## শিশু হাসি নিকেতন ##

 

প্রেক্ষাপট – ভয় ভয়ঙ্কর অতিপ্রাকৃত
কলমে – সমীরণ সামন্ত






দেখতে দেখতে পুরো একটা মাস কি করে কেটে গেলো এখনও আমি ভুলতে পারছি না সেই ঘটনা কি করে ভুলবো, আমার অন্তু যে এভাবে সেদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে সারা জীবনের জন্য, বুঝতে পারিনি জানলে আমি সেদিন ওকে যেতে দিতাম না সেই অভিশপ্ত স্কুলে রাতে চোখের পাতা এক করলেই ভেসে ওঠে, অন্তুর মুখটা

তোমরা আমাকে পাগল ভেবো না। আমার অবস্থা এখন এরকমই হয়ে গেছে, জীবনটা নিয়ে চলব কি করে জানিনা।

আমি রিনি, গল্প বই পড়ার পোকা, বিশেষত অশরীরী নিয়ে ইন্টারেস্ট বেশী
ভূতের গল্প পড়ার থেকে, অতিপ্রাকৃত ঘটনা সম্পর্কে জানতে বেশী পছন্দ করি। আমাদের বিয়েটা দেখাশোনা করেই হয়েছে, যখন জানতে পারলাম আমাদের দুজনের পছন্দটা একদম একই, সম্পর্কটা আর হাতছাড়া করতে মন চায়নি।

বিয়ের মাস খানেক পর থেকেই আমরা মোটামুটি একটা প্ল্যান করেই বের হতে শুরু করলাম কোলকাতার কিছু অভিশপ্ত স্থান গুলোতে সময় কাটানোর, যদি কিছু দেখা যায় বা পাওয়া যায়।
হাওড়ার ফুল মার্কেট থেকে শুরু করে হেস্তিংস হাউস, রেসকোর্টের মাঠ টুকটাক মোটামুটি সব স্থান ঘাটা হয়ে গেছে। কোথাও পেয়েছি মুহূর্তের কিছু ভিসুয়াল ফুটেজ, কোথাও চাপা হাসির শব্দ না কোনও জায়গাই আসলে হতাশ করেনি আমাদের

অন্তুর এক্সপোর্ট এর নিজস্ব ব্যবসা অনেক আগে থেকেই। এই দিক থেকে ও দারুণ সফল।  আর আমি দক্ষিণ কোলকাতার বিখ্যাত একটি প্রাইভেট নার্সিংহোমের রিসেপ্সনের তত্ত্বাবধানে থাকি, সকাল ১০ থেকে সন্ধে ৭টা
 
ই এম বাইপাস দিয়ে আসতে হলে সাইন্স সিটির ২টো স্টপেজ পরে পঞ্চান্নগ্রাম, সেখান থেকে হাটা পথে তিলজলাবিয়ের পর এখানে তল্পিতল্পা গুছিয়ে এখানে চলে এলাম আমি।
 

পথে একটা ছোট্ট প্রাইমারী স্কুল পড়ে, “ শিশু হাসি নিকেতন



বিঘা খানেক জায়গা নিয়ে ছোট্ট এই স্কুলটি গত দশ বছর ধরে বন্ধ পড়ে আছে চৌকো শেপ এর বিল্ডিংবাড়ি, একদিকটা খোলা মুখ, যেখানে দাড়িয়ে পুরো স্কুলটা এক নজরে দেখা যায়
স্কুলটা সম্পর্কে কিছু ঘটনা মুখে মুখে রটে গেছে।

বছর দশেক আগের কথা।
তিনটি ছোট্ট মেয়ে
,তিনতলা স্কুলের ছাদ থেকে পড়ে মারা যায় কারন কেও জানেনা। ব্যাপারটা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনই কষ্টকর। ফুটফুটে তিনটি মেয়ে, বাইরের জগত দেখার আগেই চলে গেল ঐ জগতে।
যেমন হয় হোল, পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলল, কিন্তু ফল কিছু বের হয়নি।
এদিকে কিছু দিন পর স্কুল শুরু হয় ঠিকই
, কিন্তু সেই সাথে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে প্রচণ্ড ভাবে ভীত হয়ে যায় স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা অভিভাবকরা নিজেদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে যখন নারাজ, কমিটি স্কুলটি পরিত্যাক্ত হিসেবে ঘোষণা করে


আমার অফিস থেকে ফিরতে গেলে স্কুলটা রাস্তাতেই পড়ে বেশ কবার সামনে থেকে দাড়িয়ে দেখেছি, কেমন একটা অদ্ভুত শিহরন লাগত।অস্বস্তি হতো ভেতর থেকে, যেটা এর আগে তেমন টের পাইনি। একদিন ফিরতে ফিরতে দাড়িয়ে পড়েছিলাম।
এই দশ বছরেই
স্কুল বিল্ডিঙের খোসা ছাড়িয়ে ইটের পাঁজর দেখা যাছে, টর্চের আলোয়
ছাদটা সম্পূর্ণ ন্যাড়া। একদম বামদিকে একটা বড় ট্যাঙ্ক রাখা, পাইপের মুখ আধা ভেতরে আধা বাইরে, শূন্যে ঝুলছে তিনতলার রুমের প্রতিটা জানালাই খোলা, তাই আলো সোজা ঢুকে যাছে ক্লাসরুমের ভেতর
এভাবেই দেখতে দেখতে, ঠিক তখনই ঐ জানালায় কিছু একটা দেখলাম, এই জানালা থেকে ঐ জানালাতে সেকেন্ডের মধ্যে দৌড়ে ভানিস হয়ে গেল। দৌড়ে নাকি ভেসে ভেসে ? টর্চের আলো আঁটকে গেলো ঐ জানালার শেষ ভাগে।
কি...  কি... কি... একটা যেন দেখলাম ভেতরে ? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কি ছিল ওটা ?
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা রুধির গড়িয়ে পড়ছে ভেতর দিয়ে।
নাহ, আর দাঁড়ানো ঠিক হবে না। তবে ঘটনাটা অন্তুকে গিয়ে বলতেই হবে


                         *                                         *                                                   *


অন্তু এই স্থানে রয়েছে নিজের কিশোর বেলা থেকে
ঐ স্কুলটা সম্পর্কে ও খুব ভাল করেই জানত।কিন্তু তবুও আমাকে নিয়ে যাবার ব্যাপারে একটু পিছু পা হয়েছিল আসলে দিন কয়েক আগে আমার প্রেগ্নেন্সি পজিটিভ রিপোর্ট, ওর মনে যেমন দায়িত্ব জন্ম দিয়েছে, তেমনই এনেছে ভয়
অনেক জেদাজেদির পর অন্তু নিজেই বলেছিল, “ ঠিক আছে, যাবো। তবে আমি একা, তুমি থাকবে ঘরে, কোনও কথা নয়
ফুটেজ এনে তোমার হাতে দেবো, শান্তি ?”

