লকডাউনটা বোধহয় না হলেই ভাল হতো, জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। কোলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, তুমি যতক্ষণ তেল নিয়ে ঘুরছ, ততক্ষণ তুমি সেরা। তেল ফুরিয়ে গেলে তুমি, কে তুমি ?
দুর্গা পূজা এসে গেল প্রায়, মাস ঘুরতে অপেক্ষা। আজ সকালে মহালয়া শুনলাম, কিন্তু
মনের অনুভুতিটাই হারিয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা, কিছু চিন্তা স্পষ্ট হয়ে
যায় কপালের ভাঁজে। কি করে সংসার চালাবো এবার ?
ওরা যে এভাবে আমায় অফিস থেকে বার করে দেবে বুঝতে পারিনি কোনও মতেই। হ্যাঁ, আমি
স্পষ্টবক্তা, কারোর চাটুকারিতা পছন্দ করি না, নিজের সম্মান বিকিয়ে কাজ করা আমার
ধাতে নেই। কিন্তু তাই বলে সুযোগের ব্যবহার করে ফেলল ?
দেশ জুড়ে চাকরি হারাছে যখন সব্বাই, আমি একা প্রতি সপ্তাহে দুই কি তিন দিন করে
অফিসে গিয়ে প্রজেক্টগুলো ধরতে শুরু করলাম, সব্বাইকে অনলাইন কাজ সেন্ড করতে শুরু
করলাম। ম্যানেজার দিব্যেন্দু বড়ুয়া কে যাতে অফিস আসতে না হয়, তার জন্য কম খেটেছি ?
কখনই ওনাকে তেল মারিনি, কিন্তু কাজগুলো আমি করেই দিতাম।
নিজের টেবিলে বসে চার বছরের বেস্ট পারফর্মার অ্যাওয়ার্ড গুলো দেখে আরও কাজের জেদ
বেড়ে যেত।
সেই আমিকে ওরা ছাটাই করে দিলো। কই বাকিরা তো আছে শুনলাম, ওখানেই আছে। তাহলে আমি
কেন ?
ম্যানেজার দিব্যেন্দু বাবু আর কোনও কথাই বলতে চাইলেন না আমার সাথে, জাস্ট একটা
ফর্মাল অফিসিয়াল ই মেইল পাঠিয়ে দিলেন।
বাড়িতে আমার একমাত্র বৌ, নীহারিকা।
মাস তিনেক হতে চলল ও প্রেগন্যান্ট। খরচ তো দিনের পর দিন বাড়ছে বই কমছে না। ডাক্তার
দেখানো, ভাল ফল কিনে নিয়ে আসা, রোজের ওষুধ, সমস্তটাই চালাছিলাম। তার ওপর একটা
সুখবর সঙ্গে করে যখন সমস্তটাই ঠিক চলছিল, তখনই এরকম একটা ব্যাপার আমার সুখের জীবনে
ছাই উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
আজ মহালয়ার পরের দিন। একবার অফিস যাবো ঠিক করলাম, তাই নীহারিকা কে খাবার করতে
বললাম, সঙ্গে বিকেল এর টিফিনটা। ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলিনি, খুব টেনশন করবে
বেচারি। খুব ভাল মেয়ে, আমার লক্ষ্মীমন্ত বৌ। ও আসার পর থেকে আমার কাজে উন্নতি
দ্বিগুণ হয়েছে। বাড়ি এসেও যখন কাজে মুখ গুজে বসে থাকতাম, তাতেও কিছু বলতো না। মাস
গেলে হাতে বেশ কিছু টাকা দিলে, মুখে একটা মিচকি হাসি নিয়ে সেটা আলাদা করে রেখে
দিত।
এই খুশির হাসিটুকু আমি কেড়ে নিতে পারবো না। আমায় যে করে হোক, কাজটা বাঁচাতেই হবে।
অফিসে গিয়ে দেখলাম ম্যানেজার নেই। নাকি আমি গেছি বলে উনি আর দেখা করতে চান না,
জানিনা সেটা যদিও। শেষ চেষ্টা কোনভাবেই সফল হোল না যখন, ভাঙ্গা আকাশের নিচে বেড়িয়ে
পড়লাম। আমার অফিসটা, দেশপ্রিয় পার্কের কাছেই। ওখান থেকে হাটা শুরু করলাম। তাড়াতাড়ি
বাড়ি এসে কি করবো, কি জবাব দেবো নীহারিকা কে। ওর কষ্ট ভরা মুখ আমি যে দেখেতে পারবো
না। আজ কি বলেই দিতে হবে যে আমার চাকরিটা খোয়া গেছে ?
