“ রাতের মরীচিকা “




                ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১১টা ছুই ছুই, আপনারা শুনছেন “রেডিও অনুভুতি” ৯৮.৫, রাতের মরীচিকা অনুষ্ঠানে আজ আরও একবার সকলকে স্বাগত জানাই
আমি উপল, প্রতি রাতের মত আজও  নিয়ে চলে এসেছি ভিন্ন স্বাদের ভয়ের আড্ডা জমাতেআজ আমাদের সঙ্গে আছেন বিশেষ গেস্ট। আপনাদের মতই উনি আমাদের নিয়মিত শ্রোতা

যাইহোক, কথা বাড়িয়ে সময় নষ্টনা করে, চলুন শুনে নেওয়া যাক ওনার জীবনের ভয়ঙ্কর ঘটনা।


আমি উপল, প্রায় ছোটবেলা থেকেই কোলকাতায় বাস আমার।
বছর খানেক হয়েছে, জয়েন করেছি কোলকাতার বিখ্যাত রেডিও স্টেশন “ রেডিও অনুভুতি  “ তে। কোলকাতার বড় বাজার এর দিকে এগিয়ে যেতে গেলে আগেই পড়ে ক্যানিং স্ট্রিট। একদম শুরুতেই মহাবেদি হাউসিং, ঠিক টপ ফ্লোরে আমাদের অফিস।
ইন্টার্ভিউয়ের দিন ডিরেক্টরের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশং
 সা কুড়িয়েছিলাম, তাই চাকরিটা পেতে অসুবিধে হয়নি। তবে উনি আমাকে শো এর একটি মাত্র স্লট দিয়েছিলেন, যেটা “ রেডিও অনুভূতি”র প্রোগ্রামে এই প্রথম। ব্যাপারটা যেমন চ্যালেঞ্জইং, ততটাই উত্তেজনাপূর্ণ


রাত্রি ১১টা থেকে ঠিক ১.৩০মিনিট, নিজের ইছে মত যেকোনো টক শো চালিয়ে যেতে হবে, না থাকবে কোনও গান, না কোনও বিরতি।
সেদিন ইন্টার্ভিউ শেষে বাড়ি এসে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম সব্বাই যখন ঘুমোতে শুরু করবে, তখন আমি কি করে কোলকাতা জাগিয়ে রাখবো ? বেশ অনেক চিন্তা করার পর মাথায় আইডিয়া এলো।
 কোলকাতা তখনই জাগবে, যদি আমি ঘুমোতে না দিই। এমন কিছু যদি শোনাই, যাতে ঘুম উড়ে যায় ?

ভয়ের গপ্প ! অশরীরীর হাতছানি।
আর যদি সেটা যদি কোনও গেস্ট দিয়ে বলানো যায়, শিহরন জাগানো সত্যি ভূতের মিথ্যে গল্প।  
প্রস্তাব আপ্রুভ হয়ে গিয়েছিল পরের দিনই।


আজ প্রায় আটটা মাস হতে চলল, আমার শো “ রাতের মরীচিকা “ দারুণ চলছে। প্রথম প্রথম শ্রোতা হিসেবে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে মেয়ে ভিড় করতো, দিন দিন সেই বয়সসীমা ছাড়িয়ে চলেছে।
কোনও কোনও দিন গেস্ট আসে, কোনও দিন ফোনের মাধ্যমেই অনেকে গল্প শোনায়, যাদের আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

এই তো গেল আমার কাজের কথা। এবার আসি আমার ঘর সংসারের কাহিনীতে, অল্প করে।
আমার সংসার একদম ছোট্ট, আমি আর পিসিমা

মা বাবা একটি গাড়ি এক্সিডেন্টে চলে যাওয়ার পর, আমার দায়িত্ব পিসিমা নেয়। এখন বয়স বাড়ার সাথে সাথে পিসিমা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছেন, তাই আমাকেই তাকে দেখতে হয়।

ব্যাস, এটাই আমার রোজের চা পাউরুটি।
জীবনের চাকা, আস্তে আস্তে ঘুরছে এভাবেই।

ঠিক কাল রাতে ফিরে ঘটলো একটা ঘটনা। বাড়ি ফিরতে একটু লেট হয়েছিল, প্রায় ২টো ছুই ছুই। অন্য দিন আমি গিয়ে নিজে খাবার গরম করে খেয়ে নিয়।
পিসিমা ঘুমিয়ে থাকে।
কিন্তু কাল দেখলাম
পিসিমা জেগে রয়েছে। শুধু জেগেই নয়, চেয়ার থেকে উঠে আস্তে আস্তে পায়ে চারি করতে করতে কিছু কথা বলে চলেছে, প্রচণ্ড ভাবে উত্তেজিত, আমায় দেখার পর থেকে বলার ভাষা স্পষ্ট নয়, অনেকটা বিড়বিড় করছে, জড়িয়ে যাছে মুখের ভাষা। পিসিমার বলা কথা আমি গুছিয়ে বলছি।

আমাদের রেডিও অফিসে গেস্ট আসে নিজেদের গল্প শোনানোর জন্য, মাসখানেক ধরে। কেও বলে নিজের গল্প অথবা কেও শেয়ার করে তার পরিবারের অভিজ্ঞতা

তবে আজকে যিনি গেস্ট হিসেবে ছিলেন আমার সাথে, তিনি আর যাই হোক, মানুষ নন।
বরং মানুষের চাদরে মোড়া অশরীরী কোনও আত্মা।

একটু থ বনে গেলাম।
পিসিমা একি বলছে ? মাথা ঠিক আছে তো ? নাকি বয়সের ঘোরে এই আবোল তাবোল পরিণতি হতে শুরু করেছে। উনি তো আমার অফিসটা কোথায় সেটা পর্যন্ত জানেন না, তাহলে এসব কথা বলছেন কিসের ভিত্তিতে ?

