“” সংগ্রহ “”

 






 

প্রেক্ষাপট -  ভয়, ভয়ঙ্কর


চৌরঙ্গীর মোড় থেকে গাড়ি ধরলাম যখন, বেলা গড়িয়ে বিকেল
, ৪টা বেজে ৩০মিনিট। মিউজিয়ামের শিফট শেষ করতে করতে রোজ এমনটাই বেজে যায় প্রায়। তবে এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি আজ ফিরব না। এখন যাবো কুশল সেনাপতির বাড়ি। যাওয়ার কারণটাই আজকে বলছি, একান্ত ব্যাক্তিগত যদিও।
দাঁড়ান, বাসটা ধরে নি। একটা বসার জায়গা পেলেই কথা বলা যাবে।


মিউজিয়ামে কাজ বলতে সব কিছুর দেখা শোনা করা, নতুন জিনিসকে লিস্টিং, স্থান নির্বাচন, তার ইতিহাস আর ইত্যাদি কিছু ডেটাবেস এ সঞ্চয় করে রাখা , মূলত এটাই কাজ। আর তাছাড়া বাইরে টুকটাক কাজ করি, সে নিয়ে পড়ে বলবো।
মিউজিয়ামের কাজ করতে করতে নিজের ভেতর একটা খিদে তৈরি কবে হয়েছে তা বলতে পারবো না। কোথাও কোনও আশ্চর্য জিনিস দেখলে সংগ্রহ করে ফেলি। দিন কে দিন এটা আমার একটা নেশা হয়েই গেছে।
বেড়ালের ভেঙ্গে যাওয়া দাঁত হোক অথবা চন্দ্রবোড়া সাপের চাকাচাকা খোলস, যেটাই পাই মোটামুটি সংরক্ষণের নিয়ম মেনে সেটা নিজের ঘরে রেখে দি। ছোট্ট একটা সংগ্রহশালা আমিও তৈরি করেছি। আজও যাচি সেই সংগ্রহের জন্য।
একটা ফ্ল্যাটে থাকি, একা । বিয়ে এখনও করা হয়নি, আদেও হবে কিনা সন্দেহ। ওদিকে আমার তেমন ঝোঁক নেই।

বর্তমানে সংগ্রহশালা তার আয়তন বাড়িয়েছে, তাই পাশের ফাঁকা স্টুডিও এর মত অংশটা কিনে ফেলি। এখন ওটাই আমার জগত, ওটাই আমার সব কিছু। কাজ শেষে বাকি সময়টা ওখানেই কাটাই দরজা বন্ধ করে।

গতকাল রোববার ছিল। নিউজ পেপার নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ে। জনৈক কোনও এক ব্যাক্তির শখের একটি সংগ্রহশালা আছে। উনি সেখান থেকে দুষ্প্রাপ্য জিনিস বিক্রি  করে দিতে চান। নিচে ফোন নম্বরে কল করে নিলাম সময় নষ্ট না করে। এমন সুযোগ সবসময় তো আসে না। ওখানে যেতেই হবে আমাকে, যদি কিছু পাওয়া যায়।
আজ অর্থাৎ সোমবার, উনি আমায় ঠিক ৫টা ৩০এ সময় দিয়েছেন, দেখা করে কথা বলার জন্য।
অফার লুফে নিলাম সঙ্গে সঙ্গেই। টাকা পয়সা বিশেষ কিছু নিলাম না আপাতত, দেখাই যাক না ওনার কাছে কি আছে এমন।

                                    *                                        *                                         

“ আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো তারা বাবু “


মোড়ে নেমে জোড়া পেট্রোল পাম্পের গলি ধরে সোজা হেঁটে বামদিকের শেষ বাড়িটায় চলে গেলাম। বাইরে দেখলাম নাম, “ সেনাপতি ভবন “। কলিং বেল টিপতেই কিছু সময় পড়ে একজন আধা বয়স্ক লোক বেড়িয়ে এসে আমায় জিজ্ঞেস করলো এই কথা।