বামদিকে প্রিয়া সিনেমাহল, বন্ধই পড়ে আছে লকডাউন এর পর থেকে। একটু এগিয়ে ডান পাড়ে
যুগলস এর মিষ্টির দোকান পেরিয়ে সোজা হাটতে হাটতে পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্র সরোবরে।
প্রচণ্ড কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেলে প্রায় আমি এখানে আসতাম আগেও, একা বসতাম। বলতে
গেলে একটা বাঁধাধরা জায়গা তৈরি হয়ে গেছিল। কিন্তু এখন তো একেবারেই মুক্ত হয়ে গেছি
আমি। আর বোধহয় এখানে আসার দরকার হবে না।
কিছু মাস হল, লকডাউন উঠে গেছে, কিন্তু লোকজন তেমন বেরোয়নি এখনও।
সরোবরে ফাঁকাতেই চুপ করে বসে আছি, খুব শান্ত পরিবেশ। মাঝে মধ্যে হালকা ঠাণ্ডা
বাতাস জলের সাথে মেখে শরীরে ছুঁয়ে যায়, মনটা বেজায় খুশি হয়ে আকাশে উড়ে যায়।
পরমুহূর্তে মনে পড়ে কি করবো বুঝতে পারছিনা আমি। সরবরের জলটা টলমল করছে, আমায় যেন
ডাকছে।
যাবো ? চলে যাবো জলের তলায় ?
ছি! এসব কি ভাবছি আমি ? আমায় থাকতে হবে, আমায় বাঁচতে হবে নীহারিকা এর জন্য, নতুন জীবনটার
জন্য।
মতিভ্রম ঘটার আগেই আমি উঠে দাঁড়ালাম বাড়ির দিকে যাবো ভেবে, এমন সময় একটা পোস্টার
চোখে পড়ল। যেখানে বসে আছি, তার ঠিক কাছেই, কেও যেন সদ্য কিছুক্ষণ আগেই সাটিয়ে দিয়ে
গেছে, চকচক করছে গোলাপি কাগজটা, তার ওপর কালো হরফে অক্ষর জ্বলজ্বল করছে।
“ চাকরি হারিয়েছেন ? রাতারাতি ১০ লক্ষ্য টাকার মালিক হতে চান ? শীঘ্র যোগাযোগ করুন
নিচের ঠিকানায় “
বলে কি ? দশ লক্ষ্য টাকা ?
ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম, ঠিকানাটা তো এই আশেপাশেই হবে। মাথায় ভাল মন্দ খেয়াল
আসেনি সেই মুহূর্তে, বেশী চিন্তা না খাটিয়ে পড়িমরি করে ছুটলাম ঐ ঠিকানার খোঁজে।
মনে তখন অনেক প্রশ্ন, কি কাজ হবে ? কিভাবে করবো ? আমি পারবো তো ?
দশলাখ এই মুহূর্তে অন্তত পেলে মাস খানেক চালিয়ে নেওয়া যাবে, সাথে অন্য একটা কাজ
যদি পাই, তখন এটা ছেড়ে দেবো। কিন্তু কাজটাই বা কি ? কি এমন কাজ যেটা দশ লাখ টাকা
সহজেই অফার করছে। এক এর পিঠে কটা শূন্য হবে সেটা হিসেব করতে করতে এগিয়ে চললাম ঐ
ঠিকানার লক্ষ্যে, মনে লক্ষ্য প্রশ্ন, লক্ষ্য টাকার স্বপ্ন বুনছে।
একটা লম্বা রাস্তার মাঝে এসে পড়েছি, যার দুইদিকে তেমন কোনও বাড়ি নেই। যেগুলো আছে,
ভাঙ্গা গ্যারেজ এঁর মতই বলা চলে, পরিত্যক্ত। ময়লা পুটুলি করে ফেলা, কোথাও আবার
নোংরা জঞ্জাল। এই জায়গায় ভিখারি বা চোর ছাড়া কেও আসে বলে তো মনে হয় না, একদম
শুনশান। এখানে আবার কোন অফিস?