কথাটা ভাবা মাত্রই তিড়িক করে মাথা খেলে গেল। ছোটবেলায় শুনেছিলাম পিসিমা নাকি জ্যোতিষচর্চা করতেন। সেই জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের অতীত বলে দিতে পারতেন, সঙ্গে ভবিষ্যতের একটা আভাষ। সে বিদ্যে কি আজ উনি আমার ওপর প্রয়োগ করলেন ? কিন্তু কেন ?

বিশ্বাস করতে মন না চাইলেও, পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারিনি। মাস খানেক হোল, পিসিমা কথা বার্তা তেমন বলতেন না, রাতে আমি আসার আগেই ঘুমিয়ে পড়তেন। তবে আজ কেন জেগে ছিলেন ? এই কথাটা বলার জন্য ?
ওনার কোথায় পাত্তা দিএনি, এমন একটা ভাব করে রাতের খাবারটা গরম করে খেয়ে বিছানায় ডুবে গেলাম।



                                                     *                  *                 *


অন্য দিনের তুলনায় আজ ঘণ্টা খানেক আগেই পৌঁছে গেছিলাম অফিসে
আগের শো শেষ হতে তখনও দুই ঘণ্টা বাকি প্রায় হাতে বেশ অনেকটাই সময় আছে সিকিউরিটি ভাই জাভেদ কে জিজ্ঞেস করলাম, কালকে রাতে যে গেস্ট এসেছিলেন, তাকে কি সে দেখেছে ?

উত্তর একদম যথাযথ জাভেদ মোটামুটি যেটা বলল, কাল রাত্রে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন লগ বুকে সাইন করানোর পর ওনাকে ওপরে পাঠালাম ঠিক দুই ঘণ্টার মাথায় উনি আবার নেমে চলে গেলেন

জাভেদ ভাই এর কথার মধ্যে কোনও নতুনত্ত তো ছিলই না স্বস্তি লাগছে আর সঙ্গে একটা বিরক্তি লাগছিল পিসির ওপর
যাইহোক একবার লগ বুকটা দেখে নিলে হয় না ? তাহলেই তো সব মিটে গেলো, নামটা অবশ্য মনে পড়ছে না

এবারের উত্তরটা জাভেদ যেটা দিলো, বেশ ইন্টারেস্টিং  ও মাথা পাগল করার মত লগবুক কাল রাত থেকে গায়েব, পাওয়া যাছে না আজ নতুন লগবুক এনে কাজ করা হছে, আর পুরনোরটার খোঁজ চলছে

অ্যা ? জাভেদ ভাই বলে কি ? লগবুক থাকে আলমারি তে, চাবি দেওয়া, তাহলে ? এক রাতে কি করে হারিয়ে যায় ? তাও কালকেই ?
অজানা অশনি সঙ্কেত কি টিকটিক করছে ?

জাভেদ ভাই
, তুমি একটা কাজ করো, অন এয়ার হতে আমার এখনও অনেক সময় আছে, তাই ততক্ষণ পর্যন্ত একটু সি সি টিভি এর কন্ট্রোল রুমের চাবিটা দেবে ?

ডি ভি আর বক্সে পাসওয়ার্ডটা টাইপ করে জাভেদ আমাকে রুমে একা রেখে চলে গেল
বুকটা হঠাৎ ধড়াস ধড়াস করছে এবার যদি সত্যি কিছু দেখে ফেলি ফুটেজে, তাহলে ? নিজের প্রতিই বিশ্বাস হারিয়ে না ফেলি অদ্ভুতুড়ে ভাবনা মন কে কুড়ে কুড়ে খাছে শান্ত করলাম কোনও রকমে।

আমার কেবিনের ক্যামেরাটা সিলেক্ট করে গতকালের ডেট দিয়ে টাইমটা সেট করলাম রাত ১০টা বেজে ৫৯ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড

স্ক্রিন খুব স্পষ্ট
কালো শার্ট পড়ে আমি বসে রয়েছি, কানে হেডফোন

একটা কথা বলে রাখা দরকার, রাত্রির শেষ শো চলাকালীন অফিসে একমাত্র আমি থাকি, আর নিচে এই সিকিউরিটি গার্ড, জাভেদ ভাইওপরের ডুপ্লিকেট চাবিটা থাকে আমারই কাছে সেক্ষেত্রে একজন গেস্ট যদি আসে, তাহলে সে একাই ওপরে উঠবে আর একাই আমার কেবিনে ঢুকবে, যেটার সম্পূর্ণ ফুটেজ পাওয়া যাবে

স্ক্রিনের দিকে চোখ রেখে রেকর্ডিং প্লে করে চলেছি
নিজের গলা নিজেই শুনছি নিজেই বলছি আজকের গেস্ট এর আসার কথা

কি হোল ? নামটা কোথায় ? কাল নামটা তো বলেছিলাম মনে পড়ছে, তাহলে আজ সেটা শুনতে পাছি না কেন ? মিস করে গেলাম ? হবে হয়তো।

হেডফোনের কানে বাজলো কেবিনের দরজা খোলার শব্দ
আজব একটা ব্যপার হোল, উনি কাল কি গল্প বলেছেন একদম ভুলেই গেছি আমি
খামোখাই ভয় পাছি, আর তার জন্য নাম ভুলে যাচি, কি গল্প বলেছিল সেটাও ভুলে যাচি পিসিমা আমায় তো দারুণ ভয় পাইয়ে দিয়েছেন, সত্যি কথা টা ভাবতে ভাবতেই, চোখ দাড়িয়ে গেলো ফুটেজের দৃশ্যে

কেবিনের দরজা নিজে থেকেই খুলে গেছে, কিন্তু ওখানে কে ? ঠিক তারপরই আমার পাশের বসার জায়গাটা নিজে থেকে একটু নড়ে উঠেছে, যেন কেও এসে এখুনি বসল

ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিলাম
একি দেখলাম আমি ? ফুটেজে কাওকে দেখতে পাছি না কেন? শূন্য স্থান ?
এটা এটা এটা... কি সত্যি
? যার সাথে এত কথা বললাম, , তিনি নিজেই আসলে একটি গল্প ? সমগ্র ফুটেজে শুধু আমি আর আমি, যেন পাগলের প্রলাপ বকছি কারোর সাথে... আমি কি পাগল হয়ে গেছি এক রাতে ? নাকি আমি ভুল দেখছি ???


