ব্রেকিং নিউজ
“ আমি এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছি সেই পিকনিক গার্ডেন এর সেই বাড়ির চারতালায়, যেখান
থেকে গতকাল রাত্রে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ সুত্রে এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর
কারন সঠিক ভাবে জানাতে পারেনি, দেহটি পোস্টমর্টেম এ পাঠানো হয়েছে মর্গে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা অনুযায়ী
,
ঐ ঘরটি কোনও ভাবে অভিশপ্ত ছিল, গত কয়েক বছর ধরে,
কেও ওখানে থাকে না। মৃত ব্যক্তি সম্ভবত সেই রহস্যের সন্ধান করতে গিয়ে এখানে
এসেছিলেন ... ”
টিভি বন্ধ হয়ে গেল।
চোখটা ধীরে ধীরে বন্ধ করলাম, মনে মনে কালকের ছবিটা জ্বলজ্বল করছে, ঠিক পর্দার
মধ্যে সিনেমার মত।
কাল ঐ ঘরে এক জন নয়, দুই জন ছিল। আমি আর আমার ছোটবেলার বন্ধু তিতির।
আমরা আজ থেকে নয়, খুব ছোটবেলা থেকেই ভূতের ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখতাম, আর সেই
বিশ্বাসের ওপর ভর করে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় চৌত্রিশটি ভূতের আস্তানার খোঁজ দিয়ে
ফেলেছি। আমাদের ইউটিউব একটা চ্যানেলও আছে, নাম “ এক বাক্স ভূত “, তিতির বানিয়েছিল।
বছর তিনেক এর মধ্যে তিন লক্ষ্য মেম্বার, আমাদের
চ্যানেল এ, আর কি চাই। আর একটা কথা বলে রাখি, তিতিরের বাবা কলেজস্ট্রীটের নামী বই
প্রকাশনীর সাথে যুক্ত। কাকুই আমাদের একটা বই লেখার কথা বলেন, যেখানে থাকবে আমাদের
সাথে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক কিছু সত্য ঘটনা আর সঙ্গে থাকবে তোলা কিছু ফুটেজ এর ছবি। লেখালেখি
আমার দ্বারা হয় না, ভারটা সেই তিতির নিয়ে নেয়।
সামনের সপ্তাহেই বেরোনোর কথা বইটা, কিন্তু তার আগেই তিতির ছেড়ে চলে গেল আমাকে ...
ভাবতেই খুব কষ্ট হছে আমার, সত্যি বলতে ভাবতে পারছিনা সত্যিটা।
পিকনিক গার্ডেন এর অভিশপ্ত বাড়িটা সত্যি কতটা নিষ্ঠুর, আজ বুঝতে পারছি।
-----------------------------------------------------------------
ঘটনার সূত্রপাত ঠিক আজ থেকে সপ্তাহ দুই আগে। এক বন্ধুর মারফত খবরটা আমার কানেই
গেছিল। বরাবরের মত আমি করে লোকেশন সারচিং এ দিলাম। সব
কিছু মোটামুটি আমাদের পক্ষেই আছে।
রাত্রিতে
তিতির কে ফোন দিয়ে বললাম আমাদের নতুন লোকেশন এর কথা। স্বাভাবিক ভাবেই এক কথায় রাজী
হয়ে যায়। এরই মাঝে আমি লোকেশনটা একবার সার্ভে করে নিলাম দিন দুই পর, সব কিছু বুঝে
শুনে টার্গেট পজিটিভ করলাম।
তিলজলা
পোস্ট অফিস থেকে একটু এগোলেই তারামহল, আর তার ঠিক ওপর পাড়েই এই বিল্ডিংটা। নাম এখনও ঠিক হয়নি, বোর্ডের জায়গাটা ফাঁকা