এরপরে আর বেশী কথা বলা চলে না। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, সেই ফুটেজ সমেত ক্যামেরা যেটা অন্তুর কাছ থেকে পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পেলাম পুলিশের হাত থেকে।
কি ঘটেছিল ওর সাথে ? আমাকে জানতেই হবে, আজ রাতেই যাবো ঐ স্কুলে।

                                                *                                  *


রাত্রি ২টা বেজে ১০ মিনিট, পাড়া সম্পূর্ণ শান্ত, কারোর আনাগোনা এখন থাকেই না।
বেপাড়ার দু একটা কুকুর মাঝে মধ্যে সঙ্গীত মেলায়।
একা আজ পর্যন্ত কখনই তেনাদের ছায়া মাড়াতে হয়নি, এই প্রথম বুকটা ধড়াস করে উঠলো।
ভয় একটা ভেতরে ভেতরে কাজ করছে না যে তা নয়, কিন্তু আমি দমবার পাত্রী নই।
এক্সট্রা একটা ব্যাটারি আর সঙ্গে ক্যামেরা ও আলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম অন্তুর করে যাওয়া শেষ অভিযানের দিকে।
গলি রাস্তা, স্ট্রিট লাইট এর আলোতে খেলা শুরু করেছে, আলো আধারি। পাশের গলিতে সেই রকম আলোই নিভু জলু করে জ্বলছে। হেঁটে চলেছি আমি, শেষ রহস্যের দলিল লেখার জন্য। একথা ঠিক, রাস্তা যতই শেষ হয়ে আসতে শুরু করেছে, পা এর গতি ততই শ্লথ হছে।
স্কুলের মেইন গেটে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, এখানে একা আসাটা বোধকরি ঠিক হোল না। সাধারণ ভাবে এলেও ঠিক হতো, কিন্তু...

দাড়িয়ে একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলাম।
ডান হাত পেটে রেখে মনে মনে বললাম, “ তোর বাবার শেষ কাজটা আমায় শেষ করতে দে “
কথা বলার সাথে সাথেই ভেতর থেকে একটি অজানা জোর অনুভব করেছি। ভয় টা আর কাজ করছে না, সত্যি।

                    *                                        *                                         *


অর্ধেক মাথা ভাঙ্গা একটি মূর্তি বসানো সামনে, রবীন্দ্রনাথ হলেও হতে পারেন। তার ঠিক পেছন থেকে দুই পাশ দিয়ে দুই মুখো সিঁড়ি, উঠে দুতলার সাথে যোগ দিয়েছে। আলোতে সিঁড়ির ভঙ্গুর অবস্থা চোখে পড়ার মত। ডানদিকের সিঁড়িটা ধরে এগিয়ে চললাম।
ওপরে লোহার টানা গেট আধখোলা অবস্থায় বিছিরি ভাবে রয়েছে , ঠিক যেন আমার আমন্ত্রণের অপেক্ষায়। সামনে এলে যেন নিজেই সরে যাবে।


গেট এর ওপরের অংশ একটু ভাঙ্গাচোরা, চাইলেও গেটটা কিন্তু খোলাপরা করতে অসুবিধে হবে, কেমন হাড়গিলে বেড়িয়ে অদ্ভুত দেখতে হয়েছে, লালচে মরচে এতদিনে নিজের রঙ পরিবর্তন করেছে।
সাবধানে আস্তে আস্তে শরীরটা আড় করে কাত হয়ে ঢুকে পড়লাম, পেট এর অংশে যাতে চাপ না পড়ে। জায়গাটা সত্যি খুব ভয়ানক। ঢোকা মাত্রই শরীরের ভারটা অনেকটা চেপে বসেছে
 নেগেটিভ এনার্জি সংস্পর্শে এলে এমনটা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে পাত্তা দিয়নি। মাথার ঠিক ব্রম্ভতালু অংশে একটা চাপ চাপ কিছু ভারি অনুভব করলেও সেটা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।

ডান দিক ধরে এগিয়ে চললাম আমি। গেট এর কাছ থেকে দুই পা এগিয়েছি, হঠাৎ ছনছন ছনছন... করে বেজে উঠলো পেছনে
সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলাম জড়বস্তুর মত। গ্রিলটায় ঠিক যেন কেও বা কারা ধাক্কা দিল।

সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে দিয়েছে। একি শুনলাম আমি ? থমকে দাড়িয়ে পড়েছিলাম।

পেছন ঘুরে কোনরকমে আলো ফেলতেই চমকে গেলাম।
সমস্তটাই শূন্য, অন্ধকার শূন্য। সত্যি আমি কাউকে দেখতে পেলাম না। নাহ! কিছু নেই
গেটটা তখনও নড়ছে আস্তে আস্তে, খুব স্পষ্ট বোঝা যাচে। আসার সাথে সাথে এমন একটা ঘটনা হবে ভাবতে পারিনি।

টর্চের আলো লম্বা বারান্দার ওপরে ফেললাম। এতো ঘুটঘুটটি অন্ধকার, দেখলেই পিলে চমকে যায়। অন্ধকার এতটা ভয়ঙ্কর হয় তা সত্যিই জানা ছিল না। টর্চের আলো অন্ধকারকে কেটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলেও, সমস্ত কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখা যাছে না। কোনও রকমে ঠাহর করে এগিয়ে চললাম আমি।

একতলা, ক্লাস ওয়ান এর ঘর, সবুজ চৌকাঠে বড় বড় করে লেখা।
রুমে আলো ফেলতেই দেখলাম, চেয়ার টেবিল বেঞ্চ সবই রয়েছে, কিন্তু অগোছালো ভাবে। যেভাবে একটা সুসজ্জিত ক্লাস হওয়া উচিত, সেটা মোটেই নেই। বোর্ডের মধ্যে ইংরেজিতে এ বি সি লেখা , দেখতে দেখতে মনটা কেমন একটা হয়ে গেল। ঠিক মনে হোল, আমিও ছোট্ট হয়েই যাই এখুনি, এই মুহূর্তে। সেই ছোটবেলা, কত স্মৃতি কত আনন্দ... এভাবেই ক্লাস চলতে চলতে হয়তো একদিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে সব, বুঝতে পর্যন্ত পারেনি যে আজই ওদের শেষ স্কুলে আসা