গলা শুকিয়ে গিয়েছে মাথাটা ঝিম মারা ভাব হয়ে পড়েছে ফুটেজ এর দিকে তাকাতে আর সাহস হছে না
কানের হেডফোন নামিয়ে রেখে স্ক্রিন অফ করে পাশের চেয়ারে এসে বসলাম, চোখ বন্ধ করে। অফিস জীবনে এই প্রথম বার নিজের কাজের প্রতি ভয় অনুভব করলাম আজকের নাইট শিফট এর কথা ভেবেই শরীরে কাঁপুনি অনুভব করতে পারছি, কিন্তু বলতে পারছি না একটু পরে সেই তো ঐ কেবিনেই যেতে হবে আমাকে, সেই একই পজিশন


আছা, আজ অফিসটা কামাই করলে হয় না
?  

ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক কোথায় আছে জানা নেই আচমকা জাভেদ ভাই এর ডাকে হুস ফিরল, “ স্যার, আর দশ মিনিট বাকি, আপনার শিফট শুরু হতে, তৈরি হন

তারমানে এতক্ষণ আমি এখানে আছি অথচ বুঝতেই পারিনি ? ভাবতে ভাবতেই কখন ২ টো ঘণ্টা কেটে গেছে ?

আজকের ডিউটিটা কি না করলেই নয় ? কিন্তু অনেকটাই লেট হয়ে গেছে এই ভাবনার জন্য আর যাইহোক আজ কোনও গেস্ট কে আমি অন্তত হ্যানডেল করতে পারবো না সাথে সাথেই জাভেদ ভাই কে জিজ্ঞেস করলাম আজকের কি কোনও গেস্ট আসছেন ?

জাভেদ বলল, “ স্যার , আপনি ভুলে গেলেন ? কাল গেস্ট এসেছিলো, আজ তো কেও আসার কথা নয়
হ্যাঁ, তাইতও আমি বলেছিলাম একদিন গেস্ট আসবে, তার পরদিন ফাঁকা থাকবে, আমি কল নিয়ে গল্প শুনবো, আর সারা কোলকাতা শুনবে

নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, একটু হাফ ছাড়লাম
কেবিনের দিকে পা চাইছে না এগোতে, অগত্যা মন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলাম ওপরের দিকে।

                                      *                     *                            *


“ হ্যালো বন্ধুরা, আমি উপল এসে গেছি “রাতের মরীচিকা “ অনুষ্ঠানে। তোমরা আছো রেডিও অনুভুতি , ৯৮.৫ এফ এম চ্যানেলে। কথা মত আজ কোনও গেস্ট নয়, আজ আপনি শোনাবেন আপনার সাথে ঘটে যাওয়া না বলা একটি গল্প, যেটা শুনবে সারা কোলকাতা। তবে হ্যাঁ, গল্পটা যেন একটু গা ছমছমে হয়, তাহলে জমে যাবে আজকের রাতটা। নাম্বারটা সবার মনে আছে যদিও, তাও একবার মনে করিয়ে দি, ৯৮৩২১৫৪৮ * * । রইলাম আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায়। “


কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল আজ
অন এয়ার কথা শুরু করতে একটু অসুবিধে হলেও পরে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছি
ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল,  ১১টা ২ মিনিট

ক্রিং ক্রং ক্রিং ক্রংঅফিসের মোবাইলটা চিৎকার করছে, কোনও কলার এরই মধ্যে এসে গেছে

ফোনটা রিসিভ করে বললাম, “ হ্যালো আমি কি আজকের প্রথম বন্ধুর নাম জানতে পারি ? “
ওপার থেকে অস্পষ্ট গলার স্বর, তেমন কিছু শোনাই যায় না
চেষ্টা করে শুনে বুঝতে পারছি, ঘরঘর শব্দে কিছু বলতে চায়, কিন্তু...
ঠিক তখনই একটা মিষ্টি গলা পাওয়া গেল কণ্ঠস্বর একটা মহিলার অথবা মেয়ের, বয়সটা আন্দাজ করা একটু অসম্ভব

হ্যালো, আমি কিছু বলতে চাই, আমি ( একটু নীরবতা ) আমার নিজের সত্যি ঘটনা বলতে চাই
হ্যাঁ, নিশ্চয় তার আগে আপনার নামটা জানতে পারি ? “
না পারেন না, আপনি আমার নাম জানতে পারেন না “ , কোমল কণ্ঠস্বরে হঠাৎই রুক্ষ পরিবর্তন

কি হোল ? কানে লাগলো বড্ড এমন ভাবে তো কেও বলে না কথা আমার সাথে একটু ভিরমি খেয়ে গেছিলাম, এরকম মুখের ওপর থাপ্পড় এর আগে কখনও ফোনে পাইনি আবারও ঐ কণ্ঠস্বর বলে উঠলেন , “ আমি যে ঘটনা বলবো , কতটা সত্য সেটা আমি জানি। আর আমার নামটা গোপন থাক, সেটা জানলে অনেক সমস্যা আছে ।