আপাতত।
একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। ছয়তলা উঁচু ইমারত, দেখতে বেশ লাগবে।
প্রতিটা তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় যে চারতালার পর থেকে বাকি
ওপরের দুই তলার কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, মাঝ পথে কাজ ফেলে চলে গেছে যেন। লক্ষণীয় আর একটা ব্যাপার হোল,বাসিন্দা বলতে একমাত্র একতলা
আর দু তলায় থাকে,বাকি ওপরের পুরোটাই ফাঁকা। এটা খুব একটা ভাল বিষয় নয়।
এক তলার এক বয়স্ক মানুষের সাথে আলাপ হোল, উনি পুরনো ভাড়াটিয়া ওখানের, আছেন প্রায়
বছর দুই হবে। যে কথা গুলো উনি বললেন, কতটা সত্যি
জানিনা, তবে লোম খাঁড়া হয়ে গেছিল শোনার সময়।
এই কমপ্লেক্স এর চারতলা কমপ্লিট হবার পর, ঐ ফ্ল্যাটে একটি পরিবার আসে, ছোট্ট একটি
মেয়ে ও তার বাবা মা। থাকা শুরু করেন সেদিন থেকেই, পাশের ফ্ল্যাটটা ফাঁকা ছিল তখনও।
কিন্তু দিনদুয়েক এর মাথায় কিছু কথা কানাঘুষো মত করে রটে
গেল।
মহিলাটি নাকি তন্ত্র মতে জাদুটোনা করেন, কিসব বাজে কাজ
করেন ।
কথাটা আজকের দিনে দাড়িয়ে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
দিন দুয়েক পরের কথা,খুব ভোর সকাল। মর্নিংওয়াক করাটা আমার অভ্যাস বরাবরের।
সব্বাই যখন ঘুমায়, আমি চুপটি করে বেড়িয়ে পড়ি আসতে করে দরজা খুলে।
কিন্তু সেদিন গেট টেনে খোলা মাত্রই শরীরটা গুলিয়ে উঠলো চোখের সামনে বাইরে পাপোশে রক্ত
পড়ে থাকতে দেখে, সঙ্গে একটা মোরগের মাথা। এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি আমি, গা টা
গুলিয়ে উঠেছিল। ভেতরে এসে মুখে চোখে জল দিয়ে চুপ করে বসে পড়লাম, সেই মুহূর্তে
কাওকে কিছু বলিনি।
পরে খবর পেলাম, পাশের বাড়ির রক্ষিত বাবুর ঘরের সামনেও গতকাল নাকি একই কাণ্ড ঘটেছে।
পর পর ওপরের ফ্ল্যাটে, আর তার পরের দিন
পাশের ফ্ল্যাটে। সন্দেহ সরাসরি যায় ঐ ঘরের ওপর, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না
প্রমাণের অভাবে।
কমপ্লেক্সটি রাতারাতি ভয়াবহের আকার নেয়। দিনের বেলা সব্বাই
বেরোয়, আর অন্ধকার হবার আগেই যে যার প্যাসেজে তালা মেরে দেয়।
মাস খানেক এভাবে চলতে থাকে ভয়ে ভয়ে। আমরা
লিখিত চিঠি জমা দেবার কথা ভাবলাম, কমপ্লেক্স এর অথারিটি কে।
যদি কোনভাবে এই সমস্যার সুরাহা করা যায়।
কিন্তু হঠাৎই ঘটলো অদ্ভুত কাণ্ড।
দিন তিনেক ধরে ঐ বাড়ি থেকে কাওকেই বেরোতে না দেখে আমরা সব্বাই যত
না বেশী ভয় পেলাম, তার থেকেও বেশী চিন্তিত হলাম। সকাল বেলা সব্বাই মিলে জড়ো হয়ে ঠিক করলাম চারতলায় যাবো একসাথে।