রাস্তার শেষপ্রান্তে একটা বড় বাড়ি। বাইরে থেকে সিমেন্ট বালি যেন খসে পড়ছে, জানালার
ওপরের কার্নিশ গুলো ভাঙ্গাপ্রায়। রঙটা কিছুটা ঘিয়ে মত, পুরনো সেকেলে।
ওপরের বারান্দা এর অংশটা বেঁকানো গোল মত, তারজালির বেড়ার মত লাগানো ওপরের খোলা
জায়গায়।
মূল দরজার সামনে একটা বড় প্ল্যাকার্ড, ঠিক সেই গোলাপি রঙের। ঠিকানাটা পোস্টার এ
যেটা লেখা ছিল সেটাই । তারমানে আমি ঠিক জায়গায় এসেছি।
একটা ফোন নাম্বার এখানে অ্যাড করা আছে, ঠিকানার সাথে। এটা আবার কি ধরণের অফিস!
নাকি কোনরকম ট্র্যাপ।
মাথা কাজ করছে না, একবার কি ফোন করে দেখবো ? নাকি বাড়ি চলে যাবো। অসহায় লাগছিল
নিজেকে, কিন্তু কিছু করার নেই তাছাড়া। বেশী ভেবে কাজ নেই, এসেছি যখন এতদূর, ফোন নাম্বারটা
টাইপ করতে লাগলাম।
ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুরু করে দিলো নিজের কথা, আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই।
“ আপনি যখন এই নাম্বারে ফোন করেছেন, তারমানে আপনি সেই বাড়িটির সামনে দাড়িয়ে আছেন।
আপনার যদি একান্ত টাকা প্রয়োজন, তাহলে আপনার জন্য একটা কাজ আছে। আপনাকে এই বাড়িতে
একটি রাত কাটাতে হবে, তবে একা। তার জন্য কিছু নিয়ম মানতে হবে। আপনি কি তৈরি ?”
সাতপাঁচ না ভেবে, কাঁপা কাঁপা গলায় “ হ্যাঁ ” বলে দিলাম।
“ বেশ। তাহলে আপনাকে মানতে এমন কিছু নিয়ম বলে দিছি এখন।
প্রথম, আপনার মোবাইল ফোন বন্ধ রাখতে হবে ২৪ ঘণ্টার জন্য, বাইরে থেকে কোনও কানেকশন
যেন না থাকে।
দ্বিতীয়, কোনও রকম খাবার থাকবে না। আপনার কাছে যদি কিছু থাকে, সেটাই চালাতে হবে।
তৃতীয়, ওপর তলায় একটি রুম বন্ধ থাকে সবসময়য়, ওখানে কখনই ঢোকার চেষ্টা করবেন না।
কাল ঠিক এই সময়, আপনাকে নিতে আমি নিজে আসবো, সঙ্গে কথামত দশ লক্ষ্য টাকা ।
তিনটি নিয়মের কোনোটাই লঙ্ঘন করলে আমি টের পাবো, কারন সেন্সর আর সিসি টিভি ওখানে
লুকোনো আছে।
টাকার পরিমাণ সেক্ষেত্রে কমতে থাকবে প্রতিঘণ্টা অনুসারে।
যদি আপনি সম্মত হন, তাহলে আমার বাড়ির সামনে একটা সেলফি তুলে আমায় এই নাম্বারে
পাঠিয়ে দিন। আপনার হাতে সময় মাত্র ৫ মিনিট। “ এই বলে ফোনটা কেটে গেল ওপার থেকে।
প্রস্তাবটা বড়ই অদ্ভুত আমার কাছে।
একরাত্রি বাড়িতে থাকলেই টাকা পাবো ? গল্পের বইয়ে, সিনেমায় এসব ভাললাগে, বাস্তবে
এমনটা হবে তাও আমার সাথে ? এদের আসল মতলবটাই বা কি ? কি জন্য এমনটা করতে চাইছে,
কিছু বুঝতে পারছিনা। এসব আসলেই ভুয়ো ব্যাপার হয়, আর জানিনা চিনিনা কি করে বিশ্বাস
করবো আমি ? বড্ড দোটানায় পড়লাম।
কি করবো ? ধুস, এসব জালিয়াতি ছাড়া কিছু না, এই ভেবে পেছন ঘুরতেই নীহারিকা এর মুখটা
মনে পড়ল।
ফোনের মধ্যে বলা “ দশ লক্ষ্য টাকা “ কথাটা এখনও কানে বাজছে।
বাড়ির লাগোয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম।
“ নীহারিকা, আজ অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে সেই আগের মত। আজ রাতে ফিরতে পারবো না