বোর্ডের দিকে পেছন ফিরে তাকালাম বেঞ্চগুলোর দিকে। শূন্যতা এমন ভাবে ভয়ের জন্ম দেয়, না দেখলে বোঝা যাবে না। ঠিক যেন একটা হাহাকার শূন্যতাকে গ্রাস করতে চাইছে ভয়ানক রূপ নিয়ে। কেও নেই এখানে, কিন্তু কেমন যেন ঘরটা জমজমাট পূর্ণ মনে হছে, অদৃশ্য ভয় মনের মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু এখানের আবহাওয়া, পরিস্থিতি মোটেই ভাল না।


“ ক্যাআআআআআআআআচ “
প্রচণ্ড ভয়ানক শব্দ, ঠিক কানে কাছে পিছন থেকে এসেছে।
ফিরে দেখলাম, নিচে একটা সদ্য ভাঙ্গা চকের অংশ, এই মাত্র পড়ল বলে মনে হোল
আওয়াজটা কি করে এলো ? চোখ আঁটকে গেলো কালো বোর্ডের দিকে এক কোনে, নিচের দিকে
তখন যেখানটা ফাঁকা ছিল, সেখানে এখন ইংরেজি টেরাব্যাকা কাঁচা অক্ষরে লেখা , “ হেল্প “

চমকে উঠেছি, এটা কি করে সম্ভব ? লেখাটা এখুনি হয়েছে, কারন আসার সময় বোর্ডটা ফাঁকা ছিল। ভয় পেয়েছি সত্যি কথা বলতে।
রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম দৌড়ে এক নিঃশ্বাসে। লাগোয়া একটা বাথরুম ছিল ঐ রুমের সাথে। সেটার পাশ দিয়ে যেতেই পা কেঁপে উঠলো।
ভেতর থেকে কল খোলার শব্দ । ঠিক কেউ যেন বাথরুমের ভেতরে দাড়িয়ে এই কাজটা করলো সেই মুহূর্তে।
জল পড়ার শব্দে ভয়ে আমার পা কাঁপছে , এসব কি শুনছি আমি। ব্যাপারটা সত্যি আমার সাথে ঘটছে ? বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন অহরহ ঘটনা, অন্তু থাকলেও ঘটেনি। তবে কি আজ আমায় একা পেয়ে... ? না, আমিতো একা নই...

 “ কে ? “ , বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আওয়াজ বেরোল না গলা থেকে। তার পরিবর্তে এলো সামান্য খুক একটা শব্দ।
আশ্চর্যের ব্যাপার হোল , শব্দটা যেই আমার মুখ থেকে বেরোল, আর ভেতর থেকে জলের শব্দও থেমে গেলো এক মুহূর্তে। এসব কি হছে , কিছু বুঝতে পারছি না।
বেশী আর ভাবতে পারিনি। বারান্দা ধরে এগিয়ে চলেছি , টর্চের আলো একবার বাম দিকে, একবার ডানদিকে ফাঁকা জায়গায় একটু করে দেখে নিছি।
 
দড়াম করে আওয়াজ এলো। দরজা বন্ধ করলে যেমন হয়, শব্দটা ওপর তলা থেকে আসছে।
একবার নয়... দড়াম
দুই বার...  দড়াম দড়াম
তিনবার... দড়াম দড়াম দড়াম দড়াম
 
ঠিক তারপরই, ধপ ধপ ধপ ধপ
। শব্দটা আসছে ঠিক ওপরতলা থেকেই।
কেও যেন দৌড় দিয়েছে, সামনে থেকে পিছন দিকে, আবার ঠিক পেছন থেকে সামনে ধীরে ধীরে শব্দটা ছড়িয়ে পড়ছে। মনে হোল একাধিক জোড়া পা ওপরে দৌড়াদৌড়ি করছে। মনে হয়েছে কেও বা কারা খেলছে এই রাতের বেলা, আর সঙ্গে চিৎকার ও খিলখিলানি হাসি হাসিটা যে ছোট্ট গলা থেকে আসছে, সেটা বোঝাই যাছে।
কি সাঙ্ঘাতিক, হাসির শব্দেও গায়ে কাঁটা দেয়, সেটা এই প্রথমবার আমি টের পেলাম।

সামনের সিঁড়িটা দিয়ে ওপরে উঠে গেলে কেমন হয়, যদি কিছু ফুটেজ পাওয়া যায়।যেই ভাবা সেই কাজ।

যখন গেলাম, শব্দটা গায়েব হয়ে গেছে মুহূর্তেই
, ঠিক ম্যাজিকের মত। পুরো স্থানটাই কালো অন্ধকারের কুয়োয় ডোবা, এইখানে এই সময়ে কেই বা খেলবে। খেললেও তো আলো জ্বালতে হবে। সব কি আমার মনের ভুল ? নাকি ভুল শুনছি ?

আমি আজ আসলেই একা। প্রথম থেকে মনে একটা ভয় কাজ করছে, তারই কি প্রতিক্রিয়া এসব ? মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল না হলে চোখ হালুসিনেট করে, আমার ক্ষেত্রে কি তেমন কিছু হছে ?  
আমি কি ভুলই শুনছি ? চেতনার অবলুপ্তি ঘটেনি তো ?

ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার থেকে একটা জিনিস গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে এলো লাফাতে লাফাতে।
কি এটা ?
একটা ফুটবল জাতীয় কিছু, না আমি ভুল দেখছি না

বলটাকে পায়ে ছোঁয়াইনি, পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম লাগোয়া ক্লাসরুমের দিকে। বলটা ততক্ষণে গড়িয়ে যাছে পেছনের দিকে।

                    *                                        *                                         *



এই রুমটা অনেকটা পরিষ্কার, সাদা বোর্ডে লেখা ক্লাস থ্রি, বিভাগ ক।
নিচের ঘরের তুলনায় এই ঘরটা একটু গরম, স্যাঁতস্যাঁতে ব্যাপারটা নেই। ঠিক যেন এই ঘরে নিয়মিত আসা যাওয়া চলে।
ঘরে ঢোকা মাত্র কিছু একটা অনুভব হছে যেটা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। আমার অনুভূতিটা এই ক্লাসে, বড্ড অদ্ভুত। শুধু মনে হছে পাশাপাশি যেন কিছু একটা আছে, শুধু ঘোরাফেরা করছে আমার চারিদিকে
সামনে বা একটু দূর থেকে আমাকে অবিরাম লক্ষ্য করছে কেও বা কারা।

প্রতিটি মানুষের সিক্সথ সেন্স বলে একটা বস্তু আছে কম বেশী, সেটা আমার একটু বেশিই আসলে। যতক্ষণ ঐ ঘরটায় আছি, পেছন থেকে মনে হছে ঠায় কেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টির অনুভুতি ভয়ানক, ঠিক পেছন থেকে বিনা পলকে আমাকে ভস্ম করে ফেলতে চাইছে ।
ভয়ে পেছনে তাকাতে মন চাইছে না, কিন্তু ভেতরে একটা কিছু কাজ করছে, বোঝানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শরীরে যত শক্তি আছে জড়ো করে পিছন ফিরে টর্চের আলো ফেলতেই বসে থাকতে দেখলাম সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি।

          *                                                         *                                                     *


একটা ছোট্ট পুতুল, বসে আছে কয়েক বছর ধরে, গায়ে প্রচণ্ড ধুলো জমেছে। কেও বা কারা এটাকে এখানে ফেলে চলে গেছে, সেদিন থেকে সে একা হয়তো, কারোর সাথে খেলার সাথী পায় না। ওরা পুতুল হলেও ওদেরও মায়া আছে...ওদেরও প্রাণ...
এই এই এই... কি সব ভাবছি আমি পুতুলটা দেখার পর...

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকে, বড্ড অদ্ভুত পুতুলটা, চুল গুলো সেই সাদা ঘিয়ে রঙের কুঁচকানো, গায়ে একটা পিঙ্ক রঙের ধুলো মাখা জামা, একটা চোখ অর্ধেক খোলে আর পিটপিট করে। এতক্ষণ মনে হছিল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকানো নয়, মনে হছে লক্ষ্য করছে

টর্চের আলোটা পলকে নিভিয়ে ফেলা মাত্র চমকে উঠলাম দৃশ্যটা দেখে

পুতুলটার চোখ জ্বলছে। কি ভয়ানক। অন্ধকারে চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে, কি রাগী ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে যেন এবার সব নষ্ট করে দেবে ঐ অন্ধকারে
থাকতে না পেরে টর্চের আলোটা জ্বালিয়ে দিতেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল।
ক্লাসের ঐ ঐদিকে দুটো জানালা রয়েছে। কাঁচ গুলো ভেঙ্গে গেছে, হালকা আলগা বাতাস নড়াচড়া করে ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। এগিয়ে গেলাম জানালা দিয়ে বাইরের কোন অংশটা দেখা যায়, সেটা দেখবো বলে। ঢোকার রাস্তাটা কোনা ভাবে চোখে পড়ছে, এছাড়া আর কিছু দেখা যাবে না।
উফ,মাথাটা বড্ড কুটকুট করছে, ঠিক মাথায় যেন কিছু একটা পড়ল এখুনি
কি রে বাবা !
হাত দেওয়া মাত্র হাতে লাগলো... কি এটা ? আমার মাথার ঠিক সরু সরু এটা কি সুতো
?
নাকি চুল ? সত্যি চুল এগুলো এলো কোথা থেকে, এতো পাতলা চুল তো আমার না তাহলে কার ?

সারা গা কাঁটা দিয়ে দিয়েছে ভয়ে
শরীর ভারি হয়ে গেছে, না পারছি নড়তে না পারছি কিছু করতে, সমস্ত শরীরটাই অবশ। কি করবো এখন ? ভয়ে ওপরের দিকেও তাকাতে পারছি না।
তখনই পিছন থেকে কোন কিছু প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করলো আমার কানের কাছে, আর সাথ সাথ চিৎকারটা দরজার বাইরে চলে গেলো হাওয়ায় ভেসে ভেসে
চিৎকারটা একটা ছোট্ট সুরেলা গলায়, অবাক করা ব্যাপার হোল, আমার শরীরটা হালকা লাগছে এখন অনেকটাকিছু কি ছিল এতক্ষণ মাথার ওপরে ?
সাহস করে একবার মনে হোল ওপরের দিকে তাকাই।  

অন্তু থাকলে অনেক আগেই ওপরে টর্চ ফেলে দিত, কিছু থাকলে ঠিক এভাবেই ভাল ফুটেজ পেত।
জানালার সামনে তখনও দাড়িয়ে আছি। চারিদিকটা খুব অন্ধকার, গেট এর কাছে দুই পাশে দুটো বড় বড় তালগাছ রয়েছে, সেটা স্পষ্ট দেখা যায়। এবার একটু অন্য দিকটা দেখতে হবে, ভাবতে গিয়েই বাইরে থেকে একটা বিকট শব্দ কানে এলো
, ঠিক একটু আগে যেমনটা শুনলাম, একটু জোরালো।
শব্দটা ওপরে ছাদের দিক থেকে এলো ভেসে, প্রবাহের মত আমার দিকে নিচে নেমে আসছে জানালার বাইরে থেকে... ঠিক তখনই দেখতে পেলাম...
দেখতে পেলাম...


একটা ছোট্ট মেয়ের দেহ বাতাসে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে যাছে
, ছাদ থেকে কি আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ঘটছে, নিজের চোখকে বিশ্বাস দিতে পারছি কই
পরনে স্কুলের ড্রেস, ওপরে সাদা জামা, আর নিচে সবুজ ফ্রক,  পায়ে মোজা আর কেটস পড়া, উলটো ভাবে চিত হয়ে চলে যাছে নিচে আরও নিচে আরও নিচেভাবনা শেষ হওয়ার আগে ধপ করে একটা শব্দ হোল। কি ভয়ঙ্কর, সর্বনাশ… ধপ শব্দের সাথে আমার হৃদস্পন্দন দাড়িয়ে গেল মনে হোল। নিজেকে একটু সামলাতে সময় লেগেছিলও। কপালে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জমেছে।

ক্লাস থেকে জলদি বেড়িয়ে সিঁড়ি ধরলাম ,ছাদে ওঠার জন্য। সিঁড়িটা বড্ড নোংরা, ওখানে যে মানুষের আনাগোনা নেই সেটা বোঝাই যায়। সিঁড়ির দরজার কাছে এসে দেখলাম, গেটটা লোহার মরচে পড়ে রয়েছে। এই গেটে তালা দেওয়া না দেওয়া সমান, শরীরে একটু জোর থাকলে ঠেলা মারলেই খুলে যাবে। তালা লাগানো ছিলনা অবশ্য, হাস্কল টা খুলে এক লাফে ছাদে পা রাখলাম।