এ কেমন আবদার, জানিনা এর আগে এমনটা ফেস করিনি আমি। তবুও কেন জানিনা, ওনাকে অ্যালাউ করলাম।
        
                               *                           *                         *

উনি শুরু করলেন কাহিনী।

“ ঘটনাটি তখনের যখন আমি ছিলাম অনেক ছোট্ট। থাকতাম হুগলী জেলার চুঁচুড়ার একটি গ্রামে, একটাই ভিটে বাড়ি ছিল। থাকতাম আমি, মা আর দাদা। বাবা ছোটবেলায় মারা যান। সংসারের দায়িত্ব ভার মা এর ওপর পড়লেও মা সেখানে ভেঙ্গে পড়েননি, আমাদের দুজনকে খুব ভাল করে মানুষ করেছিলেন।
এবার আমার গ্রাম সম্পর্কে একটু ব্যখা দি, নয়তো আসল জায়গা বুঝতে অসুবিধে হতে পারে।

গ্রামের ঈশান কোনের শেষ প্রান্তে ছিল একটি বুড়ো বটগাছ জন্ম থেকেই এমন নাম শুনে আসছি আপনারা কোলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন জানেন নিশ্চয়, সেখানে একটা বিখ্যাত বট গাছ আছে তাই না ?
সেরকমই আমাদের গ্রামের গাছটা আরও বড় ছিল, বিস্তার ছিল প্রায় কয়েক বিঘা জুড়ে, ঠিক একটা প্রাচীরের ন্যায়

গ্রামবাসিদের কথা অনুযায়ী, সেই স্থান অপদেবতার বাস
কেও গেলে সে ফিরে তো আসে তবে একা নয়, সঙ্গে নিয়ে আসে অভিশাপ, যেটা তার আসে পাশে থাকা সকল মানুষের ক্ষতি করে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে
গ্রাম থেকে বেরোনোর জন্য সব থেকে শর্টকার্ট রাস্তা ঐ বটগাছের কাছ থেকে হলেও, গ্রামবাসিরা ওদিকে ভুল করেও মাড়ায় না

ভূত বা অপদেবতা কোনটাই আমি বা দাদা মানতাম না। তাই কখনই সেই বিষয়ে পাত্তা দিয়নি, বরং কৌতূহল মেটাতে মাঝে মধ্যে ওখানে যাওয়ার কথা ভেবেছি।

যখন কিশোর জীবন ছাড়িয়ে গেলাম দুজনেই, একদিন স্থির করলাম ওখানে যাবো, তবে খুব রাতে। মা ঘুমিয়ে না পড়লে, আমাদের নিশি ভ্রমণ পণ্ড হয়ে যেতে বাধ্য।
আজ আমি যে ঘটনা বলতে চলেছি, সেটা সেই রাত কে কেন্দ্র করে।

কিছুক্ষণ একটু সাইলেন্স, ওপার থেকে কোন শব্দও আসেনি। মনে হয় নিজেকে উনি প্রিপেয়ার করছেন। কিছু মুহূর্ত পর শুরু করলেন।



পূর্ণিমার পরের রাত। চাঁদ পুরো দেখা না দিলেও, গ্রামের রাস্তায় হাটতে টর্চের দরকার হয়না। দাদাভাই পকেট টর্চটা সঙ্গে নিয়েছিল তাও।

রাত ১টা।
দাদা আর আমি সমানে হাঁটছি, চুপি চুপি। নিজদের পাড়াটা পেরনোর পর ধু ধু জমি প্রান্তর। ধান কাঁটা সবে মাত্র হয়েছে, তাই মাঠটা খালি খালি লাগছে। জমির আল বরাবর রাস্তা খুব সহজেই বোঝা যায়। আলের রাস্তা এতটাই সরু, যেকোনো একজনকে সামনে যেতে হবে। দাদার পিছু পিছু চললাম আমি। হাটতে হাটতে ডান বাম দেখছিলাম, মাঠের শূন্যতাও যেন কিছু কথা বলে। চাঁদের আলোয় মাঠের এমন রূপ এর আগে দেখিনি। একটা শুকনো অথচ মিষ্টি বাতাস বইছে কানের পাশ দিয়ে।
মিনিট খানেক সময় পর জমি শেষ হোল, আমরা ঢুকে গেলাম পাশের একটা পাড়ায়। এর পড়ে বিশাল একটা মাঠ রয়েছে। মাঠ পেরলেই একটা বড় পুকুর। সেই পুকুরের একটা অংশে সেই বট গাছের ঝুড়ি নেমেছে। শুনেছি সেই পুকুরের জলটাও খুব কালো, কেও ভয়ে সেই জলেও নামে না।

মিনিট দশের মাথায় আমরা যখন পউছালাম পুকুরের পাড়ের অনেকটা কাছেই, দুজনে দাড়িয়ে পড়লাম পাশাপাশি।
ভয়াবহ এক ধরণের অনুভুতি আমার মধ্যে মুহূর্তেই সঞ্চার হোল। সেই মুহূর্ত থেকে মনে হতে থাকলো, আর এগোনোটা ঠিক হবে না। এবারে মনে হয় ফিরত চলে যাওয়াটাই ভাল।

দাদার দিকে তাকালাম, সে তো বেশ খোস মেজাজে আছে তখনও।
“ দাদা, ফিরে চল। আমার ঠিক ভাল লাগছে না এই জায়গাটা।“, ভয়ে বলেই ফেললাম।
“ দূর, পাগলী ভয় পেয়ে গেলি ? এতদূর এলাম দেখি না কি হয়
বোকা, এসবে ভয় পাশ না, আমি আছিতো
“ তুই আছিস বলেই তো ভয়, চল দাদা ফিরে চল “
কথাটা শুনে একটু বিরক্ত হয়েই দাদাভাই বলল, “ শোন, তুই গেলে যা। আমি এখানটা এক্সপ্লোর করেই যাবো “
দাদার একগুয়েমি ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্টই অবগত আমি, তাই কথা বাড়াতে সাহস হোল না।

মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ কি একটা উড়ে গেলো না ? “এই দাদা ওটা কি রে ? “
 “ পেঁচা হবে হয়তো। তুই এত ঘাব্রাছিস কেন ? “
“ উহু, আমার ঠিক ঠাক ফিল হছে না রে, বাড়ি ফিরে গেলে হয় না ?”

