মেঘের দেশে অভিশাপ




প্রথম পর্ব -


তিন ক্ষুদে বন্ধু
, বয়স আন্দাজ ১২ এর কাছাকাছি এই বয়সে যে চঞ্চলতা থাকে, সেটা ওদের মধ্যে অফুরন্ত হাজার হোক, পাহাড়ি এলাকার মানুষ, খাসি গোষ্ঠীর রক্ত বইছে নির্ভেজাল আনন্দ করতে করতে ওরা এগিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে
পাইন গাছের সবুজ ছায়া পেরিয়ে পাহাড়ি পথে আসতে আসতে এগিয়ে চলেছে পিঠে ছোট্ট একটা করে ব্যাগ
পাশে থাকা জলপথ ওদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলেছে
হাটতে হাটতে ওরা তিনজন রুট ব্রিজের কাছাকাছি এসে পড়ল
মেঘালয়ের অন্যতম দেখার জিনিস এই রুট ব্রিজ। পাথুরে পথের এপার থেকে ওপার, প্রকৃতি সংযোগ ঘটিয়েছে, শুধুমাত্র গাছের শেকড় ও কাণ্ড দিয়ে।
প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হয়েছে একটি সেতু, যেটা দেখতে বিচিত্র এবং চমৎকার
বটবৃক্ষের মূলে গড়া এই প্রাকৃতিক সজ্জা, খুব বিরল।
 

ঘন নিকষ কালো মেঘ পুরো আকাশ কালো করে ফেলেছে, মাথার ওপরে।
এখান থেকে
গ্রামে ফেরার রাস্তা এখনও অনেকটা দূরে, কিন্তু পৌঁছাবে কিকরে ?মেঘের যা অবস্থা তাতে মনে তো হয় না, খুব তাড়াতাড়ি থামবে না

চিন্তায় চিন্তায় একজন ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো , “ পাহাড়ি উস  শর্টকার্ট রাস্তা সে চ্যালে ?”

অপর দুজন সিটকে উঠলো এই কথাটা শুনে, কিছুটা ভয় পেয়েছে মনে হোল। যেন কোনও ভয়ানক প্রস্তাব দিয়েছে।

“ ন্যাহি, অয়াহা ভূত রাহেতা হেইন “।
আর একজন গলা মিলিয়ে বলল, “ মেইন ভি নেহি জায়ুঙ্গা  

ছেলেটি হেসে উঠলো, “ আরে ও তো বহত সাল পেহেলি কি বাত হেইন, আব কুছ নাহি হেইন
চালো জলদি, নাহিতো  বারিস আজায়েগা।“, কথাটা শেষ করা মাত্র ছেলেটি অন্যদিকে ছুট লাগাল
বন্ধুকে দৌড়াতে দেখে বাকি দুই বন্ধু পিছন ধরল, না ইছে থাকা সত্ত্বেও।

রুটব্রিজের ডান দিক দিয়ে একটা ঢালু রাস্তা নেমে গেছে পাথরে এবড়ো খেবড়ো ভাবে
পাথুরে পথে হাটতে হলে বড় বড় পা ফেলতে হয়, আর একটু অন্যমনস্ক হলেই বিপদ, মুখ থুবরে থেঁতলে যাবে সাথে সাথে
পাথুরে রাস্তা শেষ যেখানে, শর্টকাট রাস্তাটা শুরু হয়েছে সেখান থেকে।

রাস্তা বলা ভুল হবে, একটি সুরঙ্গ গুহা পথে এগিয়েছে অন্ধকার এই পথটি।
মাওলিলং গ্রাম মাত্র ১০ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়, এই পথ ধরলে।

তিন বন্ধু কিছুটা ভয়ে ও কিছুটা আগ্রহের সাথে সেই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে প্রবেশ করলো।
ভেতরে চারিদিকটা শান্ত,মনে হোল ঠিক কিছুক্ষণ আগেও এখানের পরিবেশ আলাদা ছিল। ওরা আসতেই সেটা পরিবর্তন ঘটেছে।
হঠাৎ করে কোলাহল চুপ করে গেলে কানে এক ধরণের পিন ড্রপ সাইলেন্স বাজে। এখানটাও সেরকমই।

বড্ড নিঝুম এই পরিবেশে বাকি দুজন যখন একে অপরকে হাত ধরে ধরে হাঁটছে, তখন অন্য ছেলেটি চিৎকার করতে করতে এগিয়ে চলেছে, নিজের ভয় লুকোতে নাকি সাহস দেখাতে, সেটা সেই জানে।
যেদিকে তাকায় না কেন, পাথর গুলো অন্ধকারে বসে আছে গুম মেরে। গা ঘেঁষে জলের ফোঁটা পড়ছে চুইয়ে।
পাথরের আকার গুলো বড্ড বেয়াড়া ও রুক্ষ, গায়ে একটু স্পর্শে লোহিত কণিকা বার করে দেবে।

ওরা যত ভেতরে প্রবেশ করছে, আবহাওয়াটা একটু একটু করে গুমোট হতে শুরু করেছে। ভীতু দুটি ছেলে পা এর গতি বাড়িয়েছে। কোথাও যেন একটু অস্বস্তি অনুভব করছে।


ছেলে তিনটি কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না যে ওদেরকে কেও বা কারা নিজেদের খোরাক করার জন্য ওত পেতে আছে। অনেকদিন ধরে মানুষের স্বাদ পায়নি। আজ পেয়েছে তিনটি বড় বড় ভোজনের উপকরণ।


মুহূর্ত খানেক পরে সাহসী বন্ধুটি চিৎকার হঠাৎ থামিয়ে দিলো। স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে, একদৃষ্টে সামনের দিকে তাকিয়ে।
সে আর এগোতে পারছে না ? না চাইছে না ? সামনে কিছু দেখল নাকি ?

ভয়ে ভয়ে হাটতে হাটতে বাকি দুটি ছেলে যতক্ষণে ওখানে গেল, ছেলেটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, ভয়াবহ কিছু একটা দেখেছে এমন ভান করে

গলাটা গম্ভীর করে ঐ দুজনের উদ্দেশ্যে বলল,
“ সামনে সে কুছ আওয়াজ সুনাই দে রাহা হেইন তুম দোনো কো?”
এমনিতেই ভয়ে ছিল, এসব শুনে দুজনে আরও ভয় পেয়ে গেল। ছেলে দুটোর পা থরথর করছে


ঠিক তখনই হা হা করে হেসে উঠলো ছেলেটি, পুরো গুহা ফাটিয়ে আওয়াজটা ছড়িয়ে পড়ছে, “ডর গ্যায়া, ডর গ্যায়া...”


ছেলে দুটির কিছুটা বিরক্তি লেগেছে, সম্মানেও লেগেছে বইকি

একেই এই রাস্তা ভাল না, তার ওপর মজা করার সময় পায় না।
ছেলে দুটোর একজন ঐ সাহসী ফাজিল ছেলেটাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে অন্য কে নিয়ে এগিয়ে চলল। পেছন থেকে “ হাঁ হাঁ হাঁ “ শব্দ করছে তখনও।



সামনের রাস্তা আর একটু খানি,আলোপথ প্রায় দেখা যাছে বিন্দু আকারে। প্রায় পৌঁছে গেছে ওরা শেষ প্রান্তে

দুজনে যত না বেশী রেগে গেছে, তার থেকে বেশী ভয়ে ওরা গুহা থেকে বেরোতে চায়, যত তাড়াতাড়ি পারে। এই গুহার অনেক দোষ আছে, বাবা বলেছে।
 
পেছন থেকে হাসির শব্দ টা অনেকক্ষণ মিলিয়ে গেছে, তা ওরা খেয়াল করেনি। গুহার সুরঙ্গ পথ যখন শেষের পথে,ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল। “ বাঁচালো মুঝকো, বাঁচালো মুঝকো ... “