গুমোট ভাব ওপরটায়। না আছে হাওয়া বাতাস না কোনও শব্দ ।
চারিদিকটা এতটা অন্ধকার যে বলে বোঝাতে পারবো না। কালো রঙ আর অন্ধকার এর পার্থক্য আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি, যেদিকেই টর্চ ফেলছি অন্ধকার তাকে প্রায় গ্রাস করছে প্রত্যেক স্থানে
অনুভুতি কিন্তু বেশ ভয়ানক ।
আসার পর থেকে কিন্তু শরীররা একটু ভার ভার হছে, কিছু একটা অসুবিধা আছে এই স্থানে, বুঝতে পারছি না ঠিক। গেট ছাড়িয়ে একটু ডান দিকের দেওয়াল ধরে এগোতে থাকলাম, সাড়ে তিন ফুটের পাঁচিল গাঁথা রয়েছে, তাও তিন ইঞ্চির চওড়া দেওয়াল দেখে মনে হোল। রাগ হোল স্কুল কমিটির ওপর, এমন খেলো কাজ কেও করে নাকি ? অসাবধান হলে এমনিতেই তো...

“ রিনি “ কানের কাছে ফিস ফিস করে কে একজন যেন ডেকে উঠলো। কে কে ? চমকে পেছনে ফিরে তাকাতেই, দেখতে পেলাম...

                    *                                        *                                         *


নাহ, কেও তো নেই, তাহলে ডাকল কে ? মনের ভুল হবে হয়তো, নিজের দুর্বলতার প্রতিফলন। ঘুরে টর্চের আলোটা সামনে ফেলতেই, চোখে এক ধরণের সাদা আলো চমকে দিয়েছে আমায়। চমকে না হলেও ধাধিয়ে দিয়েছে বলা যায়।
কি ? এরা কারা ? এরা... এখানে এলো কি করে ? আমার মাথা তখন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনটি ছোট্ট মেয়ে পেছন ঘুরে দাড়িয়ে আছে, সেই সাদা জামা, সবুজ ফ্রক। তিনজন একে ওপরের সাথে হাতে হাত ধরে দাড়িয়ে আছে, যেন ওরা তিনজনে ওদিকেই কোথায় যাবে। কিন্তু ওদিকে তো পাঁচিল শেষ হয়েছে, ওদিকে যাবে কোথায় ?

ওমা, ওরা তো সমান তালে তালে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে ওদিকে। ওদিকে তো যাওয়ার রাস্তা নেই, ওরা তো পড়ে যাবে। মাথায় আমার ঐ মুহূর্তে অন্য কিছু আসেনি, তাই চিৎকার করে ওদিকে ছুট লাগালাম। এক ছুটে যখন ওরা তিনজন আমার নাগালের মধ্যে এসেছে, একজনের কাঁধে হাতটা রাখলাম, মাঝের জন যে ছিল।
হাতে ছ্যাকা লাগলো, ছিটকে উঠলাম। এতটা ঠাণ্ডা কোনও মানুষের শরীর হতে পারে নাকি ? আগুন শীতল বলে যে কথাটা আসে, এটাও ঠিক তারই সমার্থক। মানুষের শরীরে এত কম তাপমাত্রা ?
কথাটা ভাবার শেষেই মাথায় বাজ পড়ল, মা----নু-----ষ তো ?

যেই না ভাবা, পরক্ষনেই ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এবার তিনজন আমার মুখোমুখি, আমার দিকে। কিন্তু একি ?
একি বীভৎস দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছি, গায়ে কাঁটা দিছে।
সবুজ ফ্রকের সবুজ অংশ আর দেখা যাছে না, সেখানে মিশে রয়েছে লাল রক্ত। সম্পূর্ণ অংশটাই তরল কালচে রঙে মিশে ভয়ঙ্কর একটা অভিশপ্ত রঙের জন্ম দিয়েছে।সাদা জামাটাও আর সাদা নেই বললেই চলে, সরু সরু কালচে রক্তের দাগ চুইয়ে নিয়েছে।
তিনটি চেহারার গলার কাছেও চাপরক্তও, কিন্তু একি ? ওরা দেখতে পাছে না কেন ? চোখের কোটরে কালচে মাংস পিণ্ড জমাট বেঁধেছে, চোখের মনি উধাও। এসব কি দৃশ্য দেখছি আমি। ওদের মুখ বলে কিছু নেই, সমস্তটাই ফেটে রক্ত ঝরছে, টাটকা রক্ত।

ধীরে ধীরে তিনটে রক্তাক্ত শরীর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ছাদের চারিদিকে লক্ষ্য করলাম, হঠাৎ হাওয়া বইতে শুরু করেছে, খুব জোরে জোরে। গুমোট আবহাওয়া নিমেষে ফুরফুরে। ঐ যে তালগাছটাও যেমন মাথা নাড়ছে, পাশাপাশি আর সব গাছ গুলো তাল মেলাছে। আমি বুঝতে পারছি, এটা স্বাভাবিক কিছু নয়, আমার সাথে এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এর আগে কখনই হয়নি... মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। অ্যাড্রিনালইন হরমোনের কার্যক্ষমতা অনেকটাই বেশির দিকে চলে গেছে, চোখের সামনেটা ধুয়ো দেখছি, আস্তে আস্তে চোখ বুজিয়ে আসছে...  শেষ দৃশ্যে যেটুকু চোখে পড়ল, ঐ তিনজনের ভয়ঙ্কর মুখ আমার মুখের ওপর আস্তে আস্তে বড় হছে...