আমি হেসে বললাম, “একদমই না, আপনি কুশল বাবুর খাস লোক না ? “
“ হ্যাঁ, দাদাবাবু “
“ উনি আমাকে ফোনে তেমনটাই বলেছিলেন। “

আধা বয়স্ক লোকটি বেশ হাসিগদগদে মুখ নিয়ে পিছনে ফিরলেন। ওনার চেহারাটা একটু অদ্ভুত। মুখ দেখে বয়সের ছাপ স্পট মনে হলেও শরীর কিন্তু বিপরীত কথা বলছে। চামড়া শুষ্ক হলেও, শরীরের গঠন মোটের ওপর ঠিকঠাক, গোছানো। তবে কিছুর একটা অভাব আছে। সেটা ধরতে পারলাম না।
উনি ওপরের দিকে ওঠা শুরু করতে, আমিও পিছু নিলাম।

বাড়িটা একটু কটেজ এর মত দেখতে। শহরতলিতে এমন একটা ধাঁচের বাড়ি পাবো, সেটা আশা করা অন্যায়, তাই দেখে বেশ ভাল লেগেছিল। মেইন রোড থেকে অনেকটা ভেতর গলিপথে, তাই রাস্তার ধুলোবালির প্রকোপ কম। বাইরের দেওয়ালে জেল্লা আজও বেশ তাজা।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে দেখলাম মাঝারী আকারের একটা ডাইনিং হল। দেওয়ালগুলো ঘিয়ে রঙ করা, প্রচণ্ড পরিষ্কার পরিছন্ন। সারা দেওয়ালে বা তার পাশে কোনও আলমারি বা তেমন কিছু চোখে পড়ছে না।
সমস্ত দেওয়াল জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ার।
জন্তু জানোয়ার বলতে আসলে তাদের মাথা, বসানো রয়েছে দেওয়ালের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে, ঠিক ফটো ফ্রেমের মত।
কোনটা বন্য হরিণ, কোনটা আবার শিয়াল, এটা সম্ভবত চমরী গাই। একটা ছাগলের গলাও সাঁটানো দেখছি।
ঠিক তার পাশে চিতা বাঘের দুটো মাথা পাশাপাশি বসানো। তবে একটা ব্যাপার, মাথা গুলো ঠিক স্বাভাবিক নয়। এমনটা মনে হবার কারন জানা নেই যদিও।
যেদিকে তাকানো যায়, দু পেয়ে প্রাণী এক নজরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে না পর্যবেক্ষণ করছে কে জানে। ঘরের মাঝখানে আমি দাড়িয়ে, অসহায়ের মত। অনুভূতিটা একটু নতুন এবং বেশ। ঝোলানো মুণ্ডুর দল জ্যান্ত হয়ে আমার দিকে তেরে এলেই হয়েছে, প্রাণ নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হবে না। মনে মনে হাসছি আমি।

একটা ব্যাপার খটকা লাগছে, ইনি কি শিকার-টিকার করেন নাকি ? অথবা বনে বাদারে ঘোরার অভ্যাস আছে ? নয়তো এমন সংগ্রহ যার তার কাছে তো থাকবে না, যদি না উনি চড়া দামে কিনে থাকেন। 
দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম আর অবাক হছিলাম। মনে মনে এক প্রকার কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা সরু অথচ তীক্ষ্ণ গলার স্বর কানের মধ্যে ধাক্কা দিলো।
“ কেমন লাগছে ? “  

চমকে একটু গিয়েছিলাম, আসলে সংগ্রহ গুলো দেখে একটু বিভোর হয়ে পড়েছিলাম আর কি।
“ হ্যাঁ, দারুণ লাগছে। সত্যি আপনার কালেকশন এর জবাব নেই।“
কথটা বলতে বলতে আমি কুশল বাবুর দিকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম।