শব্দটা খুব জোরালো, সম্পূর্ণ সুড়ঙ্গপথ জুড়ে চারিদিকে খান খান তীব্র গতিতে জোরালো শব্দে ওদের কাছে এলো।
“ বাঁচাও মুঝকো, অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ... “ শেষের চিৎকার গুলো কোথায় যেন প্রবেশ করে যাছে। মিলিয়ে যাছে গুহার শব্দ তরঙ্গে।

এই আর্তনাদ মজা করে করেনি। ওদের বন্ধু বিপদে পড়েছে, সত্যি তা বুঝতে পেরেছে।

আর একটু গেলেই সুরঙ্গ শেষ, ওরা পিছনে যাবে না সামনে ? দোনোমনো কাটিয়ে ফেলল।
বন্ধুকে একা ফেলে আসাটা খাসি ছেলেদের রক্তে লেখা নেই, সম্পর্কে সাচ্চা।

পিছন পথ ধরল দুজনে দৌড় শুরু করে

কিছুটা যাওয়ার পর সেই স্থানে গেল, যেখান থেকে ওরা ওকে একা রেখে এসেছে। চোখে পড়ল বন্ধুটার পিঠের ব্যাগ।কীভাবে হোক ধস্তাধস্তির ফলে ভেতর থেকে বই খাতা বেড়িয়ে এসেছে, আর একটু লাল ধরণের কি একটা লেগে আছে তরল ছিটেফোঁটা


গলা থেকে শব্দ উঠছে না এমন দৃশ্য দেখে। মাথার ওপর থেকে সড় সড় করে কিছুর একটা শব্দ পাওয়া যাছে। ঠিক কিছু একটা তাদের মাথার ওপর থেকে যাচ্ছে


ছেলে দুটি ভয় পেয়েছে, ওপরের দিকে চাইলেও তাকাতে পারছে না।
ওদের বন্ধু কে ওখানেই তো রেখে গেছিল, তাহলে গেল কই ?
মুহূর্ত নষ্ট না করে ওরা পিছন ঘোরা মাত্রই, ওপর থেকে ধপ করে সামনে পড়ল একটা রক্তমাংস ছাড়া একটি কঙ্কাল, শুধুই হাড়। সদ্য চামড়া ছাড়িয়ে, সমস্ত মাংস শুষে খেয়ে নেওয়ার পর যেই অংশ পড়ে থাকে, সেই রক্ত মাখা সম্পূর্ণ ছোট্ট নর কঙ্কাল।

দিক শূন্য হয়ে দুই বন্ধু প্রানের ভয়ে ছুটল আলোর দিকে। পিছনে একটা বিকট শব্দও ওদেরকে তারা করেছে। হুরমুরিয়ে একসাথে ওদের দিকে তিরের ফলার মত দৌড় দিয়েছে, শব্দ শব্দ করতে করতে... খাবার হাতছাড়া করা যাবে না।
নিঃশ্বাস এর ওপর জোর রেখে ছেলে দুটো ছুটে চলেছে , ছুটে চলেছে। সামনের আলোর বিন্দু বড় হছে, আর একটু আর একটু...

মাওলিলং গ্রামে পা রাখতেই, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে দুজনে






দ্বিতীয় পর্ব -



আরম্ভ -

কোলকাতা ছেড়ে এসেছি প্রায় দিন তিনেক হোল, উঠেছিলাম চেরাপুঞ্জি এর সহরা ভিলেজ এ।
মেঘালয় এ কর্ম সুত্রে এলেও, এই দিন কয়েকে সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গেছি এই স্থানের।
শিলং থেকে মোটামুটি ১৪০০ কিমি ওপরে এই সহরা ভিলেজ। সমগ্র মেঘালয়ে খাসি, জয়ন্তিয়া, গারো এই তিন সম্প্রদায়ের লোক দেখতে পাওয়া গেলেও, সহরাতে সম্পূর্ণটাই খাসি এর দখলে। এদের সমাজজীবন সম্পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েরাই চালায় সমাজ সংসার, নিজেদের পদবি রেখে। দারুণ ব্যপার একটা।

আরফা গুহার রহস্যটা ভেদ করতে গিয়ে এরকম অনেক কিছু জানতে পেরেছিলাম, যেটা কোলকাতায় বসে জানা প্রায় অসম্ভব ছিল আমার পক্ষে।
যাইহোক, কোলকাতা ফিরব বলে ঠিক করলাম, সহরা লজের বাহাদুরের কথায় আমাকে থেকে যেতেই হোল মেঘের রাজ্যে

আর সঙ্গে ড্রাইভার ভাই শৌভিক তো থাকবেই বলে দিয়েছে আমাকে আগে থেকে

অফিসে যাবতীয় তথ্য ইমেল করে সমস্ত ব্যাপার টা বুঝিয়ে বললাম। কোম্পানি খরচের ব্যপারটা দেখে নেবে। সংবাদ মাধ্যমে কাজ করার এই এক লাভ, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াও, আর দিনের শেষে তাদের হট কেক এর মত নিউজ টা দিয়ে দাও।

সকাল ৮টা বাজে
সূর্য উঠেছে, সঙ্গে ঠাণ্ডা দাপটে হাওয়া।
বিশেষ করে ভাল লেগেছে এখানের নিস্তব্ধতা। কানের কাছে এক প্রকার সাইলেন্স, শরীরে ঠিক টনিক এর মত কাজ দেয়।
 
পকেট এর ফোনটা বেজে উঠলো, দেখলাম শৌভিকের নাম্বার।
মুখে একটা আলুর পরটা গুজে রিসিভ করলাম, “ বলো শৌভিক, গাড়ি নিয়ে কখন আসছ ?”


মিনিট চল্লিশের মাথায় সামনে এসে দাড়ালো লাল অলটো গাড়িটা


বেড়িয়ে পড়লাম দুই জনে, আর একটা নতুন সফরে।
ভ্রমণে ড্রাইফল আমি সবসময় সঙ্গে রাখি।
কাজুবাদাম এর প্যাকেটটা কেটে শৌভিক কে কয়েকটা হাত বাড়িয়ে দিলাম।
বাইরে হাওয়াটা বেশ ভালই বইছে, কাঁচটা তুলতে হোল।

শৌভিক এর উদ্দেশ্যে, “ আমরা ওখানে কোথায় উঠছি তাহলে ?”
“ আমি বাহাদুর এর সাথে কথা বলে রেখেছি, ওর শ্বশুর বাড়ি ওখানেই। ওদের বাড়ীতেই আমাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে


“ ওদের অসুবিধে হবে না তো ? আমাদের দুজনের জন্য ?”
“ না হবে না, ওদের বাড়ির পাশে আর একটা কাঠের বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে, সেটাতেই ব্যবস্থা করেছে। আর আমিতো  গাড়িতেই থাকবো। “

“ বেশ, তাই হোক।
আসল কথায় আসি। গ্রামে আসলেই কি সমস্যা হয়েছে, একটু খুলে বোলোতো ? ”
 
মাওলিলং গ্রামের আদিভৌতিক ঘটনাটি শৌভিক নিজের ভাষায় যতটা সম্ভব গল্পের আকারে বলতে শুরু করলো


“ একসময়ে এই মাওলিলং গ্রামটি এশিয়ার সবথেকে পরিষ্কার গ্রাম বলে ধরা হতো, গিনিস বুকে সে জন্য নিজের নাম লেখাতে পেরেছিল