আমি। তুমি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমার জন্য অপেক্ষা করো না কিন্তু লক্ষ্মীটি।
নিজের খেয়াল রেখো। “ বলা মাত্র হাঁফ ছাড়লাম। মিথ্যা বলা আমার ধাতে নেই, কিন্তু এছাড়া
আর কি উপায় ছিল।
সেলফি তুলে পাঠিয়ে দিলাম। সেকেন্ডের মধ্যেই মেসেজের একটা রিপ্লাই এলো , “ বেস্ট অফ
লাক “।
এখন সকাল ১১টা বেজে ৫০ মিনিট।
নেমপ্লেট বলে কোনও বস্তু থাকলেও কোনও নাম সেখানে দেখতে পেলাম না। দরজাটা একটু
সেকেলে গোছের, নিচে লোহার দুটো বালা আছে, কিন্তু কোনও চাবি নেই। কেও নেই কি সত্যি
? ডান হাতের কনুই দিয়ে ঠেলা মারতে দুটো দরজাই খুলে গেলো। ভেতরের একটা ভ্যাপসা গন্ধ,
ঠিক যেন অনেক দিন ধরে কেও না থাকলে যেমন হয়
নীহারিকা এর কথা মনে পড়ে গেলো আবারও মুখের সামনে, জানিনা আমি কি করতে চলেছি।
তবে যা হবে তিন জনের ভালোর জন্যই হবে।
ঘরে ঢুকে পড়ামাত্রই ডান দিকের দরজায় লাগোয়া সুইচবোর্ড দেখতে পেলাম। কোনও রকমে আলো
যখন একটা জ্বলল, দরজাটা বন্ধ করে দিলাম আগের মত করেই।
শুরুতেই বড় হলঘর একটা, যার একপাশে বেশ কয়েকটা চেয়ার রাখা রয়েছে একটি গোল টেবিল কে
ঘিরে। ব্যবহার উপযোগী হতে পারে যদি ধুলো ঝারা যায়। বাম দিকে একটা অপরিছন্ন সোফা,
যেটা বেশ শক্তপোক্ত কাঠের তৈরি বলেই মনে হয়। এগিয়ে দেখলাম ডান পাশে একটা ছোট্ট ঘর,
বাম দিকেও সেরকম একই মাপের ঘর। মাঝখান থেকে চলে গেছে একটা সিঁড়ি। বাড়ির মেঝে যেমন
মার্বেল পাথরে তৈরি, সেটার সাথে মানানসই সিঁড়ির পুরো অংশটা। যতই দেখছি একটা কথা
স্পষ্ট, যারই বাড়ি হোক না, সে যেমন টাকার মালিক ছিল, তেমনই শৌখিন। কিন্তু হঠাৎ ঠিক
কি কারণে এই ঘরের এমন দুরবস্থা !
সিঁড়িটা দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে থাকলাম, একটা অজানা কৌতূহল আমাকে ওপরের দিকে
নিয়ে চলল, সেটা নেহাতই অজানা খিদে।
ওপরে উঠতেই যেখানে চোখটা আটকালও, সেটা ওপরের ঝাড়বাতিটার জন্য। মাকড়সা নিজের বংশ
বিস্তার করলেও এর সৌন্দর্য কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সামনে একটা ছোট্ট কাঁচের টেবিল,
তিন দিকে ছোট্ট ছোট্ট সোফা, পরিষ্কারের অভাবে নিজের যৌবন হারিয়ে ফেলেছে।
সেই সকাল থেকে বেড়িয়ে সারাদিনের এত টেনশন এ আর কাজ করছিল না মাথাটা। মাঝখানের
সোফাটাতে একটু বসে পড়লাম। ধুলো ঝারার মত কিছু তো পেলাম না, অগত্যা।
পিঠের ব্যাগটা টেবিলে রেখে জলের বোতলটা বার করে দুঘোট দিলাম। আহ, শান্তি।
টিফিন বক্সটা বার করে নিয়ে সেটার সৎ ব্যবহার করার চেষ্টা করলাম এই নোংরার মধ্যেই।
সামনেই হাতটা অল্প জলে ধুয়ে নিলাম।
পেট ভরতেই সেটা চোখে শরীরে ক্লান্তির রূপ নিল, শরীরটা এলিয়ে দিলাম সোফাতেই।
ঘুম ভাঙল কিছু একটা সরার শব্দে। চমকে উঠেই চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার দেখলাম
এক্কেবারে। সন্ধে নাকি রাত বোঝার উপায় নেই। এতক্ষণ ধরে অঘোরে ঘুমিয়ে রয়েছি আমি ?