বয়স আন্দাজ ৬৫ পেরিয়ে গেছে বছর খানেক আগেই। চামড়া গুটিয়ে এসেছে অল্প অল্প, মাথার চুল কাঁচা পাকা মেশানো। অল্প একটু ভুঁড়ি উকি দিয়েছে, পড়নে সাদা ফতুয়া। ইনি আর যাইহোক শিকারি মানুষ নন, উহু আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু সেটাই বলছে।

“ বঙ্কুর সাথে পরিচয় হয়েছে আশা করি ? ও পাশের ঘরে গিয়ে বলল আপনি এসেছেন। আমিও সেই বিকেল থেকেই অপেক্ষা করছি। যাইহোক, আগে একটু অল্প করে জলখাবার সেরে নিন । তারপর কাজের কথা বলা যাবে না হয়। ও হ্যাঁ, তোমাকে আমি তুমি করেই বলছি, বয়সে অনেকটাই ছোট তাই।“

“ হ্যাঁ, একদম ঠিক আছে। আপনি আমার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়। কিন্তু আপনার একটা অনুরোধ আমি রাখতে পারবো না। “
“ কোন অনুরোধ ? “
“ জলখাবার এর ব্যাপারটা আজ থাক। আসলে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সারাদিনের পর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে একটু স্বস্তি পাই।“
“ সারাদিনের পর খিদেও তো পায়, তাই না ?”, কোমল অথচ সুন্দর ভাবে বললেন কুশল বাবু। কথাটার মধ্যে সত্যিকারের স্নেহ লুকিয়ে ছিল, অস্বীকার করা যায় না।  
সত্যি কথা বলতে, পেট একটু চুচু করছিল, তাই আর বেশী কথা বাড়ালাম না।

প্লেট ভর্তি দুটো সিঙ্গারা, দুটো রসগোল্লা, সঙ্গে একটা নিমকি। টাটকা তাজা ভাজার গন্ধ পাছি।
আর তার আগে অল্প করে একটু লিকার চা।
কতদিন বাদে এমন একটা টিফিন পাছি, সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে এমন টিফিন ছোটবেলায় বাবা খাওয়াত, তাও প্রতি রোববার।
সকাল ৮ টায় বাজার করতে যেতাম বাবার সাথে, আসার পথে সীধু কাকুর মিষ্টির দোকান থেকে কখনও কচুরি জিলেপি, কখনও সিঙ্গারা মিষ্টি।



“ এমন শখ আপনার কবে থেকে হোল যদি একটু বলেন “, চা খেতে খেতে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম।
“ ঠিক বলতে পারবো না জানো তো। যে প্রাণী গুলোর প্রতি একটু মায়া জন্মে যায়, তাদের চোখে হারাতে চাই না। তাই নিজের কাছে রেখে দি। “
“ ওপরে আসা থেকেই ফরমালিন এর গন্ধ পেয়েছি, তবে একটু উগ্র রকমের। স্তাফিংটা কি আপনি নিজেই করেন ? ”
 “ কেন ? কোনও সন্দেহ আছে নাকি ?”, ভদ্রলোক একটু মজার স্বরেই বললেন।
“ মাপ করবেন। আসলে আপনার চেহারা দেখে সেটা বোঝা একটু মুশকিল। কিছু মনে করবেন না। “

“ জীবজন্তুদের সংরক্ষণের বেসিক টেকনিক হোল ট্যাক্সডারমি। এটা নিয়ে আমি ছোটবেলা থেকেই একটু বেশী আগ্রহী ছিলাম।
প্রাণী মারা যাবার পর ভেতরের সমস্ত কিছু বার করে নিয়ে পুরো খোলসটা সম্পূর্ণ ভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। এর জন্য সরাসরি সূর্যের আলো ব্যবহার করা যায়, তবে বেশিক্ষণের জন্য না, কারন এতে ত্বকের কোমলতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাকি সময়টা গরম কিছুর সংস্পর্শে এনে রাখতে হয়, যতক্ষণ না চামড়া লেয়ার এর মত কিছু তৈরি না হয়। “

“ বাহ, আপনি সত্যি জানেন দেখছি। “, মুগ্ধ হয়ে বললাম।

“ হ্যাঁ, না জানলে এই স্থানটা এমন ভাবে ঘর সাজাতাম কি করে ? আছা স্তাফিং এ মূলত কি ব্যবহার করা উচিত ?”