                    *                                        *                                         *

কোথায় শুয়ে আছি ?
মাথাটা খুব ধরে আছে ,পেছনের দিকটা বড্ড বেশী। উঠতে কষ্ট হছে। চিত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় পুরো পৃথিবীটা ঘুরছে বলে মনে হোল। পেছন দিকে হাত রেখে আস্তে আস্তে উবু হয়ে বসলাম। সূর্যের আলো চোখে লাগছে ঠিকই, তেজটা তেমন ভাবে অনুভব করছি না

কিন্তু এ আমি কোথায় ? এটা কোন জায়গা ? পা হাত ছড়িয়ে বসে রয়েছি কেন এভাবে ? কিছুই বুঝতে পারছি না কি করে এলাম এখানে। এমনকি কালকে কি ঘটেছে, কিছু মনে পড়ছে না। এখানে এলাম কিকরে

আস্তে আস্তে নিজেকে শান্ত করলাম। মনে পড়ল, এটা আমার সেই বাড়ির ছাদ, যেখানে এখন আমি একা থাকি। আগে রোজ সকালে অন্তু আর আমি মিলে ছাদে ফ্রি হ্যান্ড করতাম, ঘাম ঝরিয়ে হাফিয়ে গেলে বসে পড়ত সামনের চেয়ারে, সঙ্গে গ্রিন টি ও সকালের পেপার। এখন সব শেষ হয়ে গেছে... ওটা কি ? পেপার পড়ে রয়েছে না ? কোমরটা একটু এগিয়ে নিয়ে পেপারটা হাতে নিলাম। অনেকদিন আগেকার সেই হেডলাইনটা চোখে পড়ে গেলো... মূল খবরটা কিছুটা এরকম

“ শহরে বেশ কিছু মাস ধরে মাঝবয়সী মেয়েরা নিখোঁজ হতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মেয়েই কলেজ পড়ুয়া অথবা বিবাহযোগ্যা। স্থানীয় পৌরপিতা এই সম্পর্কে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ সুত্রে অনুমান, ঘটনার সাথে অরগ্যান পাচার কাণ্ডের কোনও একটি র‍্যকেট যুক্ত আছে... “

হঠাৎ পেপারটা মাঝখান থেকে সজোরে ছিঁড়ে গেল, সঙ্গে বিকট একপ্রকার আর্তনাদ।
পেপারটা ছিঁড়ে নিজে নিজেই ঢুকে গেল পেছনের দিকে। চারিপাশটা আবার অন্ধকার।
কই সূর্য, কই আমার ছাদ ? এটাতো সেই স্কুলের ছাদ, যেখানে আমি এসেছিলাম অন্তুর শেষ খোঁজের রহস্য সন্ধানে
চারিদিকে তখন বো বো করে হাওয়া ঘূর্ণায়মান। এক একটা বালুকণা, গাছের পাতা সব্বাই অস্থির হয়ে আছে, সব্বাই দৌড় দিয়েছে আমার চারিপাশে, বনবন করে, বিকট শব্দ করে।
এতক্ষণ তাহলে কি দেখলাম ? এটা কি ছিল ? সমস্তটাই কি স্বপ্ন ?


“ রিনি “
সামনে থেকে ডাক এলো আমার নাম ধরে, কিছুটা ধারালো গলায়। স্বর খুব পরিচিত।
এটা তো... এটা অন্তু, কিন্তু ও তো...
ঘাড় তুলে তাকাতেই, সামনে... বেহুশ হবো হবো...

অন্তু
চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাছি। কিন্তু এ আমি কি দেখছি ?
ওর মাথাটা ফেটে গেছে কি করে ? ছাদ থেকে পড়ে গেছিলো নাকি ? চোখের মনির সাদা অংশ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কপালের চামড়া আড়াআড়ি ভাবে ছিঁড়ে গেছে যেন। চুলের মুটিতে হাত দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে একটা ছোট্ট মেয়ে, যে মাঝখানে দাড়িয়ে ছিল।
রক্তমাখা মুণ্ডু ধরে দাড়িয়ে আছে রণচণ্ডীর মত, পড়নে সাদা জামা সবুজ ফ্রক।
হ্যাঁ, শুধু মুণ্ডুটা, বাকি অংশ...

পাশে আর একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে, হাতে ওটা কি ? ধারালো ত্রিকোণ মত ? স্লেট এর টুকরো ? যেটা থেকে টপটপ করে লাল ঝরছে, তাজা লাল।
এসব আমি কি দেখছি, এগুলো দেখার জন্য তো আমি আসিনি। সব মিথ্যে এসব,সব ভুল, সব ছলনা
, এটা হতে পারে না। সব ভুল।
গা গুলিয়ে উঠেছে, আঁতকার উঠছে। ভেতর থেকে খুব কষ্ট হছে, কান্না পাছে। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে কোনও ভাবে। পেটের মধ্যে থেকে একটু চাপ অনুভব করছি, ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটছে, যেটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না।  
এখন সত্যি মনে হছে, না এলেই হয়তো ভাল হতো।
সামনের দিকে আর তাকাতে পারছি না, নিতে পারছি না এই বীভৎসতা।

একটু খানি ওপরে যখন তাকালাম, মুহূর্তের মধ্যে দেখলাম, তৃতীয় মেয়েটি এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
হাতে একটা ভাঙ্গা স্লেট এর ত্রিকোণ টুকরো।
আমার দিকে ধীর গতিতে যতটা এগছে, আমি চাইলেও পিছতে পারছি না। শরীরটা জড়ো বস্তুর মত কেও ওখানে মন্ত্রবলে যেন বসিয়ে রেখেছে, কিছুতেই উঠতে দেবে না। ভেতরে ভেতরে কষ্ট হছে, পেট এ অযান্ত্রিক চাপ লাগছে।
মেয়েটা এগিয়ে আসছে, আরও কাছে ... আরও কাছে...

মনে মনে বলছি কাছে এসো না, তুমি কাছে আসবে না, আমার আর আমার সন্তানের কোনও ক্ষতি তুমি করতে পারবে না... না আসবে না... কথাগুলো মুখ থেকে বার করতে পারছি না...  সেই শক্তি নেই শরীরে...
এরকম ভাবতে ভাবতেই খেয়াল হোল যখন, মেয়েটা মুখের সামনে এসে পড়েছে।

কিন্তু এটা কোন মেয়ে ? কোথায় হিংস্রতা ? কোথায় সেই রক্তাক্ত ক্ষোভ ?
মেয়েটার মুখটা যে বড্ড সুন্দর, ফুটফুটে
গায়ের রঙ খুব ফর্সা, যে কেও ওকে খুব আদর করবে দেখলেই। বয়স তো ৮ কি ৯ হবে। জামা কাপড় উজ্জ্বল পরিষ্কারএই মেয়ে সেই মেয়ে নয় যে খুন করতে পারে... একটু আগেও যেমন মনে হয়েছিল। জানিনা কেন আমার কাছে পাশে এসে বসল, শরীর দিয়ে ঠিক একটা উজ্জ্বল আলোর ছটা... তাহলে আমি কি ভুল দেখলাম ?

