এই মুখ আমার চেনা।
হ্যাঁ আমি চিনি, কাল আমার ফ্ল্যাটের বাইরে দাড়িয়ে যে ভদ্রলোক ছিলেন, এটা তো তারই ছবি। সেজন্যই আমার কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব হয়েছিলো। কাল আমি এখান থেকেই দেখে গেছিলাম তো।
কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ? স্নেহার বাবার মুখে এই মুখ ছিল কীভাবে ?

ওমা!
ঠিক তার পাশের ছবিটা কই গেলো ? ওটা কালো কেন ? কাল ওখানেই একটা সুন্দরী যুবতীর ছবি ছিল না ? ছবির পরিবর্তে পুরো ক্যানভাসটাই কালো। কেন ?
এক্সজিবিসন চলাকালীন তো ছবি বিক্রি হলেও সেটা সরানো হয় না। বরং ছবির মধ্যে একটা লাল টিপ দিয়ে দেওয়া হয় , যাতে দর্শকরা এর স্ট্যাটাস বুঝতে পারে।

বিদ্যুৎ খেলে গেলো সাড়া শরীরে। মনে পড়ে গেলো কালকের কথা।
চারু না ?
নাকি চারুর মত দেখতে ছিল এই ছবিটা ? কাল যে যুবতী মেয়েটার ছবি ছিল, সেটা তো... চারু ছিল না ? আমার ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেন এতটা চেনা লাগছিল এবারে বুঝলাম।


হতভম্ব হয়ে গেছি। ঠিক তক্ষণই পেছন থেকে শব্দ পেলাম, “ ওর ফিরে আসার সময় হয়েছে ।“, সেই একী গলার স্বর, কালকের মত।
চমকে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মিস সান্যাল।
মুখ চোখে অনাবিল খিল খিলানি, এক ধরণের আনন্দ পেয়ে বসেছে ওকে।

ঠিক বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। কার ফেরার সময় হয়েছে ?
ফোনটা বেজে উঠলো পকেট এ।
সম্বিত ফিরে পেতেই, গ্যালারির বাইরে চলে গেলাম।
ফোন স্ক্রিনে মিনতি দিদির নাম্বার। অজানা ভাবনায় ফোনটা কানে নিতেই ওপার থেকে দিদির কান্নার শব্দ ভেসে এলো। জড়ানো গলায় যে কথাগুলো শুনলাম , তার জন্য আমি কিন্তু তৈরি হতে পারিনি, তার আগেই বাজ পড়ে ছিল মাথায়।
তার মেয়ে, তারই মত এই মোছামুছির কাজ করতো। কালও নাকি তার ডিউটি তে গিয়েছিল, এক্সাইদের মোড়ে নতুন ছবির গ্যালারিতে। সেখানের সমস্ত মোছামুছির কাজ ও পেয়েছিল। কালই ছিল তার প্রথম দিন। সারাদিন কাজ কর্মের পর, আমার কাছে একবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তারপর থেকে চারু কে আর কোথাও পাওয়া যাছে না।

ফোন করেছিল একবার, শুধু বলেছিলও, “  মা, আমি পাল্টে গেছি। আমায় আর কেও চিনতে পারবে না তোমরা কেও। “
আমি তড়িঘড়ি করে বলেছিলাম, “ কোথায় তুই ?  এমন কথা বলছিস কেন ?“
মেয়ে বলল,  “ নিজের ঘরে আমায়, নিজের মেয়ে পর্যন্ত আমায় বলে তুই কে তুই কে ? পাড়ার লোকগুলো আমায় বলছিল, এ আবার কোন মেয়ে রে ? রাত বিরেতে এসেছে ?”
শেষে আয়ানায় নিজের মুখ দেখলাম, আমি পাল্টে গেছি। মা আমি আর ফিরবনা মা আর ফিরবনা “।  এটাই শেষ কথা হয়েছিল।  

আজ সকালে জলে ওর মৃতদেহ ভেসে উঠেছে।

শেষ কথাটা আমি আর নিতে পারিনি। যেভাবে এই ঘটনা গুলো ঘটছে, তার সাথে রডোডেনদ্রন এর সম্পর্ক রয়েছে, আমি নিশ্চিত। কিছু একটা গণ্ডগোল রয়েছে, আমি ধরতে পারছি না।
চারু আর স্নেহার বাবা কাল এই গ্যালারিতেই এসেছিলো, নিশ্চিত।
সময় নষ্ট আর নয়।

গ্যালারিতে দৌড় দিয়ে আবার ঢুকলাম।
আর ঠিক তক্ষণই...
ঐ কালো ক্যানভাসে এখন সেই যুবতীর ছবি, এতক্ষণ ছিল না। চারুর মুখে যাকে দেখেছি। তার মানে কি ?
মাথায় আসছে না, মেলাতে পারছি না ঘটনাগুলোকে। এসব কি হছে আমার চারিপাশে।