আমি বললাম, “ আমরা কিন্তু মোটামুটি গজ কাপড় ব্যবহার করি, আর মাঝে মধ্যে কার্পাস তুলো মিশিয়ে ঢুকিয়ে দিয়। “
“ বাহ বাহ ! তবে আমি কিন্তু পাতলা সুতির কাপড় ব্যবহার করি। সেটাও সাদা। ফরমালিন এ চুবিয়ে নিয়ে বাকি কাজ শুরু করতে হয়। তোমরাও একবার চেষ্টা করে দেখো। ব্যাপারটা খরচ সাশ্রয়ী আর কি “

“ আছা, দেখবো না হয় আপনার কথা মত। “, শেষ মিষ্টিটা গালে দিয়ে দিলাম।

হাতটা ধুতে হবে, মিষ্টির রস একটু হাতে লেগেছে।  ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে ধোয়ার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন।
রান্নাঘরের দিকে যেতে বেসিনটা পড়ে ডানদিকের দেওয়ালে।
নজরে পড়ল সমস্ত ঘরটার এদিকের অংশ। বেশ গোছানো, ময়লার বিন্দুমাত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল মনে হয়।
হাতে জল দেওয়ার সময় সবকিছু নজর করছিলাম। ঠিক তখন চোখে পড়ল, ঐ বয়স্ক লোকটা দাড়িয়ে আছে ঐ দিকে। কেমন ফ্যাঁকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিছু বলতে চান, কিন্তু সেটা আমাকে না ওনার বাবু কে ? বুঝতে পারলাম না সত্যি কথা বলতে।
পকেট থেকে রুমাল বার করে হাত মুছে নিয়ে এগিয়ে এলাম কুশল বাবুর কাছে।
লোকটার ব্যাপারটা তখন মেরে দিয়েছি ভুলে।



“ তাহলে এবার যাওয়া যাক সেই ঘরে, যেটার জন্য আমার আসা এখানে। আপনি কি সেই জিনিসটা সত্যি বিক্রি করতে চান ? “ , এক বাক্যে সবকথা গুলো বললাম।
তেমন কোনও উত্তর উনি দিলেন না। বরং একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালেন, নিজের হাত ঘড়ি লক্ষ্য করলেন। ৬টা বেজে গেছে। মনে মনে কিছু একটা ভাবলেন কিছু মুহূর্তের জন্য, সেটা আমাকে হয়তো বুঝতে দেননি।
পেছনের ঐ খাস লোকটা, কি যেন নাম বঙ্কু কে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন চাবিটা নিয়ে আসতে।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর সোজা দিয়ে একবারে কোনের ঘরটা চোখে না পড়ারই কথা। ঘরটাতে মনে হয় আলো বাতাস তেমন একটা ঢোকে না। সংগ্রহশালা হিসেবে এটা অবশ্য যথাযথ। যতটা একা রাখা যায় ঘর, আলোবাতাস কম ঢুকবে, ততই ভাল থাকবে জিনিস পত্র।

চাবিটা খুলতে একটু সময় লাগলো বঙ্কুর। বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগেছিল ঐ চাবি নিয়ে। তার মানে এই ঘরটা সচরাচর খোলা হয়না, সেটা যে কারণেই হোক না কেন।
খাস লোকটি দরজা খুলতেই ফরমালিন আর বদ্ধ বাতাসের মিশ্রিত এক প্রকার মিঠে গন্ধ ছিটকে বেড়িয়ে এসেছে। মাথাটা বেশ ঝিমুঝিমু করছিলো। আমার ঘরেও তো একটা বন্ধ ঘর আছে, যেখানে আমার সমস্ত জমানো জিনিস সঞ্চিত আছে। নাহ, সেখান থেকে তো এতটা খারাপ গন্ধ আসে না।