একদিকে ভালই হয়েছে অনেকটা সময় কেটে গেছে। তাহলে এই রাতটুকু কাটাতে পারলেই হল। এতো
অন্ধকারে কিছুই তো দেখা যায় না। সকালে নিচে যে আলো জ্বালিয়ে এসেছিলাম, সেটাও ঠিক
এখানে থেকে বোঝা যায় না।
মোবাইলটা বার করতেই হল। ওটার টর্চটা জ্বালিয়ে সামনের দিকে দেখতেই চমকে উঠলাম।
সামনের টেবিলটা এতটা দূরে চলে গেছে কি করে ? শোয়ার সময় তো ব্যাগটা সামনে রেখেই
শুয়েছিলাম, সেরকমই মনে পড়ছে। নিচের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, টেবিলের পায়া গুলোর
সামনে ময়লার মধ্যে রেখা টেনে গেছে, অর্থাৎ টেবিল সরানো হয়েছে। কিন্তু কে ? ঘরে কি
আমি ছাড়া আর কেও আছে ?
এই প্রথম গা টা ছমছম করে উঠলো, নিজের অজান্তেই।
জল তেষ্টা পেয়েছে একটু। উঠে দাড়িয়ে আস্তে আস্তে ব্যাগের কাছে গিয়ে বোতলটা বার করে
গলায় জল ঢালার সময় মুখটা ওপরের দিক করতেই চোখে পড়ল সেই ঝাড়বাতিটা। অন্ধকারে কেমন
যেন মরা মরা লাগছে। সুইচ বোর্ডের খোঁজে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম, কিন্তু কোথাও
কিছু পেলাম না, বড্ড অদ্ভুত ব্যাপার। জিনিস আছে, অথচ তার ব্যবস্থা নেই, এটাও সম্ভব
নাকি এই যুগে!
যে চেয়ারে বসে ছিলাম, সেটার পিছনে একটা জানালা আছে। যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম, সেটা
চোখে পড়ল বহুদূর পর্যন্ত, সম্পূর্ণ নির্জন। কাছাকাছি বাড়ি নেই বলেই হয়তো এতটা গা
ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমি ছোটবেলায় এমন ঘরকে ভূতের বাড়ি বলে জানতাম।
কথাটা মাথায় আসা মাত্র শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত জামার ভেতর দিয়ে নেমে
গেলো।
বাড়িটার প্রতি যে মনোভাব ছিল, সেটাও পাল্টে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। সত্যি এরকম যদি
কিছু হয় তাহলে ?
ঢিপঢিপ অনুভুতি হল।
ফোনটা বার করে দেখলাম সিগন্যাল অফ আছে, শর্ত অনুযায়ী।
নাহ, একবার নীহারিকা এর সাথে কথা বলতে হবে, খুব ভয় করছে। একটু আড়াল হয়ে এরোপ্লেন
মোড অফ করে তাকিয়ে রইলাম, কখন টাওয়ার আসে। মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়, কানেকশন আর
এলো না। কোনভাবে কি জ্যামার লাগানো আছে ? আর একটা কারণেও এসব ঘটে, সেটা হল অশরীরী
কিছুর উপস্থিতি। না না, কি আবোলতাবোল ভাবছি আমি। ধুস এসব কিছু না।
মনে শক্তি সঞ্চয় করে এক ছুটে চলে এলাম নিচে দরজার কাছে।
কোথায় আলো জ্বলছে ? না কোনও আলো জ্বলছে না। বড্ড গুমোট হয়ে গেছে।
দরজাটা একটু খোলা দরকার।
কিন্তু দরজা খুলছে না কেন ? সকালে তো আমি কোনভাবে এটা লক করিনি মনে আছে, তাহলে ?