আদও আদও স্বরে ঐ প্রথম বলা শুরু করলো, “ একটা গল্প শুনবে ? ”
গলার স্বর শুনে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। অশরীরীর মুখ থেকে এতটা স্পষ্ট গলার স্বর, আজ পর্যন্ত শুনিনি
একটু সাহস পেয়ে একটু তোতলানো স্বরে অনেক চেষ্টা করে শেষমেশ বললাম, “ শুনবো “, গলা কেঁপেছিল।
চোখে চোখ রেখে মেয়েটি বলতে শুরু করলো, “
চোখ বন্ধ করো, আস্তে আস্তে।“
কথাটা শুনে জানিনা কীভাবে একটা বিশ্বাস ভেতর থেকেই এসেছে, বলতে পারবো না। মনে হোল মেয়েটি আমার কখনও ক্ষতি করবেই না।
চোখ বন্ধ করে দিলাম নির্দ্বিধায়।

                    *                                        *                                         *


ঠিক সেই মুহূর্তই ছিল আমার জীবনের এক অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার শুরু। না এটা ঠিক বলে প্রকাশ করার মত নয়, আমি চোখ বন্ধ করার পর মনে হোল অন্য কোনও এক জগতে পৌঁছে গিয়েছি, ঠিক অন্য আর এক জগত , যেটা চোখ না খুলেও আমি দেখতে পাছি।
এটা কি তৃতীয় নয়নের খেলা ?

চোখ খুললাম।
এই মুহূর্তে আমি দাড়িয়ে আছি, সেই স্কুলেই
। সময়টা বোধহয় দশ বছর পিছিয়ে।

চারিদিকটা ফাঁকা প্রায়। ১২টা বাজে হয়তো। রোদ একদম মাথার ওপরে।
স্কুলের ঠিক পাশেই সবুজ ঘাসের একফালি মাঠ।
পুচকি তিনটি মেয়ে খেলছে নিজের মনে, আপন খেয়ালে। এরা সম্ভবত একটু আগের দেখা সেই মেয়ে তিনটে।
একজনের চোখে রুমাল পাট্টা বাঁধা, বাকি দুই জন ওকে পেছন দিয়ে, সামনে দিয়ে জ্বালাতন করছে। বোধহয় কানামাছি খেলছে। খিলখিলে হাসিতে একদম বেজায় আনন্দ ছড়িয়ে বেরাছে তিনজনে। কিন্তু এখন তো স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তাহলে এরা কি করছে এতক্ষণ ? বাড়ির লোক আসেনি ? হয়ত এটা ওদের রোজের রুটিন, বাড়ির লোক না আসা পর্যন্ত একটু খেলা করে। তাও এতক্ষণ ধরে ?



দূর থেকে একটা গাড়ি আসার শব্দ । লালরঙের মারুতি ওমনি, যেগুলোতে টানা গেট থাকে। গাড়ি আসার গতিটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। হুস করে এসেই থেমে গেল ঠিক স্কুল গেটের কাছে।  হয়তো ছোট্ট মেয়ে গুলো নিজদের বিপদ টের পেয়েছিল। চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে মেয়েটি দাড়িয়ে পড়ল। তিনজন একে ওপরের দিকে তাকাল।
 বিপদ বুঝে দৌড় দিল স্কুলের ভেতরের দিকে। আমিও ওদের সাথে সাথে দৌড়াতে থাকলাম। আশ্চর্যের বিষয় যে ওরা কেও আমাকে দেখতে পারছে না ।


মেয়ে তিনটি দৌড়ে দৌড়ে দুই তলা তে উঠে পড়েছে। দেখাদেখি গাড়ি থেকে নামা মাত্রই তিনটি তাগরাই ছেলে দৌড় দিলো ওদের দিকে।
মেয়েগুলো ততক্ষণে ছাদের ওপরে।
ছেলেগুলোও নিমেষে ছাদে উঠে পড়েছে, ছাদের গেট ঘিরে ফেলেছে এখন। আমি দাড়িয়ে আছি ছাদের এক কোনে, না না কেও দেখতে পারছে না আমাকে।
মুখে তিনজনেরই রুমাল কাপড় ঢাকা। মনে হয় এরা অনেক দিন ধরেই ফলো করেছিল মেয়েগুলোকে,আর আজ কাজটা শেষ করতে এসেছে।

ওদের মধ্যে একটা ছেলে বলল, “ কিন্তু এরা তো ছোট, এদের কি করে ধরে নিয়ে যাবো ?”

আর একটা ছেলে ধমক দিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, “ বস যেটা বলছে সেটা কর। বড় মাল না পাওয়া গেলে কচি চালান করতে হবে। “



ছাদের গেট ঘিরে যে দাড়িয়ে চলো, তার পড়নে খুব পরিষ্কার জামা। পেছন থেকে দেখলাম, লোকটা চশমা খুলে ওদের অর্ডার দিলো, “ আজকের কোটা পূরণ করতেই হবে, তাতে যত কচি লাগে লাগুক। রেট ভাল পাওয়া যায় এদের।  যা তোরা ধরে নিয়ে অ্যায় ওদের। “ ওটা লোক না বলে চ্যাংড়া ছেলে বলাই ভাল, বয়স খুব তো নয় যা বুঝছি। তাহলে এরাই কি সেই র‍্যাকেট ?

এদিকে বিস্ফোরণমূলক অর্ডার পাওয়ার পর ছেলে দুটো দুই পাশ ধরে এগোতে শুরু করেছে। তিনটি মেয়ে ভয়ে জড় হয়ে আছে।
কি হবে ভাবার অবকাশ ওদের হাতে নেই। নিজেদের অজান্তে পেছন দিকে পিছতে থাকলো তিনজনে। ওরা বুঝতেও পারেনি , কখন ওরা আসতে আসতে ছাদের কিনারে এগিয়ে চলেছে।

ষণ্ডা মার্কা ছেলে দুটো যখন আরও একটু গতি নিয়েছে, মেয়ে তিনটি পেছন দিকে না তাকিয়েই আরও পিছিয়ে গেল, আরও আরও... তারপরই.. চিৎকারটা ঠিক কিছু মুহূর্তেই শুনতে পেয়েছি। তারপরই সব চুপ, নিসছুপ।
সারা শরীরে কাটা দিয়ে দিয়েছে। সেই ধপ করে শব্দ হোল, ঠিক সেই রকম। এটা আরও বেশী ভয়ঙ্কর । এটা কি দেখলাম আমি।
মুহূর্ত খানেক আমার সাথে জড় বস্তুর কোনও পার্থক্য ছিল না, দেহে কোনও সাড় নেই। গোঙানির শব্দ একটু একটু আসছে...