এই বিখ্যাত গ্রামের একটি ভয়ঙ্কর ইতিহাস আজও সব্বাইকে ভয় পেতে বাধ্য করে।

আজ থেকে ২০০ বছর আগেকার কথা।
কোনও এক রাত থেকে গ্রামবাসীরা হঠাৎ করে ভ্যানিস হতে থাকল।
কোনও দিনক্ষণ তিথি না মেনেই শুরু হয় এই মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেই সব মানুষগুলো অদৃশ্য হয়, যারা গ্রামের পাহাড়ি এলাকার পশ্চিম প্রান্ত থেকে যাতায়াত করতো। দল বেঁধে মানুষ যেত ঠিক ই, কিন্তু প্রায় প্রতিবারই একজন আর ফিরত না।
গ্রামের সেই সীমানা বরাবর একটি গুহা আছে। গুহার মধ্যে থেকে অদ্ভুত সব শব্দ আসত। দল বেঁধে মানুষ গুলো যখন ঐ গুহার মধ্যে যেত, একটা আজব অনুভুতি হতো সব্বার। কেও ঢুকলেই গুহার মধ্যে যেন কোথায় একটা শোরগোল পড়ে গেছে, আর একটু হলেই যেন কথা বলবে ভেতরের পাথর গুলো। কোনও ভাবে যদি কোনও একজন পেছনে পড়ে যেত হাটতে হাটতে, আর বেরত না গুহা থেকে।

এবার আসি আসল কথায়।
শোনা যায় গুহার ভেতরে থাকে উথলিন থাকে


চমকে উঠলাম, “উথলিন ? সেটা আবার কে ? “

“ সেটা আবার কে না জিজ্ঞেস করে, বলা উচিত সেটা আবার কি ? উথলিন একটি বড় পাইথন।“, শৌভিক বলল।
“ তুমি কি সেই অজগর সাপের কথা বলতে চাইছ ?”, জিজ্ঞেস করলাম


“ হ্যাঁ, একদম তাই। লম্বায় ছিল ২৫ ফুটের সমান, আর চওড়া তে আমরা যে গাড়িতে বসে আছি, তার থেকে আরও একটু বড়। “

প্রথমে কল্পনা করতে একটু বেগ পেতে হয়েছিল আমাকে, এসব কি বলছে শৌভিক। সিনেমাতে সেই অ্যানাকোনডা আমি দেখেছি, কিন্তু সেগুলো তো বানানো। কিন্তু এখানে যে গল্প শুনছি, সেটা ভেবেই যেন গ্রামটার প্রতি অজানা আকর্ষণ পেয়ে বসেছে।

“ তারমানে তুমি বলতে চাও, উথলিন এর জন্য মানুষরা ভ্যানিশ হয়ে গেছে সব ? “
“ দাদা, কথিত কথা বলছি আমি। জানিনা এর পেছনে কতটা সত্য আছে। “



মেঘালয় এর আবহাওয়া বড়ই অদ্ভুত প্রকৃতির। এই রোদ্দুর, আবার এই বৃষ্টি। গাড়ির কাঁচ নামানো আছে, তাই ফুরফুরে হাওয়া দারুণ উপভোগ করছি।

সকাল ১০টা বেজে গেছে যখন আমরা মনলিং গ্রামের কাছাকাছি

গ্রামে ঢোকার মুহূর্তে দেখলাম কিছু মানুষ হাতে কোদাল, বর্শা দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করছে। এরা মূলত খাসি জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত।


গ্রামের সীমানা যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানে একটি বড় জায়গা আছে, টুরিস্ট বা অফিসার কেও এলে, ঐ জায়গাতেই গাড়ি পার্ক করে দেয়, বাকি রাস্তা পা এ হেঁটে।

দুইজনে নামলাম যখন, শান্তির নিঃশ্বাস নিছি।
পিঠের রুক্সাকটা নিয়ে এগিয়ে চললাম, কাঠের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

একটু হাটতেই চোখে পড়ল দূরে সেই লোকটার দিকে, যে আগে আগে এগিয়ে আসছে, আর তার পেছনে আসছে বেশ কিছু গ্রামবাসি। ব্যাপার কি ?
লোকটা তো আর কেও না, বাহাদুর ভাই।
পাশে পাশে যিনি আসছেন মনে হয় ভাবি হবেন।

খাসি রা হিন্দি যখন বলে, খুব তাড়াহুড়ো করে। আমি যতটা সম্ভব বুঝে বাংলাতেই বলছি।


“ দাদা, আপনি এসেছেন, আমি সব্বাইকে বলেছি আপনার কথা। আপনি আমাদের রক্ষা করুন।“ এই কথা বলে বাহাদুর করজোড়ে আমার দিকে প্রণাম জানাল, আর তার দেখা দেখি সকল গ্রামবাসীরা মাথা নিচু করে মৌনভাবে তার সম্মতি জানাল।
এরকম একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমি প্রথম পড়লাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বাহাদুরের কাঁধ ধরে ওকে তুলে নিলাম। আমি তো সামান্য একজন রিপোর্টার, আমি কি আর পারবো এদের মুখের হাসি ফিরিয়ে দিতে...

কাঠের যে ঘরটা দেখলাম, সেটা অপূর্ব বললেও কম বলা হয়। আজ পর্যন্ত কাঠের বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয়নি যদিও, কিন্তু এটা যেন অসাধারণ।
কাঠের পাটা দিয়ে মেঝে বানানো। দরজা খুললেই একটা দারুণ ক্যাঁচ শব্দ বেশ লাগছে। মাথার কাছে ছোট্ট ফ্যান ঝোলানো, মনে তো হয়না চালাতে হবে এই আবহাওয়ায়। নীল রঙের মশারি, বিছানাটা একটা কালারফুল চাদরে মোড়া।
শৌভিক গাড়িতেই থাকবে ঠিক করলো।

একটু ফ্রেশ হয়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম, বাহাদুর আর তার রান্না ঘরে। আসতে আসতে গিয়ে সেখানে বসলাম আমি একটা কাঠের চেয়ারে।
আমাকে দেখেই বাহাদুর তড়িঘড়ি করে কাছে এসে বলল, “ সাহাব, কি টিফিন করবো আপনার জন্য ? ”
“ রাস্তায় অনেক কিছু খেয়েছি, আর কিছু এখন না। একদম লাঞ্চ এ বসবো। এখন বলতও , কি ব্যাপার এখানে ? একটু খুলে বোলো ব্যাপারটা ।”

“ সাহাব, আজ থেকে দিন সাতেক আগে আবার একটা ছেলে গায়েব হয়ে গেছে।“

“ কি করে হয়েছে ?”

“ সাবজি, গ্রামের ঢোকার দুটো রাস্তা আছে। একটা যেটায় আপনি ঢুকলেন, আর একটা যেটা শর্টকাট ভাবে ঢোকা যায়। সেই রাস্তাটা খুব খারাপ। যেই সেখানে যায়, কেও না কেও আর ফিরে আসে না। “, বলতে বলতে একটু ফুঁপিয়ে উঠলো।
আবারও শুরু করলো, “ গ্রামের সব্বাইকে ঐ রাস্তা থেকে যেতে মানা করা হয়। তবুও ঐ রাস্তাটা ঐ ছেলে তিনটে গিয়েছিল।“
“ কেন ? কি আছে ঐ রাস্তায় ?”, একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“ ঐ রাস্তায় একটা গুহা আছে। সব্বাই বলে ওখানে উথলিন আছে।“

কিছুক্ষণ আগের শোনা গল্প গুলো মনে পড়ে গেলো।
“ সেটা তো ২০০ বছর আগের কথা বাহাদুর, সেই সাপ কি আজও বেঁচে আছে ? সে তো কোন কালেই মারা গেছে। “

“ না সাহাব, সেই সাব যেমন তেমন সাপ নয়। সে একটা অভিশাপ, যা যুগের পর যুগ বহন করে চলেছি আমরা গ্রামবাসীরা। “

মনে মনে প্রশ্ন দানা বাধতে শুরু করলো। আসলেই কি ঘটছে সেটা জানাটা খুব দরকার। সত্যি যদি সাপ হয়ে থাকে, তাহলে আমার কোনও সাধ্য নেই সেটা কে মারার। কিন্তু এতদিনের মিথ আজ কি সত্যি হয়ে ফিরেছে ?