চোখ পড়ল পাশে থাকা আর একটি ক্যানভাসের দিকে।
মাঝবয়সী একটি ছেলের ছবি, হাতে একটা চিপসের প্যাকেট, তাকিয়ে আছে যেন আমার দিকে, হাসছে। দেখে মনে হছিল, জীবন্তও। যদি হাতের সামনে পেতাম, ফ্রেমটা বন্দি করে নিতাম। ভাবনাটা মাথায় আসা মাত্র মাথাটা কেমন ঘুরে গেল, ঠিক যেন হালকা একটা ভূমিকম্প অনুভব হয়েছে।
কোলকাতায় কম্পন হোল নাকি আমারই মাথাটা... সকাল থেকে কিছুই তো খাইনি, হয়তো এজন্যই।

আস্তে আস্তে চোখের সামনে ঘন কালো অন্ধকার জমাট বাধছে। গ্যালারির আলো গুলো উধাও। ক্যানভাসগুলো একটা একটা করে ভ্যানিস হয়ে গেল চোখের সামনে। চারিদিকটা পুরো অন্ধকার হয়ে গেল, নিকষ কালো। কিছুই দেখতে আর পারছিনা। ঠিক তক্ষণই পিছন থেকে আলোর একটা আভাষ পেলাম।
চটজলদি পেছনে ঘুরে পড়লাম। আর যেটা দেখলাম...

সেই বাল্ব জ্বলছে, ওপর থেকে তার ঝুলিয়ে। ঠিক তার নিচে একটা লোক পিছন ফিরে কিছু একটা করছে। স্বপ্ন দেখছি নাকি আবার ? আমিতো গ্যালারিতে এসেছি।
এটা কি করে সম্ভব হয় ? বুঝে উঠতে পারছি না।
পিছন ঘুরে কি করছে লোকটা ?
একটু ভয় লাগছে। কিন্তু আমাকে দেখতেই হবে। স্বপ্নে সেটা স্পষ্ট দেখিনি। এটাই যদি বাস্তব হয়, তাহলে আমাকে যেতে হবে । লাগুক ভয়, আমি যাবো।

ধীর গতিতে আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম।
পাশ থেকে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম, লোকটার এক হাতে তুলি আর অন্য হাতে একটা ক্যানভাস। কিন্তু হাত দুটো ঝলসানো। কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে এই হাট দুটোর ওপর দিয়ে।
 রঙ বুলিয়ে বুলিয়ে কার সাথে গুনগুন করছে।
চোখ গেলো ক্যানভাসের দিকে। ছবিটা সেই মেয়ের, তপতী সান্যাল।

“ বাবা, অনেক রাত হোল, ঘুমোতে যাও । “
শব্দটা কথা থেকে আসছে ? ছিটকে উঠলাম, একটা মেয়ের গলার স্বরও। কিন্তু মেয়েটি কই ? কানের পাশ থেকে আওয়াজ এলো যখন এখানেই কোনও না কোনও জায়গায় থাকবে। অন্ধকারে খুঁজে পেলাম না।

“ ও বাবা, যাও না ঘুমাতে, আর কোনও আমায় রঙ দেবে ।“
শেষ কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে লোকটি সোজা হয়ে বসলো। হাতের তুলিটা পাশের বাটিতে রেখে ক্যানভাসটা হাতে নিয়ে সোজা করে দাড় করাল।
“ দেখত মা, আজ নতুন জামা পড়ালাম, তোর পছন্দ তো ? “
এটা সেই গলা, যেটা একটু আগেই মেয়েটার মুখ থেকে শুনতে পেয়েছি। তারমানে মেয়েটির ভেতরে...



পাশ থেকে আবার সেই মেয়ের কণ্ঠ, “ খুব পছন্দ হয়েছে বাবা। কিন্তু তুমি শুধু আমাকে কেন ওদের কেও নতুন জামা পড়িয়ে দাও। “, অনুরধ আর আবেগে মিলে মিশে যাওয়া কণ্ঠস্বর।

কিছুটা নিঃশব্দ বিরতির পর মেয়েটি নিজেই বলল, “ আর কত দিন বাবা তুমি ওদের আগলে রাখবে ? এবার বিদায় দাও। ওদের মুক্তি দাও ।“

“ মুক্তি ? সে তো অনেক আগেই পেয়ে গেছে ওরা। কিন্তু ওদের কি দোষ ছিল তুই পারিস বলতে মা ? ওরাও তো বাঁচতে চেয়েছিল। “

ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে লোকটা। আমি বুঝতে পারছিনা কি ব্যাপারে বলছেন উনি, তবে ব্যাথাটা আজকের নয়। কষ্টটা অনেক আগে থেকেই নিজের বুকে বয়ে বেরাছেন এই লোকটা।

“ তোর মনে পড়ে না মা ? পাঁচ বছর আগের কথা ? এই বিল্ডিঙটায় যখন তোর মত আরও কত মানুষরা বন্দি হয়েছিলি, আগুনের মধ্যে। “