ওদিকে তাড়াহুড়ো ধস্তাধস্তি লেগে গেছে। ছেলে তিনটে নামতে শুরু করেছে, কারন ওরা জানে বিপদ যেটা ঘটে গেছে, সেটা ওদের জন্যই ঘটেছে। যত তারাতারি ওরা পালাবে, ততই ভাল ওদের পক্ষে।
সেই চ্যাংড়া ছেলেটা, সব্বার পেছনে ছিল।
বাকি দুজনের তাড়াহুড়োতে তে নিজেও একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। ঘুরে ফিরে আসার সময় মুখে টান লেগে রুমালটা খুলে পড়েছে।

মুখ আবরণহীন, রুমাল ধুলোয়।
আচমকা বজ্রপাত হোল আমার মাথায়, যেটার কথা আমি বিন্দু মাত্র কল্পনা করতে পারিনা।
শয়তান চোখের সামনে এলেও বিশ্বাস করে নিতাম, কিন্তু এটা  কে ?

                    *                                        *                                         *

অন্তু ??????

চ্যাংড়া বয়সের সেই মুখ, সেই কাছিম মার্কা দাড়ি। দশ বছর আগে ঠিক যে লুকে আমার সাথে দেখা হয়েছিল। এটাও কি আদেও সম্ভব ?  
তখন থেকেই ও কিসের ব্যাবসা করতো, আমাকে বলতো না কখনও। সবসময় ও কোথায় চলে যেত রাতে দিনে, কখনও জানতে চাইনি। তাহলে কি অন্তু মেয়েদের এক্সপোর্ট করত ?


ভাবতেই গা টা ঘেন্না করতে শুরু করেছে। যে অন্তুকে আমি ভগবানের আসনে রেখেছিলাম, নিজের সারাজীবনের সঙ্গী করেছিলাম ,সেই আমায় নিজের শয়তানি জালে চোখ বেঁধে রেখেছিলো। ঘুণাক্ষরে টের পাইনি ও এতটা নিচে নেমেছে ?
কত মায়ের কোল খালি করেছে অন্তু ?
ছি !
নামটা মুখে আনতেও লজ্জা করছে।

দশ বছর আগের এই জঘন্য কাজের জন্য ওর তো কোনও শাস্তি হয়নি।
সেদিন আমি যখন এই স্কুলে আসার কথা বললাম, ও বুঝে গিয়েছিল এখানে আসা যাবে না। অন্তত আমাকে নিয়ে না।
আনবে কি করে ? মরণবীজ যে পোতা আছে এখানে... সেটা ও জানত।

কত মায়ের চোখের জলের অভিশাপ লেগেছে ওর ওপর ?


ও কিনা নিজের সন্তান কে বাঁচাতে চায় ?
কেন ? অন্য মা এর বুক থেকে তাদের সন্তান কে কারার সময় মনে ছিল না ?

আর ও কিনা, আমার কোল যাতে খালি না হয় তারজন্য...
পাপ বাপ কে ছাড়ে না...

                    *                                        *                                         *
মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল চোখের সামনের দৃশ্যপট।

সামনেটা আবার আগের মত হয়ে গেল।
তিনটি মেয়ে তখনও দাড়িয়ে আছে , তাকিয়ে আছে আমার দিকে। প্রত্যেকের চোখে জলবিন্দু।

নাহ, আর ভয় করেনি। বরং কষ্ট হয়েছিল।
আজ এখানে যা কিছু ঘটছে, সব ঐ শয়তানটার জন্য। কি করে নিজেকে ক্ষমা করব আমি।

মনে মনে একটা জ্বালানো ক্ষোভ টগবগ করছে, রাগ হছে প্রচণ্ড।
অনুশোচনা কিনা জানিনা, অন্তুর জন্য কষ্টটা কখন রাগে পরিণত হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি। আসল অন্তু কে চিনতে এতটা ভুল হয়েছে আমার...
নিজের অজান্তে চোখে জল চলে এসেছে। গা গুলিয়ে উঠছে অন্তুর মুখটা মনে পড়তেই।

“ রিনি দিদি ? “
তিনটি কণ্ঠস্বরে একভাবে ডাকতেই আমি মুখ তুললাম।
মেয়ে তিনটি চুপ করে দাড়িয়ে আছে।
ফুটফুটে তিনটি মেয়ে দাড়িয়ে, যাদের মুখে কোমল আর সরলতা। এরা বড় হলে হয়তো জীবনে কিছু হয়ে দেখাত। সেই সুযোগ দিলো না। এদের মত মেয়েদের কিনা পাচার করা হতো ? এরাই তো আমাদের দেশের উজ্জ্বল তারা, আজ না হয় কাল ঠিক জ্বলজ্বল করবে।

চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল কখন বুঝতে পারিনি।
ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ করতে চাইছে, বুক ফাটছে।
শুধু অন্তু কেন, এমন কুৎসিত কাজ করতে যাদের হাত কাপে না, তাদের শেষ এভাবেই হওয়া উচিত।  
 

স্কুলের ছাদে আস্তে আস্তে হাওয়া শিথিল হতে শুরু করেছে। বিভীষিকা শব্দের দাপট কমছে। ওরা দাড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, ধীরে ধীরে অনেকটা কাছে এলো।
তিনজনে নিজেদের হাত বাড়িয়ে আমার পেটের বিশেষ অংশে ছোঁয়া দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
নিজের শরীরটাতে এক ধরণের শান্তি অনুভব করছি।

আস্তে আস্তে ওদের শরীরটা আবছা হতে শুরু করেছে, কেমন ভাসা ভাসা। হয়তো ওরা বিদায় জানাতে চায়, ওদের কাজ শেষ হয়েছে, ১০টা বছর অপেক্ষার অবসান ।
পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ওরা।
আবার হয়তো এই স্কুল নিজের প্রাণ ফিরে পাবে, আবার এখানে ছেলে মেয়েদের চেঁচামেচি শোনা যাবে।
আমার সন্তানকে এখানেই লেখাপড়া করাবো।
ঠিক সেই মুহূর্তে পেটের ভেতর হালকা একটা স্পর্শ অনুভব করলাম।




                     *                                         সমাপ্ত                                              *

    

Comments