মুভি রিভিউ
“ কথানদী “
ভাষা – অসমীয়া
আই এম ডি বি – ৭.৬
পুরস্কার - Asian Cinema Fund’s Post
Production Fund Award for 2015
কতদিন পর এমন সিনেমা দেখলাম তা বলতে পারবো না, তবে যা দেখলাম তা এর আগে এভাবে দেখেছি কিনা,মনে পড়ছে না। রিভিউ লিখতে বসে এর আগে এতটা ভাবনা চিন্তা করতে হয়নি, যতটা এখন উপলব্ধি করছি এই মুহূর্তে।
আর পাঁচটা ভুলভাল কমার্শিয়াল মুভির থেকে হাজার গুনে ভাল এই সিনেমা, একবার পক্ষে অন্তত দেখার জন্য বলছি।
পুরো গল্প কোনভাবেই প্রকাশ্য না করে শুরু করছি “ কথানদী “ এর বিশ্লেষণ।
নদী কথা কইতে পারে ? পারে না। কিন্তু একটা নদীকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করে। সেই সমস্ত মানুদের কাহিনী নিয়েই এই সিনেমার মূল বিষয়বস্তু।
ব্রম্ভপুত্র নদের পাড় ধরে আসামের চারটি পুরা ও কথিত কাহিনী সময়ের র সাথে সাথে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
চারটি গল্পেই মা অর্থাৎ জননী বিভিন্ন রূপে দেখা দিয়েছে। কেও বা দুখী, কেও বা লোভী, কেউ বা পবিত্র পাপী আবার কেও বা অসম্ভব রাগী।
প্রথম দুটি গল্প ব্যাখ্যা করতে হলে ষড়রিপুর দুটি রিপুর সাহায্য নিতে হবে আমাকে।
প্রথম গল্প মোহ কেন্দ্রীভূত। মা তার মেয়েকে খুব ছোট্ট বয়সে বিয়ে দেবেন, বর খুঁজতে স্বামীকে পাঠালেন জঙ্গলে। জঙ্গলে বর খুঁজতে ? হ্যাঁ, বর তো কোনও মানুষ না, সে একটা বড় অজগর সাপ। নিয়ম হোল, বিয়ের রাতে মেয়ে আর সেই স্বামী তথা অজগর একসাথে থাকবে। কথিত আছে, রাত্রি শেষে সেই অজগর চলে যাবে, আর রেখে যাবে হাজার হাজার স্বর্ণালঙ্কার। যার মালকিন হবেন সেই বালিকা নববধূ।
জাঁকজমক করে বিয়ে হোল সেই মেয়ের। অজগর এর খাঁচা খুলে দিল, মেয়েটা বিছানায় বসে আছে। ঘরের দরজা বন্ধ করে মা শুয়ে পড়ল বাইরেই। তারপর ?
দ্বিতীয় গল্প ক্রোধ কে কেন্দ্র করে তৈরি।
মা মড়া মেয়ে তেজিমলা। সৎ মা কে পেয়ে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। বাবা কর্মসূত্রে বাইরে যাবার পর তেজিমলা এর স্বপ্ন চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে যায়। সে যে নিজের মা নয়, তা সবসময় বুঝিয়ে দেয় অত্যাচারের মাধ্যমে।
সেই সৎ মা রোজ রাতে সবার অলক্ষ্যে জল পারাপার করে, আর দেখা করে কোনও এক কালো কুচকুচে পুরুষের সাথে, যার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সেকি আদতে কোনও পুরুষ নাকি শয়তানের আর এক রূপ ?এমন অবস্থায় তেজিমলার পরিণতি কি হবে ?
তৃতীয় গল্প কোনও এক রাতের কথা।
বনের মধ্যে মাটি কুপাছে এক পুরুষ। মাটি কুপানোর কারণ, নিজের সন্তান কে সেখানে পুঁতে দিয়ে আসবে। সেই সদ্যজাত সন্তান কিন্তু মৃত নয়, সে জীবন্ত, ক্রন্দনরত।
চারিদিকে বিকট ধরণের আওয়াজ, কেও বা কারা কাঁদছে, কেও হাসছে। যেন সেই সন্তান কে ভোজনের আনন্দে মহরা করছে। এভাবেই সে নিজের তিন সদ্যজাত সন্তানদের জীবন্ত পুঁতে দিল মাটির ভেতরে। কিন্তু কেন ? কি দোষ সেই সন্তান গুলোর ? যারা জন্ম নিল এই সবে মাত্র, তাদের আবার কিসের দোষ লাগে ? সন্তান হারা মা কি কেনই বা তার স্বামীকে সন্তান টি জন্মের পর দিয়ে দিছে ? আসলে এর পেছনে রহস্যটা কি ?
চতুর্থ গল্প আর একটি মা এর।
সন্তান প্রসব করার পর ঘর ছাড়া হয়। কারণ সে প্রসব করেছিল যাকে, সে কোনও সন্তান নয়, সেটা একটি ফল। দেখতে অনেকটা চালতার মত, যাকে স্থানীয় ভাষায় এলিফেনট আপেল বলে।
মেয়েমানুষের শরীর থেকে মানুষ ছাড়া এসব জন্মায় নাকি ? তাহলে এই মেয়েটি ডাইনি।
এই অপবাদে সে ঘর ছাড়া হয়।
ঘর ছেড়ে চলে আসার সময় দেখে সেই ফলটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিজে থেকেই তার সাথে সাথে আসছে। একই ভয়ানক ব্যাপার রে। মা হয়েও সে ভয় পেয়ে যায়, বুঝে উঠতে পারেনা এটা সম্ভব হয় কি করে? নিজে থেকে তার প্রসব করা ফল গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে? কখনও কাছ ছাড়া করছে না ? যেখানেই যাছে, সেও পিছুপিছু আসছে।
ইতিমধ্যে কোনও একভাবে তার সাথে আলাপ হয় তেজিমলা এর বাবার, যে কর্মসূত্রে বেরিয়েছিল। উনি বলেন, এটা কোনও ফল নয়, এটা তোমারি সন্তান। সে এই ফলের মধ্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু কেন ? কীভাবে সে তার সন্তান কে পাবে কাছে ?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখানেই আছে।
চারটি গল্প নিজের গতি অনুযায়ী সমান্তরালে বয়ে গেছে,একে অপরকে ছাপিয়ে।
অভিনয়ের দিক থেকে সব্বাই খুব ভাল, প্রচণ্ড স্বাভাবিক। কাহিনীর জালের বুনন অতি মাত্রায় ভাল, দর্শক কে কীভাবে উত্তেজিত করতে হয়, বা ভয় পাইয়ে চোখ বন্ধ করে দিতে হয়, সেটা না দেখলে অবিশ্বাস্য।
সিনেমা যখন ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট এ, চারটি কাহিনী এমন একটা জায়গায় দাড় করিয়ে দেবে, যার পরবর্তী মুহূর্ত গুলো শুধু ঘন ঘন নিঃশ্বাস বেরোবে। চারদিকের বান যখন একটা একটা করে বের হবে, উত্তেজনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সিনেমা দেখাটাই আসল কাজ হয়ে দাঁড়াবে।
Comments
Post a Comment