ডান হাতের তর্জনী ঠোঁটে ছুঁইয়ে আমায় ইশারা করলো দাদা, যেন কিছু একটা শুনতে পেয়েছে।
কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল ও,পুকুর পাড় দিয়ে ঐ বট গাছের দিকে।

ধমাস করে একটা আওয়াজ হোল পুকুরের মধ্যে। কিছু ভারি জিনিস পুকুরে এই মাত্র ফেলা হয়েছে
শব্দ শুনে যতটা চমকে গেলাম, তার থেকেও ভয়ের ব্যাপার যে আমরা ছাড়াও এখানে কি আর কেও আছে ? যাকে চোখে দেখতে পারছি না ? যদি কেও না থেকে থাকে তাহলে এটা কি করে সম্ভব হোল ?

একটু ভয় যে পেয়েছি, দাদা আমার মুখ দেখে বুঝতে পেরেছে। আমাকে নিঃশব্দে বলে দিলো, কিছু ভয় নেই, আমি আছি তো।

ঝুড়ি গুলো দূর থেকে দেখলেই যেন গা শিউরে উঠছে। জট পাকিয়ে কোনও একটা জটাধারী তার এক একটা জটা ঝুলিয়ে রেখেছে যেন। যত ভেতর দিকে চলেছি, অন্ধকার নিকষ কালো রঙ ধরেছে। পকেট থেকে টর্চ টা বার করে নিয়ে জটা গুলো লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে আলোটা ওপরে ফেলছে।
ছোটবেলায় মা কে বলতে শুনতাম, রাত্রিরে গাছে আলো ফেলতে নেই। গাছরা নাকি সেই সময় ঘুমোয়। আসল কারণটা যদিও এটা নয়।
গাছের ঠিক যে স্থানটা আলোকিত হছে, তার ঠিক পাশের অংশেই যেন কিছু আছে এমন অনুভুতি হছে, সাঙ্ঘাতিক একধরনের অনুভুতি।

ওপরের দিকে তাকাতে তাকাতে আমিও এগিয়ে চলেছি, তখনই কি একটা পায়ে আঁটকে হোঁচট খেয়ে পড়লাম।

তৎক্ষণাৎ দাদা এসে আমায় তুলে দিলো। পায়ের দিকে টর্চটা ফেলতেই শিউরে উঠলাম দুজনে। একটা কলাগাছ ও তার একটা ছোট্ট খণ্ড আড়াআড়ি করে পড়ে আছে, আর তার গায়ে সিঁদুর দিয়ে কিসব আঁকা।
দুটো লাল চকচকে বড় গোল্লা, ঠিক মানুষের চোখ।
মানুষের মুখ, কপালের স্থানে একটা পেরেক মত পোতা।
সবুজ আর লাল রঙ একসাথে এতটা বীভৎস হতে পারে ? এই দৃশ্য না দেখলে হয়তো কখনই জানা সম্ভব হতো না।
বিদঘুটে একধরনের কিছু, দেখলেই বুকের ভেতরটা খ্যাছ করে উঠবে, তার ওপর অমন অন্ধকার। লাল রঙটা চকচক করছে, চোখের মাঝে। যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে দ্যাব দ্যাব করে। অস্বস্তি যেমন হছে, তার থেকে বেশী ভয় লাগছে আমার।

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “ এটা কি রে দাদা ? “
“ জানিনা, তবে অস্বাভাবিক ঘটনা এখানে যে ঘটে, এটা তার প্রথম প্রমাণ। “


কথাটা শেষ হওয়ার আগেই, কান ফাটানো আওয়াজ হোল গাছের ওপরের দিকে।
“ হিইই হিই হিইই হিইইই হিই হি হিইইইই হিইই “
“ হিইই হিই হিইই হিইইই হিই হি হিইই “

সারা শরীরে চাবুক বাড়ি মারলেও এমন শিহরন হয় না, যেটা এখুনি হোল। মাথা প্রায় ঘুরে যাওয়ার জোগাড়।
এমন নাকি সুরে কান ফাটা চিৎকার, এই প্রথম শুনতে পেলাম। দুজনেই চমকে ওপরের দিকে এদিক ওদিক চোখ ফেলছি। কেও কোথাও নেই।
শব্দটা বাম থেকে ডান, ডান থেকে বাম দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, অনবরত সেই খিলখিলানি শব্দ। কেও কি হাসছে আমাদের দেখে ? কে সে ? অথবা কি সেটা ? বটের ওপরের ডাল পাতাগুলো নড়ে চলেছে।

দেখলাম দাদার চোখ জ্বলজ্বল করছে। মনে হয় কিছু একটা পেয়েছে, যেটার জন্য এখানে আসা।
টর্চের আলো,ওপরে খিলখিল শব্দ অনুসরণ করছে, কিন্তু কোথাও কিছু দেখা যাছে না।
গাছের ওপরটা তছনছ হয়ে চলেছে, ঠিক যেন ঝড় উঠেছে বিনা কারণে।