কুশল বাবু ঢুকলেন আগে, আর পিছনে আমি।
দরজার কোনে খাস লোকটি দাড়িয়ে, আমাদের অপেক্ষায়। আমরা ঢুকলে যেন ওনার কাজ শেষ।   

ঘরটার বর্ণনা একটু না করলেই নয়।
প্রথমত কি বর্ণনা করবো  ? ঘরে তো কিছুই নেই। কিছুই নেই মানে যেটা বোঝায়, এটা তার থেকে আলাদা নয়। সিলিং এ একটা পাখা, দরজার ঠিক বাম দিকে একটা ইলেকট্রিক বোর্ড, গোটা কয়েক টিকটক সুইচ। মেঝে একটা সিঙ্গেল পাথর বসানো। সম্ভবত অনিক্স, খুব শাইন করছে। চোখ যতদূর গেল, ঐ দিকে একটা বেসিন , লাগোয়া দুই একটা কিছু হাত মোছার কাপড়। আর কিছু না। যতটা আছে ব্যাস এটাই। ওপরের অংশে একটা ঘুলঘুলি পর্যন্ত নেই, কি সাঙ্ঘাতিক। বুকটা একটু দুরু দুরু করে উঠলো, সত্যি । ঘুরে দাঁড়াতে যাবো, দরজার ডান পাশে চোখ পড়ল আর একটা জিনিস, একটা ফটোফ্রেম। একটা রঙিন ছবি, একটি ছেলের। কিন্তু একে কোথায় যেন দেখেছি, খুব চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না।

“ এ আমার একমাত্র ছেলে “
কৌতূহলবশত আমার মুখ চোখের ভাব পরিবর্তন কুশল বাবুর চোখ এড়িয়ে যায়নি, আমার জিজ্ঞেস করার আগেই তাই উনি বললেন।
ঘরের মধ্যে একটু এগিয়ে গেলেন, পেছনে দুই হাত একে ওপরের ওপর বেষ্টনী করে রেখে, তারপর শুরু করলেন।

“ জন্মের পর থেকেই মা কাকে বলে, ও জানত না। মা এর স্নেহ, মমতা, আদর কোনটাই পায়নি। আমিও তাই কখনও ওকে বোকাঝকা করিনি। যেটা চাইত, সেটাই ওর হয়ে করে দিতাম, কোনও কিছুর অভাব বুঝতে দিয়নি। কিন্তু এখন আমার বয়স হয়েছে। হাটা চলা আমার পক্ষে করা সম্ভব হছে না আর। তাই ভাবলাম , কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। “

কথাগুলো ঠিক কোন ট্রাকে যাছে বুঝতে পারিনি। আমার আসার কারণটা আমি জানি, আর উনি হঠাৎ গল্প জুড়ে বসেছেন, কাজের জিনিস না দেখিয়ে। বয়স্ক মানুষ, কিছু বলতেও পারিনা মুখের ওপর। তাই একটু বুঝেই বললাম, “ আপনার ছেলে কোথায় ?”

“ আমার ছেলে ? ঐ যে দাড়িয়ে আছে “ , বলে হাত বাড়িয়ে দেখালেন দরজার দিকে।
কিন্তু ওখানে তো ? বঙ্কু না  ?
চমকে উঠলাম দেখে। যাকে এতক্ষণ খাস লোক বলে পরিচয় পেয়েছিলাম, ইনি কুশল বাবুর ছেলে ?
এটা কি করে সম্ভব ? সে জন্যই মুখটা চেনা ঠেকছে।
একি চেহারা হয়েছে ওনার ? বয়সটা যেন ওনার বাবার থেকেও বেশী, চেহারা একদম রুগ্ন, কাজের লোক মার্কা। মুখ চোখ যেন না খেয়ে শুকিয়ে গেছে। ঢোকার সময়ই ওকে দেখেছিলাম, কিছু একটা বেমানান আছে, যেটা ধরতে পারছিলাম না।   
কিছুটা আঁটকে উঠেই আমি বললাম, “ ইনি আপনার ছেলে ? কিন্তু এমন অবস্থা হোল কি করে ? “