 



তৃতীয় পর্ব -


খাসিরা কিন্তু জানে, কীভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়। মন থেকে ওরা সমস্ত ভাবেই চেষ্টা করে যাতে তাদের অতিথির কোনও রকম গাফিলতি না হয়।
মুখে সর্বদা একটা হাসি দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই মন ভরিয়ে দেয়।


প্লেট এর একদিকে একবাটি ভাত, আর সঙ্গে মাংস। লাঞ্চে এমন একটা খাবার পাবো ভাবিনি, দেখেই মনটা ভরে গেলো। এর একটা বিশেষ কারণও আছে।
ভাতের রঙটা ছিল সবুজ, অর্থাৎ এটা জাডো। শূয়রের মাংস ও রক্ত দিয়ে বানানো এই ভাত, খাসিদের প্রিয় খাদ্যের মধ্যে একটা। অত্যন্ত সুস্বাদু হয় এই খাবার, কানে শুনেছিলাম এতদিন। আজ সেটা চাখার সৌভাগ্য হোল।
খাওয়া শেষ করে একটা করে কাঁচা সুপুরি হাতে পেলাম।

বাঙ্গালির দুপুরের খাওয়ার পর ভাতঘুম জুতে যায়, এখানে কিন্তু সেটা হয় না। আমার অন্তত হয়নি।
বেলা গড়িয়ে সূর্য নিভু নিভু। নাহ, আপাতত একটু বিশ্রাম নেওয়াই ভাল। এই মুহূর্তে কোথাও যাওয়া তো যাবে না।

শৌভিকের পা নাচছে, মাথা পেছনের সীটে। আমায় দেখে উঠে পড়ল, “ দাদা, কেমন লাগছে এখানে ? “
হাসিমুখটা আরও হেসে বললাম, “ ভাল, এখানে থেকে যেতে মন চাইছে, বুঝলে শৌভিক। “

পেছন থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল। দুজন এগিয়ে আসছে, একজন বাহাদুর ভাই, আর একজন কে চিনি না। লম্বায় আমার থেকে খাটো, নেপালি মার্কা টানা গোঁফ, চোখ দুটোও টানা। পরিচয় করে জানতে পারলাম, ইনি বাহাদুর ভাই এর শ্যালক, নাম ডিঙ্গো।

‘ নমস্তে ‘ , সামনে এসে করজোড়ে প্রণাম করল ডিঙ্গো। এই সেদিন যে ছেলেটি মারা গেছে, সে ডিঙ্গোর ছেলে ছিল। এতো কষ্ট সত্ত্বেও উনি মুখে কি করে হাসি রেখেছেন, তা জানি না। ভেবে আমার নিজেরই একটু খারাপ লাগছে।
বাকি কথোপকথনটা আমি বাংলাতেই বলছি।

“ সাবজী , আমাদের বাঁচান। এভাবে সব্বাই মারা গেলে আমরা কাকে নিয়ে থাকবো ? এইতো সেদিন আমার ছেলেটাও গেলো উথলিনের পেটে। আমি চাই আর অন্য কোনও বাবা আমার মত কষ্ট না পায় ”

কি বলবো কথা প্রতুত্যরে,তা বলতে পারলাম না।
“ আপনার ছেলের সাথে আরও দুজন ছিল শুনছিলাম। ওরা কি দেখেছিল ওখানে ? ”
“ হ্যাঁ, ছিল দুজন। ডাকব ওদের ? ঐ তো ওখানে আছে। “

সম্মতি পেয়ে ওদের দুজন কে ডাকতেই চলে এলো দৌড়ে।
“ তোমরা যখন হাঁটছিলে, ঐ বন্ধুটি কোথায় ছিল ? “
ওদের মধ্যে একজন বলল,” পেছনে ছিল। আমরা এগিয়ে চলে আসছিলাম। “
“ তারপর ? “
“ খুব জোরে চিৎকারের সদ্য পাওয়া মাত্রই আমরা আবার গুহাতে ছুট লাগালাম। “
“ গিয়ে কি দেখতে পেলে ? বন্ধুটি ছিল ?”
“ না, ছিল না। ততক্ষণে বন্ধুর চিৎকার শেষ হয়ে গেছে। ওকে আর দেখতে পায়নি। তারপরই একটা জিনিস পড়ল সামনে ?”
“ কি সেটা ? “

পরের কথাটা বলার আগেই ছেলেটি কিছুটা ভয়াল চোখে আমার দিকে বাক্রুধ্য হয়ে তাকিয়ে রইলো।
ডিঙ্গো বলল , “ ওদের সামনে একটা আস্ত নরকঙ্কাল পড়েছিল। রক্ত মাখা, সদ্য যেন চামড়া গুটিয়ে নিয়েছে কেও।“

এই ভয়ঙ্কর কথাটার জন্য আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললাম, “ তোমরা কোন কিছু শব্দও শুনতে পেয়েছিলে ?”
“ হুম, পেয়েছিলাম। মনে হোল মাথার ওপরে অনেক অনেক কিছু একসাথে চি চি করে শব্দও করে চলেছে।“
 
আর কথা বাড়ালাম না


সন্ধ্যে নামার সাথে সাথেই চারিদিকটা বড্ড শুনশান হয়ে গেছে। ঠিক যেন মনে হছে এখানে আমি ছাড়া আর কেও নেই। এতটা নিস্তব্ধতা এর আগে কখনই অনুভব হয়নি, কোলকাতার বাইরে তো নয়ই।
ভাল হয়েছে, একটু ভাব্বার সময় পাওয়া গেলো

ইন্টারনেট সার্ফিং করলাম, কিছু অদ্ভুত তথ্য চোখে পড়ল।

২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি রক পাইথন যাকে স্থানীয় ভাষায় পাহাড়ি অজগর বলা হয়, একটা ১০ বছরের বাছাকে গিলে খেয়েছিল।
তার কিছু বছর পরের ঘটনা। সুলায়েসিতে একটি ২৫ বছরের কৃষক ভাই কে জমিতে ফেলে সম্পূর্ণ ভাবে গিলে নিয়েছিল একটি ১২ ফুটের পাইথন।

যে খবরটা বেশ চাঞ্চল্যকর, সেটা হোল কিছু বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা তে একই ধরণের হামলা হয়েছিল পাম বাগানে, সেক্ষেত্রে সাপটি ছিল ২৪ ফুট লম্বা। আশ্চর্য ব্যাপার হোল, কৃষকভাই টি যুদ্ধ করে সেই সাপের সাথে, আর সর্বশেষে সে জীবিত, অর্থাৎ প্রানে বেঁচে যায়।
প্রতিটা ঘটনার সাথে একটা ব্যপারে বড্ড খটকা লাগছে আমার, কিন্তু কি সেই খটকা, বুঝতে পারছি না। এমন কিছু এর মধ্যে রয়েছে, যেটা আমার নজরে আসছে না। কাল গুহাতে গেলেই সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

“ সাহাব, এটা আপনার জন্য, খান। আমাদের খুব প্রিয় খাদ্য। আমার বৌ বানিয়েছে আপনার জন্য “, বাহাদুর ভাই কখন পিছন থেকে এসে এক ধরণের পানীয় হাতে ধরিয়ে দিল

 এর নাম‘ কাকিয়াদ ’
চাল দ্বারা তৈরি হয়এতদিন নাম শুনেছিলাম, আজ খেয়েও নিলাম। একটু শুকনো কিন্তু অপূর্ব খেতে।


নিজে থেকেই বাহাদুর বলা শুরু করলো এবার।
“ এই যে গ্রাম টা দেখছেন সাহাব, আজ এতটা চুপচাপ ছিল না। এই সময়ে আমরা আনন্দ করতাম সারাদিন ধরে নাচা গানা চলতো। আপনাদের এই ইংরেজি মাস নভেম্বর বলেন, আমরা সেই সময়ে ফসল কাটার উৎসব করতাম প্রতি বছর। ৫ দিন ধরে চলতো এই উৎসব, আমাদের ভাষায়  “নংক্রেম” বলা হয়। এখন আর হয় না। কোনও কালো ছায়া আমাদের গ্রামে এসেছে, সে আর এসব হতে দেয় না।“

কতটা কষ্ট হলে এদের মত মানুষরা অসহায় বোধ করে, তা আমার ধারনার বাইরে। কিন্তু মনে মনে স্থির করলাম, যেভাবে হোক এই গ্রাম বাসিদের আমি যেভাবে পারি সাহায্য করবো, যতক্ষণ প্রাণ আছে দেহে। কালকের দিনটা আমার জন্য হয়তো খুব জরুরী দিন, শুধু আমার না গ্রামের সব্বার ...