গাছের ডালপালা তোলপাড় করছে,মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে।

এদিক ওদিক কোথাও যখন কিছু পাছি না, ঠিক তখনই হাসিটা থেমে গেল, সঙ্গে থেমে গেল গাছের তোলপাড়। কানের কাছে হঠাৎ শূন্যস্থান , চি চি করছে।

টু শব্দ না করে দাদা এগোলও আরও ঘন দিকে।
দাদার সাথে সাথে আমিও আর একটু ভেতরে ঢুকলাম। চলেছি দুরুদুরু বুকে, দাদাই ভরসা এখন। না পারবো পেছনে ফিরতে না পারবো একা যেতে।
চাঁদের আলো এই স্থানে একদম ঢুকছেনা, ঘুটঘুটটি অন্ধকার। যেদিকে আলো ফেলি শুধু সেই অংশ টুকুই আলো, বাকিটা আঁধারে খাওয়া।

“ কি রে ফিরে যাবি এবার ? “ দাদার মুখে এই কথাটা এখনি শুনবো ভাবতে পারিনি। দাদা ভয় হয়তো পায়নি, কিন্তু আমার জন্যই হয়তো... আমার মুখ দেখে দাদা হয়তো বুঝতে পেরেছে...

পেছন ঘুরে, আলো ফেললাম সরাসরি পেছনের অংশে। আলোর শেষ প্রান্ত গিয়ে পড়ল একটা সাদা অংশে।



সাদা ধবধবে সেই শাড়ির নিচে এক জোড়া পা, পিছন ফিরে আছে। হাত কেঁপে উঠলো দাদার।
গলা দিয়ে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ কে ? “ কোনও উত্তর এলো না।
এবারে দাদা কাঁপা গলায় চিৎকার করতে গিয়েও মিনমিনে গলায় বলল, “ কে ? “
ওদিক থেকে তখনও নেই কোনও উত্তর।

তখনও আলোটা ধরা, সামনের ঐ জিনিসটাও দাড়িয়ে। ধীরে ধীরে দাদা টর্চের আলোটা ওপরের দিকে তুলতে শুরু করেছে, আস্তে আস্তে। পিঠের কাছে আলো রাখতেই সেখানে পিঠের পরিবর্তে একটা মহিলার বক্ষ, ভেজা। যেন একটু আগে পর্যন্ত নিজেকে জলে ডুবিয়ে রেখেছিল
নিঃশ্বাস পড়ছে স্পষ্ট, বুকের ওঠা নামা চলছে, কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নয়। কোনও মানুষ রাগান্বিত হয়ে গেলে, যেমন ফোঁস ফোঁস করে, এখানেও খানিকটা সেরকমই
সাহস হছে না আর আলোটা ওপরে তুলব কিনা ?

ভয়ে ভয়ে আলো যখন আর একটু ওপরে উঠেছে, ওরে বাবাহ।

একি দেখলাম, সেখানে কোনও মহিলার মাথা নেই,নেই কোনও চুল। কবন্ধ নয়, কিন্তু ধড়ে বসানো রয়েছে যেটা, সেটা সেই কলাগাছের সিঁদুর আঁকা সবুজ লালে মাখা একটা ভয়াবহ ফালি, আর তার চারিপাশে রক্ত। সিঁদুরে আঁকা চোখ গুলো কেমন ফালা ফালা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। রক্ত যেন ঝরে পড়ছে সবুজ অংশে। দৃষ্টি ভস্ম করে দেওয়ার মত, যেন কিছু ভুল করেছি আমরা।

আমি বোধয় সংজ্ঞা হারাতাম এমন একটা বিচ্ছিরি দৃশ্য দেখে, দাদা আমাকে যদিনা ঝাঁকুনি দিয়ে ওখানে থেকে টেনে হিঁচড়ে অন্য রাস্তায় নিয়ে এগাত। কোন দিকে দৌড় দিয়েছি জানিনা, দাদা চলেছে।

আবার সেই হি হিহহ হিইই হিইই শব্দ।
ঠিক একদম পেছন থেকেই আসছে, ঠিক কানের কাছে, কানের মধ্যে যেন ঢুকে যাবে আওয়াজটা। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে আসছে, আমাদের ধাওয়া করে। যেন আমাদের পেলেই ঘাড় মটকে দেবে। চিৎকারটা এগিয়ে আসছে আমাদের পিছু পিছু।
 
থামলে চলবে না। দৌড়ান থামালেই হাতের নাগাল পেয়ে যাবে, আর আমরা...
বীভৎস সেই চিৎকার এভাবে আমাদের ধাওয়া করছে, আমি আর কিছু ভাবতে পারিনি।
দৌড় দৌড় দৌড় !

দাদাকে ফলো করছি।  কিন্তু ঠিক আবার আমি হোঁচট খেলাম, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনে মুখ থুবরে। কেও কি আমায় ল্যাং মেরে ফেলে দিলো ?

“ দাদা , দাদা, বাঁচা আমায়... “, চিৎকার করে বললাম, দাদা পিছিয়ে এলো সাথেই সাথেই।

পেছন ফিরে দাদা এসে তুলতে গেল আমাকে,ঠিক তখনই দেখলাম দাদার পেছনে সাদা ওটা কি দাড়িয়ে ভাসছে ? মাথার ওপর সোজাসজি ? ওটা কি ? ওটা কি????
মুহূর্তের মধ্যে দাদাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলল ওপরে
বটগাছের ঝুড়ি গুলো ঠিক যেন জীবন্ত হয়েছে। অক্টোপাসের শুঁড়ের মত দাদাকে এক স্থান থেকে আর এক সাথে নিয়ে চলেছে, পারলে শরীররা মাঝ খান থেকে যেন ছিঁড়ে ফেলবেসামনে ঐ সাদা কুণ্ডলীটা কি ঘুরছে, আর তার সাথে সেই বুক ছেঁড়া আওয়াজ...