দরজার সামনে যেতেই নাকে বীভৎস পচা গন্ধ এলো। স্থানীয় পুলিশকে খবর দিতেই হোল।
ভেতরে তিনটে মৃতদেহ ছিল, তবে সেই জঘন্য দৃশ্য দেখাটা সব্বার
পক্ষে সম্ভব নয়। আমিও পারিনি, ভেতর থেকে চাগার দিয়ে বমি উঠে এসেছিলো, কোনও রকমে
সামলেছি নিজেকে।
ঘরের ডাইনিং রুমের মাঝে সাজানো ছিল একটি নরকঙ্কালের মুণ্ড, পুরো
কপালে সিন্দূর লেপা, বসানো আছে একটি বেদী করে। তার চারপাশে রক্তজবা ফুল, তাজা আছে এখনও লাল তরলের মধ্যে।
সামনে রাখা আছে দুটি বড় হাড়, আর ঠিক তারই সামনে একটি তামার পাত্র। লাল ঘন তরলে
পরিপূর্ণ, থিকথিক করছে। তার কাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা লাল , পড়ে সাদা মার্বেল এর ওপর একটি নকসা করা ত্রিকোণ মত। সামনে শুয়ে আছে ছোট্ট
মেয়েটা, তবে তার দেহটা সাদা ফ্যাটফ্যাট করছে, ঠিক যেন সমস্ত লোহিত কণিকা শুষে
নিয়েছে কেও।
মেয়েটার পা এর আঙ্গুলের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠতে হয়, দুটো পা এর বুড়ো আঙ্গুল নেই,
কেটে ফেলা হয়েছে।
সেই ত্রিকোণ এর দুটি কোনে একটি একটি করে আঙ্গুল রেখে দেওয়া হয়েছে
, আর একটি কোন ফাঁকা এখনও।
মার্বেল এর সেই অংশটা সম্পূর্ণ রক্তিম বর্ণ ছেড়ে মেরুন রঙের হয়ে
গেছে শুকিয়ে।
ঠিক সামনে সাদা লাল পাড়ের শাড়ী পড়ে বসে আছে মহিলা, মাথা নিচু
করে। শরীরে যে প্রাণ নেই, সেটা বোঝা যায় ওনার খোলা চোখের মনিতে রক্তাক্ত আঁচড়
দেখে, ঠিক যেন চোখটা রক্ত ডিমের কুসুমের মত ঘেঁটে গেছে,আর শুকিয়ে শুকিয়ে কালচে হয়ে
গেছে।
ডান হাতে একটা ধারাল ছুড়ি, ফলার মত। ঠিক তার পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে তার স্বামী,
গলার কাছ থেকে বাদামি রঙের শুকনো তরলে পূর্ণ। হয়তো ঐ ত্রিকোণ এর শেষ কোনের উপকরণ জোগাড় চলছিল।
এক নিঃশ্বাসে বয়স্ক লোকটি সমস্ত কিছু বলার পর একটু জল খেলেন। তারপর শুরু করলেন
আবার।
পুলিশ ঘটনার তদন্তে নামার পর রুটিন চেকে আমাদের জবানবন্দি নেয়, আর
তার পর সমস্ত কিছু কমপ্লিট করেন আইনি নিয়মে।
ভেবেছিলাম, সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই যে নতুন অধ্যায়ের শুরু করে দিলো,
বুঝলাম ঠিক এক মাসের মাথায়।
আর এক নতুন দম্পত্তি আসে ঐ চারতালার ঠিক পাশের ফ্ল্যাটে। যেদিন
এসেছে, ঠিক সেদিন মাঝ রাতেই ভয়ানক চিৎকার শুনতে পাই আমরা। আবারও তড়িঘড়ি ছুটে যাই ওপরে একসাথে, তার পর যা শুনলাম তাতে
ঐ রাতে লোম খাঁড়া করে দিলো।
দম্পতিদের কোনও কিছু গোছানো হয়নি তখনও,
শরীরে ক্লান্তি স্পষ্ট দুজনের। রাতে কোনও রকমে কিছু খেয়ে শোয়া মাত্রই দরজায় টোকা পড়ে।
তখন রাত্রি ১টা পেরিয়ে গেছে। এত রাত্রে আবার কে ?