চতুর্থ পর্ব
-


ঘুম ভাঙল খুব সকালেই। কাঠের বাড়িতে এই প্রথম রাত কাটালাম। একটা অদ্ভুত অনুভুতি লাগলো, সেটা কীভাবে প্রকাশ করবো ভাবছি।
চোখ যেদিকে যায় ঘরের মধ্যে, ঠিক কোথাও যেন আঁটকে পড়ছে চৌকো কাঠের দেওয়ালে। খুব পরিষ্কার পরিছন্ন ঘর বিছানা সমস্তটাই।
দরজা খুলে বেরলাম।
শৌভিক অনেক আগেই উঠে পড়ে, আমায় দেখে, “ গুড মর্নিং, তৈরি হয়ে যান দাদা। আজ আমি আপনার পিছু ছাড়ব না, আগের বারের মত।“
একটা হালকা হাসি দিয়ে সম্মতি জানিয়ে রেডি হওয়ার জন্য ভেতরে ঢুকলাম।     

বাহাদুর আর ডিঙ্গো আমাদের সঙ্গী হোল এই অভিযানে। গাড়িতে ওঠার সময় সমস্ত গ্রামবাসী আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছিল। প্রতিটা চোখে খুঁজে পেয়েছিলাম, এক প্রকারের আশার আলো যেটা আমার জন্য জ্বলে উঠেছে।




ঢালু রাস্তা বরাবর ঘুর পথে প্রায় মিনিট তিরিশেক লাগলো সেই রুট ব্রিজের কাছে যেতে। গাড়ি একটু সাইডে পার্ক করলো শৌভিক। লোকালয় বা জন্য প্রাণী বলতে এই মুহূর্তে আমরা চারজন।
 
রাস্তার ঠিক পাশ থেকে একটি জলপথ বয়ে চলেছে। চোখ যতটা গেল, দেখলাম জলপথটা যেখানে বাঁক নিয়ে ঘুরেছে ডান দিকে, গুহা এর মুখটা ঠিক সেখান থেকেই শুরু।
রাস্তার অবস্থা দেখলে বোঝা যায় যে এখানে মানুষ জনের পা তেমন ভাবে পড়েনি। অর্ধবৃত্তাকার গুহা মুখের ওপরের অংশে বাইরে থেকে অনেক বড় বড় ঘাস পাতার মত কিছু, ঝুঁকে পড়ে পথ আগলে রেখেছে কিছুটা

কোলকাতায় কিছু পার্কে কৃত্রিম ভাবে অনেক গুহা, মনোরঞ্জনের জন্য বানানো হয়েছে। কিন্তু হ্যাঁয় রে হ্যাঁয়, আসল গুহা যদি কেও দেখত তাহলে বুঝতে পারতো মনোরঞ্জন কতটা ভয়ঙ্কর ভাবে পরিচিত হতে পারে, আর তার সাথে অভিশপ্ত দাগটা যদি বহন করতে হয়।

চার জনের হাতে চারসেলের বড় বড় টর্চ
ভেতরে ঢোকার আগে চারজনে বাইরে দাড়িয়ে কিছুটা পরিকল্পনা করে নিলাম।


“ আমরা মোট ১টা ঘণ্টা এই গুহার মধ্যে থাকবো।
তার মধ্যে কেও কোনভাবেই টর্চের আলো নেভাবে না।
দুজন করে দুটো দলে থাকবো, কেও কাউকে ছেড়ে একা এক পাও নড়বে না। কখনও দরকার পড়লে চিৎকার করে একে ওপরের নাম ধরে ডাকবে, কিন্তু একমাত্র দরকার পড়লে তখনই।
গুহার নিস্তব্ধতা কোনও প্রকারেই যেন ভঙ্গ না হয়। “    


হয়তো কুড়ি কি ত্রিশ সেকেন্ড হোল, আমরা গুহাতে ঢুকেছি।
এরই মধ্যে মনে হোল, বাইরের সাথে এই জগতের জান পেহেচান বড্ড কম আছে। ভেতরের আবহাওয়া সম্পূর্ণ ভাবে বাইরের থেকে আলাদা, ঠিক অন্য জগতের প্রবেশদ্বার। নিস্তব্ধতা যেন কথা বলেছে আমাদের সাথে, বুঝিয়ে দিতে যে আমরা এখানে একা নই। আরফা গুহাতে তাও একধরনের জলের কলধ্বনি পেয়েছিলাম, কিন্তু এটা অনেকটাই আলাদা। প্রতিটা গুহাই নিজের নিজের কাহিনীর রচয়িতা। 

ডিঙ্গো আর শৌভিক পেছনে, আমি বাহাদুরকে নিয়ে আগে রইলাম।
গুহার ছাদে টর্চ মারতে বোঝা গেল, অপরটা বেশ একধরনের সমান্তরাল, ঠিক হাতে যেমন ঢালাই করে, কিছুটা সেরকম।
গুহার দেওয়ালে শিলাগুলোর প্রান্ত গুলো ফোঁটার আকারে সুচালো হয়ে শেষ হয়েছে, বর্ষাকালে সম্ভবত জল চুইয়ে গড়িয়ে পড়ে


ভেতরের বাতাস প্রচণ্ড স্যাঁতস্যাঁতে, ঠাণ্ডা। অক্সিজেন এখানে সম্ভবত পুরোমাত্রায় রয়েছে, কারন শ্বাস প্রশ্বাসে এতটুকুও কষ্ট নেই। ঠাণ্ডা লাগছে, তাই কেমন যেন এক ধরণের ঝিমঝিম ভাব।
সামনে এগিয়ে চলেছি দুই জনে, যতই টর্চ মারি না কেন, অন্ধকার ভেদ করে সেটা সামনের অন্ধকারেই ডুবে গেছে। পরিষ্কার করে সামনের দৃশ্য তেমন ভাবে চোখে না পড়ার মত।

প্রবেশ পথ থেকে এই পর্যন্ত আলো ঠিকরে ঢুকছে কোনরকমে। এর পরের পথ ঝুলকালো। বাহাদুর ঠিক এখানেই আমাকে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো, সে এখানেই থাকতে চায়, আর এগোতে পারবে না।
শৌভিক কে পেছনে তাকিয়ে ইশারা করে সামনে নিয়ে নিলাম, ডিঙ্গো ও সঙ্গে বাহাদুর ঐ স্থানেই দাড়িয়ে রইলো ও বলল, “ সাহাব, কোনও রকম হেলপ লাগলে আমাদের বলবেন, আমরা ছুটে যাবো। “
 
টর্চের আলো সামনের কালো রঙ কে ভেদ করে রাস্তা দেখাতে শুরু করেছে

মাঝে মধ্যে ডানদিকে বা কখনও বামদিকে এবড়ো খেবড়ো শিলার চাই মুখ বাড়িয়ে বসে আছে ধাক্কা দেওয়ার জন্য।
সম্পূর্ণ রাস্তাটাই মালভূমির মত উঁচু নিচু, তাই সোজা ভাবে হাটতে পারছিনা।
 
কিছুটা রাস্তা এভাবেই চলেছি, নিকষ কালো রঙ ভেদ করে চোখ ধাধিয়ে গেল টর্চের আলো সামনে ফেলা মাত্র। চিক করে উঠলো সামনের অংশ বিশেষ,চকমকি কিছু একটা দেখলাম যেন।