আমার বুক খালি করে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছিল ওদের ? মা হারা মেয়েটাকে মানুষ করতে কতটা কষ্ট একটা বাপ কে পেতে হয়, সেটা একটা বাপই বোঝে।
আরও কতজন ছিল, কাওকে পারলো না বাঁচাতে ? কাওকে না ? “
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে লোকটি। মনে পড়ল, সেই ভয়ানক দিনের কথা আবারও। শিউরে ওঠে গা। আজও সেই চিহ্ন বহন করে এই স্থানটা। সেই ভয়ানক অভিশপ্ত দিন গুলো তে, জেগে ছিল সারা কোলকাতা।
এই বিল্ডিংটাতে ছিল প্রায় ৩০ জন মত। কাওকে ওরা বাঁচাতে পারলো না।  


কর্কশ গলায় লোকটি শুরু করলো, “ কেও তোদের বাঁচাতে পারলো না, আমি কিন্তু তোদের সব্বাই কে বাঁচিয়ে রাখবো বলেছিলাম। পেপারে সব্বার পোড়া ছবি দেখে সব্বাইকে আমার ক্যানভাসে ফোটালাম। অনেকটা সময় লেগে গেল খারাপের মধ্যে ভাল ছবি ফুটিয়ে তুলতে। ঐ অভিশপ্ত রাতের পর থেকে তোদের কে আমি আমার মত করে রাখলাম।
কথা দিয়েছিলাম, যারা তোদের ছবি দেখবে, যাকে তোদের পছন্দ হবে আর যারা তোদের পছন্দ করবে, তার কাছে চলে যাবি। যতদিন ইছে, যতক্ষণ ইছে তাদের চেহারায় নিজেদের দেখতে পাবি। কেও তোদের আটকাবে না। আমার গোপন গুরুবিদ্যা আজ না হলে কবে কাজে লাগবে আর...
তোরা বাঁচবি। তোরা বাঁচবি, তোরা আমার কাছে বাঁচবি... আমার ছবি হয়ে... হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ হাঁ... “


কান ফাটানো শব্দতে চোখ বুজে এসেছে আমার।
পরেই চোখ খোলা মাত্র দেখলাম, সেই গ্যালারী। সামনে কিছু নেই, ঠিক আগের মতই।
না, ঐ মেয়েটিকে চোখে পড়ছে না।

আর একটা মুহূর্তও নয়। এক ছুটে গ্যালারী থেকে বেড়িয়ে ট্যাক্সি ধরলাম।
মাথায় ভাবনা গুলো গিজগিজ করছে।

চারু আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু কাল আমি যাকে দেখেছি, সেটা এই ক্যানভাসের যুবতী। অর্থাৎ কাল আমার ঘরে আসার আগে চারু এখানে এসেছিলো। কাজ করতে করতে ক্যানভাসের দিকে চোখ যায়, আর পছন্দ হয়ে যায় সেই যুবতীর। তারই অলক্ষ্যে সেই মুখ চারুর মুখে বসে যায়।
এই একী ব্যাপার ঘটে স্নেহার বাবার ক্ষেত্রেও। অফিস ফেরত পথে একবার নতুন গ্যালারীতে আসে আর যেটা ঘটার সেটাই ঘটে।
শরীর নিজের, আত্মা নিজের, অথচ মুখটা অন্যের। আইডেনটিটি ক্রাইসিস ঘটে মুহূর্তের মধ্যে, অজান্তেই।
আর ঠিক তক্ষণই ওদের মধ্যে বিষাদ পেয়ে বসে। নিজেদের কে শেষ করে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় আছে নাকি।

তপতী সান্যাল বলে যাকে আমি কাল দেখলাম। সে তো মৃত। তাহলে কাল যাকে দেখলাম ? মৃত শরীরে তার বাবার ছায়া।

চিন্তায় চিন্তায় কতটা সময় রাস্তায় কাটল জানিনা। ফ্ল্যাটের নিচে পৌঁছে নিজের ঘরে ঢোকার আগেই স্নেহার ঘরে তাকালাম।
ওরা ফিরে এসেছে, বাইরে জুতো।

“ ক্রিং ক্রিং “
বেল বাজাতেই হন্তদন্ত হয়ে স্নেহা বেড়িয়ে এলো। আমারই জন্য অপেক্ষা করছিল সেটা আর বুঝতে অসুবিধে হলনা।
“ আমি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি স্নেহা, তোমার বাবা... “
“ কে আপনি ? “, স্নেহার মুখে প্রথম প্রশ্ন।
একি অদ্ভুত প্রশ্ন করছে ও। একটু আগেও তো আমায়...

 


গ্যালারির সেই ছোকরার ছবির ক্যানভাসটা কালো হয়ে গেছে।
 



 



 
  

   





Comments