“ সেটাই তো সমস্যার কথা। ছোট বেলায় মা কে পায়নি, মা এর দুধ কি হয় ও জানেনা। গরুর দুধ এনে খাওয়াতাম ওকে, খেতে পারতোনা। ডাক্তারের কথা মত গুড়ো দুধ জাতীয় জিনিস গুলো খায়তে চেষ্টা করেছিলাম, ফল হয়নি। শুধুই কাঁদত, কিছু খাওয়াতে পারতাম না। পাগল হয়ে গেছিলাম ওর কান্না শুনতে শুনতে, কি করবো কীভাবে ওকে চুপ করাবো ?

মাঝে মধ্যে মনে হতো আমার ভাল বৌ টাকে খেলো জন্ম হওয়ার সাথে সাথে। এবার আমাকে খেতে এসেছে। শান্তি নেই শালা।
একদিন মাথায় খুন চেপে গেছিল, মনে হছিল মেরেই ফেলি এই বাছাটাকে। আমার সব কিছু শেষ করে দিয়েছে, জীবনটাকে ধুলিস্যাত করে ফেলল একেবারে। সেকি চিৎকার ! আজ এর শেষ দেখেই ছাড়ব আমি, যা হয় হবে। খেয়ে ফেল আমাকে, মেরে ফেল খেয়ে।
আমাকে খাবি ? খা খা !
আমার রক্ত খা ! খেয়ে আমায় মেরে ফেল। বলেই বুড়ো আঙ্গুল কেটে ওর মুখে ঢুকিয়ে দিলাম জোর করে ঠেসে। “


আমি চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। মনে মনে ব্যাপারটা চোখের সামনে ভাসছে, শিউরে উঠছে গা। এমনটা কোনও বাবা করেন নাকি, বীভৎস ব্যাপার ।

কুশল বাবু কথা থামাননি , “ ছেলেটা একদম চুপ করে গেল জানেন ? চুপ মানে সম্পূর্ণ। এই প্রথম এমন আশ্চর্য ঘটলো, যেখানে বাড়ি প্রথমবার একদম শান্ত হয়ে গেছে।
ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ সন্দেহজনক লাগলো।
কায়দা করে আঙ্গুলটা বার করে নিতেই ও আবার সেই তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। মন না চাওয়া সত্ত্বেও আঙ্গুলটা আবার ঢুকিয়ে দিতেই আবার কোলাহল বন্ধ।
মিনিটখানেক যেতে না যেতেই, ঘুমিয়ে পড়ল।
বোধহয় আমি ঠিক বুঝতে ভুল করেছিলাম।
ঘোর অমাবস্যায় জন্ম হওয়া ছেলে, ওর কি জন্ম লগ্নে কিছু দোষ আছে ? মনে মনে ভয় লাগলো।

একজন বিখ্যাত জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হলাম পরেরদিনই।
উনি বললেন এ ছেলে সাধারণ ছেলে না। কোটিতে এমন একটা জন্ম নেয়, তবে এই ছেলেকে রাখা খুব ভয়ঙ্কর। মানুষের খাবার এর মুখে রোচবে না, একমাত্র শয়তানের ভোগে তৃপ্ত হবে। ওকে রেখে যা বেটা ।“
“ তারপর ? “, আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে বললাম।
“ আমি কি ওর কাছে নিজের ছেলেকে রাখতে গেছি নাকি ? শয়তানের জাত সব্বাই। নিয়ে চলে এলাম ওকে। “