দুজনেই থমকে দাড়িয়ে পড়লাম।
আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল একটি ছোট্ট হাতঘড়ি, কাঁচের অংশে আলো লাগামাত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।   
কোনও এক মানুষের ঘড়ি, প্রাপ্ত বয়স্ক। এখানের মানুষ তো ঘড়ি পড়েই না, তাহলে এ হয়তো কোনও টুরিস্ট, আমারই মত। ওপর থেকে নিচে পড়েছে, তাই ডায়ালের কাঁচটা ভেঙ্গে গেছে। ওপরে কি কোনও স্থান আছে ? নাহ, চোখে পড়ছে না।

ঠিক এই মুহূর্ততেই মনে হোল, কিছু একটা আমাদের দেখছে। ঠিক দেখছে না, পর্যবেক্ষণ করছে। গুহার ছাঁদের ওপর থেকে কিনা বুঝতে পারছি না। সিক্সথ সেন্স বলে কিছু একটা বস্তু হয়, এটাও কিছুটা সেরকমই, একধরনের অস্বস্তি মনে মনে উদিত হয়।

শৌভিক কে টর্চের আলো ফেলে বুঝিয়ে দিলাম, তুমি এই স্থানের ডান দিকের অংশ গুলো একটু ভাল করে দেখো, যদি কিছু চোখে পড়ে আমাকে সাথসাথ জানাও।

গুহার বাম অংশটা খুঁজতে গিয়ে আর একটু দূরে কিছু ব্যাগ ছোট বড়, ছেঁড়া কাপড় চোখে পড়ল, শুকনো কালচে রক্তের দাগ রয়েছে।
এগুলো যে মানুষের, সেটা বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি। তবে আমি যে জিনিসটা আসলেই খুঁজছি, তা হোল সাপের খোলস। কোথায় সেটা ?

বাহাদুর দের কথা অনুযায়ী, কোনও সাপ যদি থেকেই থাকে, তাহলে তার খোলস একটা হলেও তো থাকবে। তিন চার মাসে কমবেশি সব সাপই এটা করে,কিন্তু এখানে তার কোনও চিহ্নই নেই।

 শৌভিক ফিসফিস করে ডাকল আমায়,“ দাদা এদিকটা একবার আসুন “

ডানদিকে দেখলাম ছোট্ট মত একটা জায়গা, পাথুরে এবড়ো খেবড়ো।
কি সাদা সাদা ওগুলো ?


ওগুলো নরকঙ্কাল।

কোথাও আছে মানুষের খুলি উল্টে পড়ে, কোথাও আছে পাঁজর হাড্ডি এক ভাবে পড়ে, উদ্বৃত্ত খাবারের মত
রক্তরস শুষে ছিবড়ে টা ঐভাবে ফেলে রেখেছে কেও।
দৃশ্যটা বেশ ভয়ঙ্কর

কিন্তু ধন্দে পড়েছি আমি। কিছুই মেলাতে পারছিনা আসল ব্যাপারটাই কি। ভেবে এসেছিলাম এক, কিন্তু এখানে দেখছি সবটাই গোলমেলে।

শৌভিক যে একটু ভয় পেয়েছে, তা ওর মুখ চোখেই স্পষ্টও। কিন্তু একা কাওকে এই গুহায় ছাড়া যাবে না।এগিয়ে চললাম ওকে সঙ্গে নিয়েই


ফুট খানেক এগোনো মাত্রই দেখলাম রাস্তা সোজা থাকলেও, সামনে থেকে কিছুটা অংশ ওপরে উঠে গেছে, হুম ওখানে চাইলে যাওয়া যেতেই পারে পায়ে হেঁটে। সম্ভবত ওটাই ওপরের ছোট্ট সুরঙ্গ পথ।

ঐ স্থানটাতে আমিই যাবো একা, শৌভিক থাকবে ঠিক পেছনে, কিন্তু নিচে। কেন যেন মনে হছে, এই খানেই খুঁজে পাবো যেটার জন্য এসেছি।

কেমন যেন একটা অদ্ভুত রকমের গন্ধও, উঠতে গিয়েই নাকে এলো। মন থেকে কিছু একটা পিছু ডাক নিল, আগামী বিপদের সঙ্কেত বেজে উঠেছে মনের মধ্যে। সেটা যে ঠিক কি ,আপাতত সেই মুহূর্তে ঠাহর করতে পারিনি। এমনটা এর আগে অনুভূত হয়নি কখনও।

মাথার কাছে এবড়ো খেবড়ো পাথর, একটু বেতাল হলেই মাথাফুরে ব্রম্ভতালু ভেদ করে যাবে।
উবু হয়ে একটু এগোতেই মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেলো
নিঃশ্বাস যতই নিছি, ততই যেন মাথাটা ভার হয়ে আসছে। কেমন একটা ঘোরে আছন্ন লাগছে।  
টর্চের আলো চারিদিকে চকমকি আভাষ দিছে ঠিক নিচের মত।
একটু ভাল করে দেখলে বোঝা গেল, কোনটা একটা ধাতুর আংটি, কোনটা একটা চকমকি পাথর পড়ে রয়েছে। কোনটা আবার গলার চেন, কোনটা পয়সার কয়েন। মানুষের ব্যবহারের এতগুলো জিনিস এখানে কি করছে ?




ঠিক তার মুহূর্তে যেটা ঘটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না, সেটাই তার ভূমিকা শুরু করে দিলো।
একধরনের ম ম ম শব্দও হছে ঠিক কাছে পিঠেই, কিন্তু বুঝতে পারছি না
কোথায় সেই শব্দের সূত্র।
সবটা খুব কাছেই, কিন্তু সামনে তো কিছু পাছি না।
টর্চের আলোটা আর একটু সামনে ফেলতেই শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সাক্ষাৎ যমের দেখা পেলাম মনে হোল।


প্রচণ্ড কালো রঙের কুচকুচে একটা গোল চাকা, ব্যাসার্ধ প্রায় দুই ফুট। যেমন ভাবে পাক খেয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকার কথা, ঠিক সেরকম ভাবেই রয়েছে। মুখ কোথায় সেটা বুঝতে পারছি না। টর্চটা যেমন ভাবে ফেলে রেখেছি, সেরকম ভাবেই রয়েছে, আর সরাতে সাহস পাইনি।

আশ্চর্যের বিষয় হোল, গায়ে কোনও প্রকার আঁশ নেই। পরিবর্তে ছোট্ট ছোট্ট কিসব গুটলি মেরে বসে আছে, দেখতে ঠিক স্বাভাবিক লাগলো না।
আর একটা আশ্চর্যের বিষয় চোখের সামনে ঘটতে শুরু করলো।
ঐ কালো কুণ্ডলী, স্থান পরিবর্তন করছে। কুণ্ডলী কোনভাবেই নষ্ট না হয়ে গোল অবস্থায় আমার দিকে এগিয়ে আসছে ।
এটা কি করে সম্ভব ? সাপ তো এভাবে কখনই স্থান পরিবর্তন করতে পারে না।
তাহলে ?