ভদ্রলোকটি উঠে গিয়ে কিছুটা বিরক্তির সাথে দরজা খুললেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পাননি। এভাবে পর পর আরও দুই বার হয়। তারপর
ব্যপারটা থেমে যায়। প্রায় ঘণ্টা কেটে গেছে,
ওরা তন্দ্রাছন্ন।
হঠাৎ ওনাদের দুজনের ঘুম একসাথে ভেঙ্গে যায়,
অনুভব করে, ঘরের মধ্যে একটা কিছু হছে, যেটা ওনাদের বোঝার
বাইরে।
এমন একটা কিছুর উপস্থিতি ঘটেছে যেটা ঘরের শান্ত পরিবেশ কে নষ্ট
করছে। ঘরের উষ্ণতা একটু যেন বেড়েছে মনে হোল, কিন্তু কেন ঘটছে কি ঘটছে কিছুই বোঝার
উপায় নেই।
দুজনে একে ওপরের দিকে তাকাছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারছে না।
পাশ ফিরে আলোটা জ্বালতেই দম্পতির চোখে পড়ল সামনে তিনটি অন্ধকার
ঘন ছায়াবৃত্তের আকারে শরীর দাড়িয়ে আছে। ঠিক ওদের দিকে তাকিয়ে
আছে, নিস্পলক ভাবে।
তার মধ্যে একটি ছোট্ট মেয়ে ছিল, একটি লোক ছিল যার গলায় চেরা দাগ, আর
এক মহিলা যার চোখের কোটর টা শূন্য। সেই শূন্য কোটরেও রক্ত আগুন ঝরে পড়ছে।
কথাটা একটুও ফেলে দেবার মত নয়, আমরা এতটুকু অবিশ্বাস করিনি।
ঐ দম্পত্তি ঐ ঘরের কোনও ঘটনাই জানত না, কারন ওরা এই সবে এসেছে দিল্লি থেকে
ট্রান্সফার নিয়ে, কোলকাতা ওদের কাছে নতুন শহর।
পরদিনই ঘর ছেড়ে দেয়, আর তার পর থেকে চলে আর এক বিপদ।
তিন তলার লোকরা মাথার ওপরে পা এর চলার শব্দও পায় মাঝ রাত্রে,
কেও না থাকা সত্ত্বেও।
আমরা কোনও শব্দও আজও পাইনি, কিন্তু পাওয়ার চেষ্টাও করিনি, হয়তো ওপরে
গেলে...
কথা আটকে গেল বয়স্ক ব্যাক্তির। বুঝলাম, সেই থেকেই এই কমপ্লেক্সে দুর্নাম ছড়িয়ে
গেছে, আজ বছর খানেক হোল। ওপর তলা সম্পূর্ণ ভাবেই বন্ধ।
তিতির কে সমস্ত ঘটনা বলার পর,দুজনেই ঠিক করলাম ঐ স্থানে একটা রাত আমাদের যেভাবেই
হোক কাটাতে হবে, ভাল ফুটেজ পেলেও পেতে পারি।
---------------------------------------------------------------------------------
সমস্ত সেটআপ নিয়ে আমরা ওখানে গেলাম ঠিক রাত্রি ১০টা নাগাদ।
নাইটভিসন ক্যামেরা মোটামুটি চারতালাটা সম্পূর্ণ ভাবে কভার করে দিলাম।
ইনফ্রারেড থার্মোমিটার, ই এম এফ সেন্সর , ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার আর একটি ঘোস্ট
বক্স, মোটামুটি এই আমাদের সরঞ্জাম। সমস্ত কিছু সেট আপ করার পর সময় চলে এলো ১২র
কাঁটায়।
রাত কাটানোর প্ল্যান দুটি ধাপে থাকে। প্রথম ধাপে আমরা দুজনে চারিদিকটা একসাথে
ইনভেস্তিগেট করি। এই ধাপটা খুব ভাইটাল। সেন্সর এর ভ্যালু অনুযায়ী স্পট মারকিং করি। ঠিক যেই স্থানে ঠিক রিডিং ভাল আসে, তার মধ্যে বেস্ট দুটো স্পট
বেছে নিয়।
পরের ধাপে ঐ দুটো স্থানে আমরা বাকি রাতটা কাটাই। ভোর হওয়ার সাথে সাথে বেড়িয়ে আসি