কুশল বাবু আবার শুরু করলেন , “ এর পর থেকে আজ প্রায় কুড়িটা বছর হতে চলল। ওকে নিয়ে আমি এই বাড়িতে একাই থাকি। এতদিন ধরে বাজার থেকে ফোন করিয়ে জিনিস আনাতাম। মোরগ বা মুরগি, কখনও গোটা ছাগল কখনও বা ভেড়ার মাংস। সন্দেহ যাতে না করে কেও, সে জন্য গোটা কিনে বাড়িতে আনিয়ে কাটাতাম। মাংস ফেলে দিতাম পাশের ভেড়ি তে, সেখানে এমনই মাছ চাষ তো চলেই। রক্তটা আলাদা করে ধরে রাখতাম, ওকে খাওয়াবো বলে। মাথাগুলো বাইরে সাজিয়ে রাখতাম, মাঝে মধ্যে ঐ বাঘ শিয়ালের প্লাস্টিক মাথাগুলো কিনে সাটিয়ে দিতাম।
বেশ কিছু সপ্তাহ হোল, বয়সের ভারে আর তেমন দৌড়াদৌড়ী করতে পারিনা।
তাই বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলাম, যদি কেও নিজে থেকে আসে, এই যেমন তুমি ।“

“ আমি কি ? বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন বিশেষ দুষ্প্রাপ্য জিনিস রয়েছে আপনার কাছে অনেক দিন ধরে, বিক্রি করতে চান। সেটার জন্যই তো আসা ।“

“ হ্যাঁ লিখেছিলাম। ওখানে একটা সত্য আছে, আর একটা মিথ্যে। সত্য হোল আমার ছেলে সত্যি দুষ্প্রাপ্য। ও কোটিতে একটা হয়। কিন্তু নিজের ছেলে কে কেও বিক্রি করতে চায়? “

কুশল বাবু বলেন কি ? এসব ? নিজের ছেলে দুষ্প্রাপ্য ? মাথায় কিছু ঢুকছেনা।

এরই সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে ভারহীন অনুভব করছি। আমার সাথে কিছু একটা ঘটতে শুরু করেছে, আমার অনুমতি ছাড়াই, কিন্তু সেটা কি ?
বাম কাঁধে খুব তীক্ষ্ণ ও তীব্র চাপ লাগছে। কিছু একটা আমাকে বিঁধছে, ঠিক সূচের মত কিছু।
গরম নিঃশ্বাস অনুভব করছি ঐ স্থানে, বুঝতে পারছি কেও দাঁত বসাছে আমার ডান কাঁধে। কেও টা কে সেটা আমি জানি, কিন্তু আমি কে সেটা ও এখনও বুঝতে পারেনি।
এতক্ষণে গরম রুধির ওর জিহ্বা তে পৌঁছে গরম তরলে মুখটা আঁশটে নোনা স্বাদে ভরে যাওয়ার কথা। প্রাণ ভরে তৃপ্ত হয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসার কথা, কিন্তু ও পারছে না সেটা করতে।

বাম কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে নিতেই ছেলেটি ছিটকে পড়েছে, একেই রুগ্ন চেহারা, শরীরে জোর তেমন নেই, দেখেই বোঝা যায়।
কুশল বাবু নিজের ছেলেকে পত করে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন, এমনটা এর আগে তো হয়নি। এই ব্যাপারটা ওনার ঠিক পছন্দ হলনা যদিও। রাগে অথবা ভয়ে লাল হয়ে গেছে ওনার মুখ, কি করবেন বুঝতে পারছেন না।

“ এবার আমার বলার পালা কুশল বাবু “, একটু বাজখাই গলায় বলাতে উনি চমকেই উঠলেন।
নিজের রূপটা পরিবর্তন করা মাত্র ওনাকে বললাম, “ চিনতে অসুবিধে হছে নাকি এবার ? ? “
ভুরু কুঁচকে হতবাক কুশল বাবু আমাকে দেখতে লাগলেন।
আমাকে বলতে সেই জ্যোতিষীকে দেখতে লাগলেন, তারাপদ জ্যোতিষী, যাকে বছর কুড়ি আগে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল নিজের ছেলেকে।

মুখ দেখে বুঝলাম কুশলবাবু ঘাবড়ে গেছেন। কি বলবেন স্থির করতে পারছেন না। এতদিন পরেও আমি অর্থাৎ তারাপদ জ্যোতিষী তার পিছু ছাড়েনি ?