এবার আমাকে লক্ষ্য করে আসছে, তা বুঝলাম ওর এগোনোর দিক দেখে

বড্ড অদ্ভুত বয় লাগছে আমার। যাকে সাপ ভেবে ভয় পেলাম সেটা আসলে কি ?
অজানা শত্রু আরও বেশী খতরনাক হয়।


ফেরার রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশ অনেকটাই।
ঠিক পরমুহূর্তে সামনে ফিরতেই দেখলাম কালো কুণ্ডলী আর নেই প্রায়।
বরং তার পরিবর্তে, সেটা ভেঙ্গে  তৈরি হয়েছে ছোট ছোট চলন্ত টুকরো
এতো ভেলকিবাজি ব্যপার।
কয়েকটা কালো কুণ্ডলী উড়ছে, কোনটা ভূমির সমান্তরালে এগিয়ে আসছে। এটা কি জিনিস আসলে ? এত কিছু ভাব্বার সময় নেই।

একি সর্বনাশ।
টুকরো গুলো মুহূর্তের মধ্যেই আমার পায়ের কাছে এসে গেছে।
কিছু না ভেবেই ছুট লাগালাম পিছনের দিকে।

সামনে সমান রাস্তা হলে কত তাড়াতরই নিচে চলে যেতে পারতাম। সেটা তো হবার নয়।

চলন্ত অবস্থায় একবার পিছনে টর্চ মারতেই দেখলাম, ছোট্ট কালো টুকরো গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে, আর আমার দিকে তাক করে ছুটছে।

সুরঙ্গের মুখের কাছে আসতেই, তাল হারিয়ে ধাক্কা খেয়ে একটা আছাড় লাগলো। টর্চ গড়িয়ে সামনে পড়ে গেল, মাথায় চট পেলাম আবার।
পেছনে চি চি চি কান ফাটানো শব্দও, যেন খাবার ব্যাগে পেয়েছে।
ওরা এগিয়ে আসছে ক্ষিপ্র গতিতে, সেকেন্ডের মধ্যেই আমার কাছে পৌঁছে যাবে।


ঠিক তখন ওদিক থেকে একটা শব্দ হোল আমার কাছে আসার। শৌভিক কখন আমার কাছে এগিয়ে এসেছে ,বুঝতে পারিনি।
পেছন থেকে এগিয়ে এসে আমায় তুলে নিল মুহূর্তের মধ্যে।


সুরঙ্গ পেরিয়ে বেরয়ে এলাম দুজনেই।
নিচে পৌঁছে সিদে সেই রাস্তা ধরলাম, যেখান দিয়ে আমরা এসেছি।
এই মুহূর্তটা ভোলবার নয়। পেছনে আমাদের তারা করছে সদলবলে
,  আমাদের ভক্ষণ করার জন্য কান ফাটানো চি চি শব্দ।
খাবার মুখের সামনে পেয়েও না পাবার আর্তনাদ
হয়তো

মিনিট দুই এর মধ্যেই চোখে পড়ল ডিঙ্গো আর বাহাদুর দাড়িয়ে আছে। দূর থেকে আমাদের দৌড়াতে দেখে একটু হতভম্বের মত অবাক হয়েছিল।

ইশারায় ওদের দৌড়াতে বললাম প্রবেশদ্বারের দিকে।

চারজনে  যতক্ষণে ছিটকে এসে পড়লাম একদম গুহার বাইরে, আর ঠিক তখনই চি চি শব্দও গুহা দ্বারে এসে দাড়িয়ে গেল। সেই কালো কালো উড়ন্ত কুণ্ডলীর দল।
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এগুলো আসলেই কিসের অভিশাপ...






পঞ্চম ও অন্তিম পর্ব -

নিজে হাতে করে বাহাদুর চা নিয়ে এলো, সঙ্গে পুমলয়। এই খাবারটাও এখানের অধিবাসীদের নামকরা প্রচলিত খাবার। চালের গুড়ি দিয়ে তৈরি, অনেকটা ইডলি জাতীয়।
শৌভিকের জন্য আর এক প্লেট পেছনে পেছনে নিয়ে এসে ডিঙ্গো পাশে বসল

মুখ দেখে বুঝতে পারছি, এরা তিন জনেই জানতে খুব আগ্রহী, গুহার ভেতরের রহস্য। কিসের অভিশাপ ওদের পিছু আজও ছাড়েনি।

এই প্রথম কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল, কারন আমি নিজেও একটু বিভ্রান্ত।
যেটা মনে হোল, সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে তো, তাহলে... ভাবতে পারছি না উত্তেজনায়।
 চিন্তা এক লয়ে বেঁধে নিতে যতটা সময় লাগে, ততক্ষণ একটু চুপ করে বসেছিলাম, হাতে এক পিস পুমলয়।


তিনজনের উদ্দেশ্যে বললাম
, কি তৈরি তো কাহিনী শোনার জন্য ?

আজ আমরা ফিরে যাবো কোটি কোটি বছর আগে, যখন এই পৃথিবীতে রাজত্ব করত ডাইনোসোররা
প্রায় কয়েক কোটি বছর ধরে এরা রাজত্ব করার পর, আর টিকে থাকতে পারলো না পৃথিবীর বুকে
আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে, নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি এই প্রজাতির প্রাণীরা
তাই বিলুপ্তির পথে এদের ধ্বংস বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে

এই প্রতিকূলতা কে নিজের ঢালের মত কাজে লাগিয়েছিল সেই যুগের কিছু প্রাণী
বলতে পারো সেগুলো কি ?

শৌভিক চটজলদি উত্তর দিলো, “ আরশোলা
প্রসন্ন মুখে আমি জবাব দিলাম, একদম ঠিক
শুধু আরশোলা নয়, পিঁপড়ের মত প্রজাতিও অনেক পুরনো সময় থেকে এখানে রাজত্ব করছে বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যত পরিমাণ মানুষ আছে, তাদের সমান ওজনের পিঁপড়েও এই পৃথিবীতে বিরাজমান

তাই নাকি ?”, শৌভিক বলল

এতো তাড়াতাড়ি অবাক হল চলবে না, এই পৃথিবীর মায়া বড়ই জটিল
কাকে নিজের কোলে থাকতে দেবে, বা কাকে তাড়িয়ে দেবে, সবই তার খেলা

উথলিন এর কাহিনী মিথ্যে নয়, কিন্তু সেটা সেই সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। লোক মুখে সে আজও জীবিত, কিন্তু গুহাতে সে নেই আর।

“ কিন্তু তাহলে কি করে মানুষ মারা যাছে ? ওখানে উথলিনে যদি না থাকে ?”, ডিঙ্গো নিজের ভাষায় বলল উদগ্রীব হয়ে।


সেই কথায় আসছি, তার আগে বোলো তো, পিঁপড়ে কত ধরণের হয়  জানো কেও ?
মুখ দেখে ভাব বোঝার পর নিজেই বললাম


একধরনের পিঁপড়ে আছে, নাম বুলেট পিঁপড়ে
বোলতার থেকেও ভয়ানক, আর একবার কামড়ালে চব্বিশ ঘণ্টা ব্যাথা থাকে তাই একে আর এক ভাষায়চব্বিশ ঘণ্টা পিপড়াবলে ডাকা হয়  পারাগুয়ার রেইন ফরেস্ট এ এদের প্রচুর পাওয়া যায় দলবেঁধে শত্রু কে আক্রমণ করার আগে একধরনের বিষাক্ত গন্ধ ছিটিয়ে দেয়, তাতে কাজ হলে ভাল নয়তো আক্রমণ

হলিউডের ইন্দিয়ানা জোন্স সিনেমার লাস্ট পার্ট দেখেছ ? দ্যা কিংডম অফ ক্রিস্টাল স্কাল ?
ঐ সিনেমায় একটা দৃশ্যে ফায়ার পিঁপড়ে কে দেখা যায়
আস্ত একটা মানুষকে নিজের গহ্বরে নিয়ে দলবধ্য ভাবে সাবাড় করে দিতে মাত্র কিছু মুহূর্ত লাগে

“ তারমানে এখানে উথলিন নেই ? সবই পিঁপড়ে ?”, বাহাদুর নিজের ভাষায় বলল।

দাড়াও দাড়াও, এত তাড়াহুড়ো করলে হবে না
কাহিনী এখনও বাকি আছে তো
তার আগে আমার কিছু বলার আছে


যেদিন থেকে শুনলাম, গুহাতে মানুষ সাথে সাথেই ভ্যানিস হয়ে যায়, আর পড়ে থাকে নরকঙ্কাল, তখন থেকেই একটা ব্যপারে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, এটা আর যাইহোক সাপের কাজ নয়
কারন উথলিন জাতে অজগরের একটু বড় হলেও, এরা একটা গোটা হরিণ যদি মুখে ঢোকাতে শুরু করে, সেই কাজ চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যতক্ষণ না সম্পূর্ণ দেহ ঢুকে যায়, ওরা কোথাও নড়তে পারে না এক স্থানে বসে বসে সেই কাজ সম্পন্ন করে সেই মুহূর্তে খুব সহজেই সাপ শিকার করা সম্ভব কিন্তু এখানে সেই ব্যাপার নয়
তারমানে এই মুহূর্তের মধ্যে ভানিস করার ব্যাপারটা , সাপের ক্ষেত্রে অসম্ভব প্রায়


দ্বিতীয়ত, সাপের পেটের ভিতরে ঢোকানোর পর অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে একধরনের অ্যাসিড জাতীয় তরল বের হয়, যাতে দেহের হাড় সহজেই গলে যায়, আর পাচনে সুবিধে হয়
কিন্তু এখানে তো হাড়গুলো আস্ত দেখলাম

আর একটা ব্যপার লক্ষণীয়
সাপ যেখানেই থাকুক না কেন, আসে পাশে তার খোলস ছাড়বেই, বাধ্যতামূলক গুহায় ঢোকার আগে থেকেই আমি ওটার সন্ধানে চারিদিকে খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও পায়নি

শৌভিক বলল, “ সাপটা তো খোলস নাও ছাড়তে পারে, তাহলে ?”