কি করবো বুঝতে পারছিনা আমি। কোনও রকমে মাটি ছেড়ে উঠে দাদার ফেলা টর্চটা নিয়ে দাদার দিকে আলো ফেললাম। সাথে সাথেই ঝুরিগুলো শান্ত হয়ে গেলো, আর দাদা প্রায় পড়েই যাচিল শূন্য থেকে, শেষমেশ নিজেকে একটা শাখায় আঁটকে রেখে ঝুলে পড়েছে।
বেশী সময় নষ্ট করেনি , দাদা নিচে নেমে এসেই আমার দিকে এসে বলল, “ চল, আর এক মুহূর্ত নয় এখানে। “

দৌড়ে কোনরকমে পুকুরের কাছে এসে পড়েছি আমরা। আর ঠিক তখনই আমি অনুভব করলাম নিজের পা আর নাড়াতে পারছি না, ভারি হয়ে গেছে পা দুটো।

“ দাদা, আমি আর এগোতে পারছি না, আমার পা দুটো আর নাড়াতে পারছি না। “
কথাটা শেষ করিনি, একটা আর্তনাদ। দেখলাম দাদাকে ঘিরঘির করে টেনে নিয়ে চলেছে অদৃশ্য একটা শক্তি, পুকুরের দিকে।
চিত হয়ে শুয়ে আছে, এদিকে ওদিক করছে কিছু ধরার জন্য, নিজেকে আটকানর জন্য,মুখে চিৎকার...
চোখে পড়ল সেই সাদা কিছু, যার না আছে হাত না আছে মাথা...  কি করে নিয়ে যাচে পুকুরে, আমি বুঝতে পারছি না। এদিকে আমি নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারছি না। ভয়ানক একটা পরিস্থিতির মুখে আমি দাদাকে বাঁচাবো কি করে।

দাদা কে টেনে নিয়ে গেল পুকুরের জলে।
দাদা পরে গেছে পুকুরে,
জলে ডুবছে, ডুবছে...

“ হে ভগবান, রক্ষা করো ভগবান। রক্ষা করো “, জোরে চিৎকার করে বললাম নিজের শরীরে যতটা শক্তি ছিল সব সঞ্চয় করে

ঠিক তখনই কি হয়েছে জানিনা, পায়ে জোর ফিরে পেয়েছি। দৌড়ে দাদার কাছে চলে গেলাম কোনও রকমে।

তখনও দাদার কিছু অংশ জলের ওপরে আছে। কোনরকমে গিয়ে দাদার বাড়ানো হাতটা আমি ধরে নিলাম। পেছনের দিকে টানতে শুরু করলাম।

অনুভব করলাম, দাদাকেও জলের নিচ থেকে কিছু একটা টানছে। কিছু একটা আছে, যেটা দাদাকেও ছাড়ছে না। আমি আমার দাদাকে বাঁচাবই। যেভাবে হোক, আমি দাদাকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।
  
এই বলে দাদার দিকে তাকিয়ে একটা জোর টান দিতে যাবো, ঠিক তখনই একি দেখলাম ?
দেখলাম দাদা ডুবন্ত মুখ জল থেকে ওপরে উঠেছে, কিন্তু সেখানে দাদার মাথার জায়গায় সেই কলা গাছের রক্তাক্ত মুখ বসানো, আমার দিকে রক্তচক্ষু ভাবে তাকিয়ে আছে, ভস্ম করে দেবে। কি ভয়ানক...


“ হিহিহিই হিই হিইই হিইই “, কান ফাটানো শব্দ...

“ কি রে আর আসবি এখানে ? “ প্রশ্নটা এলো পেছন থেকে। পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে আছে একটা সাদা শাড়ী পড়া নারী দেহ, যার পায়ের পাতা উলটো দিকে, আর ধড়ে মাথা নেই। গলার শব্দও ঐ শূন্যস্থান থেকেই আসছে।

এই মুহূর্তে আমি হয়তো সেন্সলেস হয়ে যেতাম, কিন্তু অজানা একটা জোর আমাকে পেয়ে বসেছে, দাদাকে আমায় বাঁচাতেই হবে। একদিকে দাদাকে ধরে আছি, আর একদিকে কবন্ধ, উত্তর দিলাম ,“ ছেড়ে দাও আমার দাদাকে।“

“ হিহিহি হিহি হিহিইইই “ , কোনও উত্তর না দিয়ে পাঁজর হাড় শক্ত করা হাসি হেসেই চলেছে।
“ ছেড়ে দাও আমার দাদাকে, আমরা তোমার কি ক্ষতি করেছি ? ছেড়ে দাও আমার দাদাকে “

অট্টহাসি তখনই চলছে, এবার আরও জোরে। পাশে থাকা বটগাছ সেই হাসির সাথে সাথে যেন জীবন্ত হয়েছে। বট ঝুড়ি গুলো দুলছে হাসির তালে তালে, যেন নতুন রসদ এসেছে
এই রকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য সহ্য করতে আর পারছি না।

কি করবো বুঝতে পারছি না।
“ ছেড়ে দাও আমার দাদাকে, কি চাও তুমি ?”, জোরের সাথে বললাম।

কথাটা যেন তার মনের মতই হয়েছে, সে জন্য শাড়ী পড়া সেই অংশটা নিজেকে হেলিয়ে দুলিয়ে এদিক ওদিক করতে থাকলো, আর আস্তে আস্তে সামনে ভেসে এলো। এতটা ভয় লাগছিল যে নিজের চোখ বন্ধ করতেও পারছি না।