আসল বেশভুষায় আসার পর নিজেকে একটু ঠিকঠাক লাগছে, শরীরে রক্ত স্রোত প্রবল। আজও আমি জ্যোতিষীচর্চা করি, মিউজিয়ামে কাজ করি তবে লোক দেখানো।


“ পঞ্চমুণ্ড আসনে বসে অঘোরী সাধনা করেছি আমি। নড়মুণ্ডের খুলিতে তাজা রুধির মুখে নিয়ে মৃত শবের ব্যবছেদ করে পিশাচদের লেলিয়েছি, ওদের বশ করে কাজ করিয়েছি। সাধনা কালে ওদের বশ করতে আমি নাছোড়বান্দা ছিলাম, যেভাবে হোক ওদের আমি কবজা করবই।
রাতের পর রাত শ্মশানে ঘুরে আধ পোড়া মৃতদেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে জোগাড় করেছি, আর পিশাচ গুলোর খিদে পেলে ওগুলো দিয়ে লোভ দেখিয়ে জাগিয়ে রেখেছি। হাড্ডি গুলো সময় মত জুড়ে ওদের মন্ত্রপূত করে রাখি, সময়ে কাজে লাগবে বলে। তন্ত্রসিধ্য কাপালিক আমি, আমার ক্ষতি করবে ঐ ছেলে ?

যেদিন থেকে ওকে দেখেছি, মনে মনে ওকে পাওয়ার লোভ জেঁকে বসেছিল।
ওর তিথিনক্ষত্র অনুযায়ী ও আনোখা, তোকে আমি সেদিনই বলেছিলাম, কিন্তু শুনলি নে। আমার কাছে দিয়ে গেলে তোর কি হতো  হ্যাঁ ?
জ্যান্ত মানুষ যদি আর একটা মানুষের রক্ত পান করে, সে সর্ব শক্তিমান হয়ে যায়। তাকে দিয়ে এমন অনেক কাজ করানো যায়, যেটা পিশাচ এরও বশে নেই।
তোর ছেলেকে সেদিন চাইলাম দিলিনে হারামজাদা, আজ আমি জোর করে নিয়ে চললাম।
আমার সংগ্রহে ওকে জাগিয়ে রাখবো সারাজীবন, আমার গোলাম করে রেখে দেবো।
আজ ঐ ঘর নতুন ভাবে পূর্ণতা পাবে, হা হা হা হা... আমার সংগ্রহ আবার জেগে উঠবে নতুন ভাবে... “ 

হ্যাঁ করে দাড়িয়ে রইলেন কুশল বাবু। কিছু বলার মত সাহস , ক্ষমতা কোনটাই নেই আর ওনার।

ছেলেটাকে মন্ত্রবলে অজ্ঞান করা মাত্র নেতিয়ে পড়ল।
বাম পিঠের ওপর শুইয়ে নিতে কষ্ট হোল না। যাওয়ার আগে বললাম, “ খুব দুষ্প্রাপ্য জিনিসই পেয়েছি। তার যোগ্য মূল্য চাস ?  এই নে তোর জীবন ভিক্ষা দিলাম, এটাই তোর যোগ্য মূল্য।
নয়তো চণ্ডা মুণ্ড মালিকার যজ্ঞে তোর ছেলের হাতেই তোর বলি দিতাম প্রথম... হা হা হা হা...“

কুশল বাবুর চোখের সামনে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেল দু দুটো শরীর, আস্তে আস্তে...
          




** সমাপ্ত “”

 




Comments