দুজনে।
রাতের বেলা, গা ছমছমে পরিবেশ। তিতির আর আমার অভ্যাস আছে এই পরিবেশকে সঙ্গী করে
অশরীরীর জন্য অপেক্ষা করতে। সেই রাতটা ছিল পূর্ণিমার। মনে মনে দুজনেই বেশ খুশি।
সত্যি কথা বলতে এত দিনের কাজে যা পেয়েছি সেগুলো সমস্তটাই কিছু ঝাপসা ভিডিও ফুটেজ ও
কিছু অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর যেগুলো শুনতে গেলে গায়ে কাটা দেয়।
অজানা শব্দগুলোর বিশ্লেষণ করা চাট্টি খানি কথা না। তিন সফটওয়্যার কে কাজে লাগিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি
ম্যাচ করতে হয়, সেখান থেকে অজানা ফ্রিকোয়েন্সি এর শব্দ বের করাই আমার আসল কাজ। অনেকটা
সময় লাগাই এই শব্দগুলোর পেছনে, কখনও সারা দিন লেগে যায়।
আসলেই
ওটা কি বলতে চেয়েছে, কি তার উদ্দেশ্য সমস্তটাই জানার জন্য আমি খুব আগ্রহী।
এর জন্য সেই ঘরের আর সেই না-মানুষের ইতিহাস জেনে নিয়, আর দুইয়ে দুইয়ে চার করি। তিতির
শুধু সেই ডেটা গুলো নিয়ে এডিটিং করে ছেড়ে দেয় সাথে সাথেই।
---------------------------------------------------------------------------------
রাত্রি ১২টা ৪৫ মিনিট।
তিতির সামনে আর আমি পিছনে চলেছি ধীরে ধীরে। করিডোর পেরিয়ে চারতলায়
উঠলাম যখন, বুকটা কেমন ধড়াস করে ঘা দিলো। বড্ড লম্বা প্যাসেজ, আলো ফেলতে গিয়ে মনে
হয় এখুনি কিছু এসে দেখা দেবেই। নিজেদের পা এর শব্দ একমাত্র শুনতে পারছি, আর কিছু
না।
আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছি দুজনে।
পা ফেলে ফেলে খুব ক্যাজুয়ালি হাঁটার চিন্তা করলেও, এখানের পরিবেশ সেটা হতে দিছে
না। প্রতিবার পা রাখছি, ওমনি মনে হছে আমার পেছনে কেও রাখল পা। সমস্তটাই আমার
মনের ভয়, কিন্তু তাও একটা কথা স্বীকার্য, এমন কিছু আছে ওখানে, যেটা এর আগে অনুভূত হয়নি আমার। এক ধরণের চাপ চাপ গাঁঢ় নিঃশব্দ, কানে তালা ধরিয়ে দিছে।
স্পট মারকিং এর জন্য চার তলার ঐ ঘরটায় ঢোকা মাত্র ভ্যাপসা একধরনের শুকনো পোড়া পোড়া
গন্ধ নাকে এলো। ড্রয়িং রুমের জানালার কাঁচ পেরিয়ে চাঁদের আলো মেঝের যে অংশটাতে
পড়েছে, তাতে সারা ঘর অনেকটাই আলোকিত। ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হওয়ার জন্য যথেষ্ট এইটুকু
আলো আধারি।
দেওয়াল গুলো খুব অপরিছন্ন, খয়েরি রঙের বিভিন্ন আকার প্রকারের ছবি
আঁকা। ইনভেস্টিগেশনে অনেক জায়গা ঘুরতে হয়েছে, সেখানে কোথাও পঞ্চভুজ আঁকা দেখেছি,
বা কোথাও নরমুণ্ডের ছবি অথবা বিশেষ ইঙ্গিত, যেগুলো তন্ত্রবিদ্যার বইতে পাওয়া যায়।
কিন্তু এখানের আঁকা গুলো বড্ড অদ্ভুত। বোধ করি এগুলো কোনও একটা ভাষার বর্ণমালা