কোনও রকম ভূমিকা করেনি, শুধু খনা গলায় আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ তোদের বংশের প্রথম সন্তান কে আমায় দিবি বল ? তাহলে আমি তোর দাদা কে ছেড়ে দেবো, ইহিইইহিই  হিহিহ হহিহিইইই “

অত সাত পাঁচ আমি ভাবিনি, বলে দিলাম, “ হ্যাঁ দেবো, এবার আমার দাদাকে ছাড়ো। “
চুপ করে আছে সাদা শাড়ী পড়া অংশটা। কিছু ভাবার আগেই আবার বলল, “ ঠিক তোঁ ? কথা দিছিস ?”
“ দিলাম কথা, ছেড়েদাও আমার দাদাকে ।“

কথা শেষ হওয়ার মুহূর্তের মধ্যেই সাদা কাপড় ধোয়ার মত মিলিয়ে গেল। এদিকে হাতে তেমন টান অনুভব করলাম না। দাদার দিকে ঘুরে আস্তে আস্তে ডাঙ্গায় আনতে সক্ষম হয়েছি। জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে পড়েছে। কিছু সময় পর যখন জ্ঞান ফিরল, আর বেশী সময় নষ্ট করিনি।
সব কথা আমি বলিনি, কোনও রকমে ফিরলাম ঘরে।

গল্প শেষ করে মহিলা একটু চুপ করে গেলেন।

এতক্ষণ আমিও ফোনের ওপার থেকে সমস্ত কিছু শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
রেডিওতে এমন ভয়াবহ ব্যাখ্যা মনে হয় এই প্রথম পেলাম। সত্যি গায়ে কাঁটা দেবার মতই। মিথ্যা  কিনা জানিনা, তবে গল্পটা দারুণ, জম্পেশ। কোনও সম্পাদকের চোখে পড়লে লুফে নিতে পারে।

                                     *                     *                             *


সত্যি বলতে গল্প শুনে নিজের ভয়ের কথাই ভুলে গেছিলাম মুহূর্তের জন্য।
 হুস ফিরতেই বললাম, “ চমৎকার একটি গল্প আমাদের উপহার দিলেন। আশা করি আমাদের শ্রোতা বন্ধুরা অনেকটা পছন্দ করেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আমাদের এভাবে একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য “

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই কথা কেড়ে নিয়ে সেই মহিলা কণ্ঠ আবার বলে উঠলো, “ আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।“

ভিরমি খেয়ে গেলাম, এই যাহ্‌ ! ভুল হয়েছে। আসলে নিজে একটু তাড়াহুড়ো করছিলাম, সিঙ্গেল গল্পের লেন্থ একটু বেশী হয়ে গেছিল তাই আর কি...
“ সরি সরি, এই গল্পের উপসংহার আছে নিশ্চয়। বলুন আপনি...”

কিছুক্ষণ কোনও শব্দও আসেনি ওপার থেকে।
তারপর ঠিক সেই মুহূর্ত এলো যেটা আমার কল্পনার বাইরে।
একটা চেনা কণ্ঠস্বর আমাকে চমকে দিলো। কতটা চমকেছিল সেটা আমি জানি একমাত্র
আমার ডাকনাম ধড়ে ডাকল, “ বাবান “

এটা তো পিসিমার গলা...  কিন্তু এটা কি করে সম্ভব ? পিসিমার শরীর তো এমনি ভাল নেই, তাছাড়া সে এভাবে আমাকে কেন...

ভাবনাকে আঁটকে দিয়ে সেই ভয়ার্ত কণ্ঠে কথা এগোতে থাকলো,
“ বাবান, খুব ভুল করেছি আমি, তোর বাবা কে সত্যিটা না জানিয়ে।
অভিশাপটা আমাদের লেগে গেছে রে। তোর জন্মের পর আমি তোকে কোলকাতায় নিয়ে চলে এলাম, ওদিকে তোর বাবা মা কোনও এক্সিডেন্ট এর মরেনি, ঐ কবন্ধ মেরে ফেলেছিল। আর আজ তুই সন্ধেতে চলে যাওয়ার পর কবন্ধটা আমাকেও...
তুই ঐ অফিস থেকে বেড়িয়ে যা, এখুনি বেড়িয়ে যা। কাল যে মানুষের রূপে তোদের অফিসে এসেছিল, সেটা ওটাই ছিল। আমি বলতে গিয়েও বলতে পারিনি... আমি জানতাম... আমায় ক্ষমা করিস বাবান, তুই অফিস থেকে বেড়িয়ে যা এখুনি...
ও তোর পিছু নিয়েছে...

কথা শেষ হওয়ার আগেই কারেন্ট চলে গেলো, পুরো বিল্ডিঙের। চমকে উঠলাম আমি, এটা কি শুনলাম। পিসিমার গলা, অপদেবতা, মা বাবার এক্সিডেন্ট সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। সারা ঘরটা অমবস্যার কালো রঙ ধরেছে। কারেন্ট এখনি যেতে হোল ? ইনভারটার কাজ করছে না নাকি ?

যা ভাবছি এসব হতেই পারে না, আমার পিসি... আবার ভয় দেখাছে ?
মোবাইল ফোনটা বার করে মুখের সামনে স্ক্রিন অন করতেই আভা আলোয় সামনে একটা মুখ ভেসে উঠলো। মুখ নয়, কলাগাছের সবুজ লাল মাখানো কিছু, একটু আগে ঠিক যেমনটা শুনলাম, তেমনই...

হিহিইই হিইই হিইইইই হিইইইইইইইইইইইইইইইইইইইই
হিহিইই হিইই হিইইইই হিইইইইইই  হিইইই হিইইইইইইই
 



      

                                ***                     !! সমাপ্ত !!                          ***

Comments