উহু, অসম্ভব


একটা কথা ভাবো, আমরা যত বড় হই, চেহারাটাও বড় হতে থাকে
তখন কি ছোটবেলার জামা আমাদের ফিটিংসে হয় ?
সেরকমই, ওদের চামড়াটাও খোলসের মত কাজ করে
মাস খানেক অন্তর আয়তনে যখন বেড়ে যায়, পুরনো চামড়া ছাড়তে হয় শক্ত পাথরে নিজের শরীরটা ঘসে ঘসে খোলস ত্যাগ করতে শুরু করে


দারুণ ইন্টারেস্টিং বাপার
কিন্তু তাহলে ওখানে আছে টা কি ?”

তিন জোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে নিলাম ভাল করে


কিছু প্রাণী আছে, যারা মেরুদণ্ডী প্রাণীদের রক্ত চুষে বেঁচে থাকে
মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, এই প্রাণীগুলো ঠোঁট চুষে রক্ত খায় এদের নাম কিসিং বাগ
প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মানুষ প্রতি বছরে এই পোকার জন্য মারা যায়

মানুষের চোখ আর মুখের অংশ হয় এদের প্রথম টার্গেট


গুহার ভেতরে যেটা আছে, সেটা কোনও এক অজানা কিছু, যার মধ্যে কিসিং বাগ আর বুলেট পিঁপড়ে, এই দুটির বৈশিষ্ট্য মিশিয়ে রয়েছে।
নতুন প্রজাতির কোনও এক প্রাণী, যুগের বিবর্তনে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে ঐ গুহার ভেতরে, এখনও সেটা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই আছে।

সাধারণ কিসিং বাগ এর থেকে এদের আকারটা বেশ বড়, আর কুচকুচে কালো। এদের কিছু শ্রেণী উড়তে পারে, কিছু গুলো ভাল দৌড়াতে পারে।
অদ্ভুত অজানা এই প্রাণী বিরল প্রজাতির মধ্যে পরে।


ঐ পোকা গুলো যেখানে থাকে, কোনও ভাবে ফেরোমন জাতীয় কিছু ওখানে ছড়িয়ে রাখে। শিকার কোনভাবে যদি সেখানে আসে, ওরা সজাগ হয়ে যায়
শিকার আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়, তখন খাওয়ার কাজটা সাড়তে ওদের সুবিধে হয়।
শৌভিক, আমি তোমাকে নিচে রেখে যখন ওপরে গেলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু গন্ধ নাকে এসেছিল। মাথাটা একটু ঝিমঝিম করে উঠেছিল, ঠিক ঘুমের ঘোর পাওয়ার মত।


শেষ ছেলেটি সম্ভবত জোরে জোরে চিৎকার করছিল। ওদের শান্তি বিঘ্ন হয়েছে, আর ঠিক তখন ঐ পোকার ঝাঁক ওখানেই নিজেদের খাদ্য পূরণ করে ফেলেছে। বাকিটা তো সব্বার জানা।


“ তাহলে এখন উপায় ?”


হুম, বলছি।
প্রথমত, একটা কথা আপনারা মাথায় রাখবেন যে , আপনারা কোনও রকম অভিশপ্ত জীবন আপনারা কাটাছেন না। উথলিন নেই আর।
ঐ গুহাতে নতুন প্রজাতির অজানা প্রাণী থাকে, ওটা ওদের আস্তানা।
আপনারা যদি ওদের এলাকায় না বলে ঢুকে পরেন, ওরা কি ছেড়ে কথা বলবে ?

তবে একটা কথা বলছি, ঐ গুহাতে আপাতত কারোর আর যাওয়ার দরকার নেই। ওরা ক্ষুধার্তও, যখন তখন গুহা ছেড়ে মানুষের খোঁজে বেড়িয়ে এলে পুরো গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে।

কোলকাতায় আমি অ্যানথ্রপলজি ডিপার্টমেন্ট এর সাথে কথা বলবো, একটা বিশেষ টিম পাঠানোর জন্য। দরকার পড়লে ঐ গুহা ওরা সংরক্ষণ করতেও পারে, নতুন প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান ঠিক করে প্রমাণিত হলে।

তবে আপনারা সতর্ক থাকবেন, রুট ব্রিজ দেখার চক্করে কোনও পর্যটক যেন ঐ গুহাতে না চলে যায়।







“ দাদা, আবার কবে দেখা হবে ? “, গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট এ দাড়িয়ে শৌভিক আমায় প্রশ্ন করলো। দেখলাম, চোখটা একটু ছলছল করছে ওর

“ টুরিস্ট তো কত আসে কত যায়, কিন্তু কিছুজন মনে দাগ কেটে যায়। আপনি তার মধ্যে প্রথম সারিতে পরেন দাদা। “

দিন পাঁচেক আমার সাথে থেকে ওর খুব ভাল লেগে গেছে হয়তো।
মেঘালয় আমারও খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে, ফিরতে ইছে না করলেও যেতে হবেই যে।
“ আসব কোনও একদিন আবারও, যোগাযোগ রেখো ভাই।“
ফোন নাম্বারটা সেভ করে নিলাম।


লাউঞ্জে ঢুকে ওখানের বইস্টল থেকে একটা স্থানীয় পেপার কিনে নিলাম


মুখে একটা দারুণ হাসি এসে গেল, শিরনামের খবর দেখে

 মোবাইলে শৌভিক কে ফোন করামাত্রই ফোনটা ধরে নিল নিমেষে।

“ আর কিছু দিন গুয়াহাটি থাকতে হবে ভাই, একটা থাকার ব্যাবস্থা করতে পারবে ?”
হাসিমুখে ওদিক থেকে বলল, “ কেন পারবো না দাদা, আপনার জন্য সব পারব। তবে এবারে আর কোনও রহস্য নয়। এবারে আপনাকে ঘোরাবো, উমিয়াম লেক, এলিফ্যানট ফলস, ডনবস্ক মিউজিয়াম, নইকালিখাঁই জলপ্রপাত।  কিন্তু হঠাৎ কি হোল ?”

হাসিমুখে বললাম, “পেপারে দেখলাম, কি একটা রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কোলকাতায় লকডাউন চালু হয়েছে।
কয়ারেন্তিন থাকার থেকে এখানে ঘুরে বেড়ানো অনেক বেশী স্বাস্থ্যকর।
আছা ঐ যে এলিফ্যানট ফলস এর নাম বললে, ওখান থেকে একটা গ্রামে যাওয়া যায়। যেখানে একটা সুন্দর জঙ্গল আছে, লোকমুখে কিছু ভয়ঙ্কর কাহিনী জড়িয়ে আছে
কথাটা কি ঠিক ? নাম কি ওটার ?”

“ সাক্রেড ফরেস্ট। “


!! সমাপ্ত !!
 














 


 
 






 


  

 



  



   

 

Comments