দিয়ে তৈরি কিছু লেখা। জানিনা কি লেখা, কিন্তু একটু বুঝেছি গণ্ডগোলের মুলে এই
জায়গাটা তাৎপর্য পূর্ণ।
তিতির ওখানে থাকবে ঠিক করলো, স্পট ১।
চারতলার পাশের ঘরটায় আমি ঢুকলাম একা। ওদের শোবার ঘরেই তো ঘটেছিল আর একটা ঘটনা, ঐ
দিল্লিবাসিদের সাথে। স্থানটা স্পট ২ করে দিলাম।
-------------------------------------------------------------------------------------
মাইক্রোফোন অন করে বসলাম দুজনে দুই জায়গায়, রাত তখন ২টো।
ভূত ব্যাপারটা সত্যি বলতে আমি মানি না। আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলতে একমাত্র এক
প্রকারের এনার্জি। আমরা পজিটিভ এনার্জি নিয়ে চলি, আর তেনারা চলেন নেগেটিভ এনার্জি
নিয়ে।
এই এনার্জি কখন নিজের রূপ পরিবর্তন করে, তা একমাত্র সেই জানে।
অপঘাতে বা অস্বাভাবিক ভাবে মৃত মানুষরা সেই স্থান সহজে ত্যাগ করতে পারে না, যেখানে
তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
বিশেষত তাদের ক্ষেত্রে ঘটে, যাদের শ্রাধ্য
শান্তি করা হয় না।
এখানের ঘটনা তো খুব পুরনো নয়, বড় জোর বছর খানেক।
ঐ ফ্যামিলির দেখা পাওয়া যাবে কিনা জানিনা,
তবে এবারের অনুভুতি সব্বার থেকে আলাদা।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ভূতের এই ইনভেস্টিগেশন, প্রথম তো আমার মাথায়
আসে। মানুষ যখন এই না মানুষের কাহিনীতে এতটা উত্তেজনা প্রকাশ করে, ভেতরে ভেতরে ভয় পাওয়ার
জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। সামান্য ভয় পেতে কেও পড়ে ভূতের গল্প, কেও
বা দেখে ভূতের সিনেমা। ভয় পাওয়ার জন্য মানুষ টাকা খরচ করতেও রাজী।
তাহলে এটা নিয়ে একটা কাজ কর্ম করাই যেতে পারে। ক্যামেরা সেটআপ এর সাথে আসল ফুটেজ
যদি তুলে ধরতে পারি, তাহলে কেমন হয় ?
তিতিরের সাথে আলোচনা করতেই ও সম্পূর্ণ ভাবে আগ্রহী হয়ে উঠলো, আর আমায় ছাপিয়ে কাজ
করা শুরু করে দিলো।
চ্যানেল বানানো থেকে শুরু সমস্তটাই এমন ভাবে পাবলিসিটি করে ফেলল, যেন আইডিয়াটা ওর
মাথা থেকে এসেছে ? ওর বাবা ওকে নিয়ে এতটাই গর্ব বোধ করে যে, ছেলের নাম ওপরে রেখে বইটা
ছাপার কথা ভাবে। আমি লিখতে পারিনা, তাই ওকে দিয়ে লেখাই, তাতে কি হয়েছে ? আমার কথা
কেও ভাবল না কেন ?
যোগ্য সম্মান পাওয়ার অধিকারী কি এই আমি, পরিমল বনিক এর নেই ?
ভৌতিক স্থান গুলোর ঠিকানা থেকে শুরু করে, সেই জায়গার
পুঙ্খানুপুক্ষ খোঁজ খবর নেওয়া, একদিন বা দু দিন গিয়ে সেখানের স্পট ভিসিট করা, ফুটেজ থেকে আসল রসদ খোঁজা, সাউন্ড এডিটিং করা
প্রায় সমস্তাই তো আমি করি। ওর কাজটা কি এখানে ? বাপের দোকান চালিয়ে এসে আমার কাজ
গুলো কে আপলোড করা আর একদম দিনের দিন শুধু ক্যামেরা ধরে আমায় কৃতার্থ করা ?
না, এরকমটা আর চলবে না। আমি আর আমার কাজে ওকে রাখবো না।
আজ আমি ওকে শেষ করবো, তিতিরই আমার আজকের টার্গেট।
বই বেরোবে আর এক সপ্তাহ আগে, একবার সেটা বেরোনোর পর হয়তো আমাকে এই স্থান থেকে বের
করে, নিজেই সব খ্যাতির অধিকারী হয়ে যেতেই পারে। তার আগেই ওর নামটা শুরুতেই
উৎসর্গের স্থানে রাখতে চাই যেভাবেই হোক।
---------------------------------------------------------------------------------
ফ্ল্যাটের দরজাটা আস্তে করে খুলে দেখলাম ঐ ঘরটা সেরকমই আলো আধারির জালে বেঁধে আছে।
তিতির রয়েছে ঐ সামনের ড্রয়িং রুমে।
নিশুতি রাত্রে একটাই আনন্দও, কেও কোনও কু কর্ম করলেও কারোর চোখে
সেটা পড়বে না।
ডান পকেটে স্পর্শ করে দেখে নিলাম ভোজালিটা
ছটপট করছে রক্তের স্বাদ পাওয়ার জন্য। এই ঘরটা বোধয় মানুষ খেকো। এর আগে ঐ
ফ্যামিলি পুরো মরল, এবার মরবে তিতির।
সামনে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছি, দেওয়াল থেকে মুখটা একটু বার করতেই দেখলাম তিতির
পেছন ঘুরে বসে আছে। বেশী শব্দ যাতে না হয়, পা টিপে টিপে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিলাম।
তিতির পিছন ফিরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর ক্যামেরার দিকে।
সঠিক সময় এসে গেছে, ওর মুণ্ডুর পুরো গোল বলটা এখন আমার হাতের খুব
সামনে। আর একটু পড়েই সেই বলটা আলাদা হয়ে পড়ে যাবে মেঝের ওপর,
মেঝেটা আবার করবে রক্ত স্নান।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বার করতে যাবো, এমন সময় তিতির ঘুরে
তাকালও, সমস্ত শরীরটা নিয়ে, ঠিক যেন হাওয়া ঘুরিয়ে দিলো ওকে।
পরের দৃশ্যটা অত্যন্ত ... মানে কি বলবো বুঝতে পারছি না। এটা কার মুখ ? তিতিরের
শরীরে এটা কার কোন মেয়ের মুখ ? চোখের কোটরটা ফাঁকা কেন ? গলার কাছে চাপ চাপ রক্তের
দাগ ? আমার দিকে না চোখে তাকিয়ে আছে, আর ফুঁসছে, ফুঁসছে। ঘরঘর গলার স্বর শুনতে
পাছি।
ভোজালিটা আমার হাত থেকে ততক্ষণে পড়ে গেল খানখান শব্দ করতে করতে।
-------------------------------------------------------------------------------------
ব্রেকিং নিউজ
“ আমি এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছি সেই পিকনিক গার্ডেন এর সেই বাড়ির এর নিচে যেখানে গত
রাত্রে একটি ডেডবডি পাওয়া গেছে। এখন আমাদের সঙ্গে রয়েছে এক বিশেষ ব্যক্তি, যিনি ঐ
ব্যাক্তির বন্ধু এবং উনি দাবি করেন যে ঘটনার স্থলে উনিও ছিলেন কিন্তু পুলিশের ভয়ে
পালিয়ে গেছিলেন। এখন আবার ফিরে এসেছেন সত্যিটা জানাবেন বলে। তাই জেনে নেব ওনার
কাছে আসল ঘটনা।
“ স্যার, আপনার নাম কি ? “
“ আমার নাম তিতির । “
“ কি ঘটেছিল কাল রাত্রে ? “
“ সঠিক ভাবে আমার মনে নেই কি ঘটেছিল, তবে আমরা স্পট মারকিং এর পর দুজনে দুই জায়গায়
বসলাম। তার ঠিক কিছুক্ষণ পর আমার শরীরটা ক্রমশ ভারি হতে থাকে। এর আগে কখনও এটা
ঘটেনি। ক্রমশ ভারি হতে হতে আমি ঢুলে পড়লাম।
ক্রমশ মনে হতে লাগলো, আমার শরীরে কিছু একটা
প্রবেশ করছে আমার অনুমতি না নিয়ে। বুকের খাঁচাটাতে চাপ
অনুভব করছি। আমি আর আমিতে নেই, আমি তারপরই
জ্ঞান হারিয়েছি। কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম জানিনা, কিন্তু চোখ
খুলতেই দেখলাম পরিমল শুয়ে আছে আমার সামনে, দেহ প্রাণহীন। “
খবরটা বন্ধ করে দিলো মর্গের ডাক্তারটা। পোস্টমর্টেম কম্পপ্লিট।
খাতায় নাম – পরিমল বনিক ।
কস অফ ডেথ , প্যানিক অ্যাটাক।
!! সমাপ্ত !!
©SamiranSamanta
Comments
Post a Comment