বাইরে থেকে কি কোনও ভাবে লক করা হয়েছে ? এসব কি হছে ?
আমি কি আর বাইরে বেরোতে পারবো না ? ভয়টা এবার সত্যি জমাট বাধতে শুরু করলো মগজে।
আমার মানি ব্যাগে সবসময় একটি ঠাকুরের ছবি থাকে, সেটা হয়তো এখন কোনও কাজে আসবে।
কিন্তু ব্যাগটা ওপরে ফেলে চলে এসেছি। আবার যেতে হবে ভেবেই ভয় আরও চেপে বসল আমার
ওপর।
আবার সেই অন্ধকার, আবার সেই সরে যাওয়া টেবিল এর পাশে যেতে হবে ভেবেই ঢিপঢিপ অনুভব
করছি।
টর্চের আলো ফেলে সেই একই সিঁড়ি ধরে চলেছি ওপরের দিকে ভয়ে ভয়ে।
টেবিলের সামনে আসতেই ব্যাগটা চোখে পড়ল।
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো তৃতীয় শর্তের কথা।
কোন রুমের কথা বলা হয়েছে যেটা খুলতে পারবো না ?
এখানে তো এই একটাই ড্রয়িং রুমের মত, আর বামদিকে পুরো অংশটাই ফাঁকা। আর ডান দিকে তো
? একমিনিট ! একটা দরজা এই প্রথম চোখে পড়ল। সম্ভবত এটার কথাই বলা হয়েছে। দরজার
ওপরের অংশে আলো পড়তেই একটা স্বস্তিক চিহ্ন দেখলাম, সিঁদুর দিয়ে আঁকা, তবে খুব
পুরনো নয়। বাইরে থেকে দেখতে ঠাকুর ঘর মনে হতে লাগলো।
মনে মনে একটু পজিটিভ শক্তি এলো নিজে থেকেই।
নিজের ভেতর থেকে একটা ডাক দিলো, এই ঘরে ঢুকতেই হবে আমাকে। আমাকে জানতেই হবে কি আছে
এই ঘরে। কিন্তু শর্তের ব্যাপারটা ?
চুলোয় যাক শর্ত। বড়জোর একটু টাকা কেটে নেবে, সেটা আমার ম্যানেজারও করে, এটা আমার
কাছে নতুন নয়।
বেশী ভাবনা মাথায় না ঢুকিয়ে দরজার সামনে গেলাম ধীরে ধীরে।
ডান হাত দিয়ে দরজায় স্পর্শ করতেই আলগা করে খুলে গেলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখতে
পাওয়া যায় না।
গন্ধটা তবে বেশ অন্যরকম, বলে বোঝানো কঠিন। মিষ্টি আর আঁশতে গন্ধ মিশে একটা অদ্ভুত
সুন্দর মেজাজ তৈরি করেছে ভেতরের বাতাস।
সাহস করে ঢুকে গেলাম, হাতে মোবাইলটর্চ জ্বালিয়ে। সামনে একটা পুরনো দিনের বিছানা,
ঠিক যেন রাজা খাটের মত, কোনও এক কালের যত্ন আজও টের পাওয়া যায়, এগিয়ে গেলাম।
পেছনের দরজা মৃদু ক্যাঁচ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র অল্প বেশী রাখা আছে তবে গোছানো।
একটা সুন্দর আরামকেদারা, তার পাশে রুপোর বাসনপত্র সাজানো। বিছানার ঠিক বাম পাশে
সুন্দর একটি আলমারি, বেশ পরিষ্কার পরিছন্ন বাইরে থেকে ।
অদ্ভুত সুন্দর ঐ গন্ধটা ঘরটাকে বাইরের জগত থেকে বিছিন্ন করে রেখেছে। এই ঘরের
সৌখিনতা আর গোছানো দেখে মনে হবে না, এর বাইরের অংশ এতটাই খারাপ।
টেবিলে রাখা একটা পুরনো ফ্রেম, একটি ছবি আছে যেখানে একটি সুন্দরী বিবাহিতা মেয়ে,
আর তার কাঁধে হাত দিয়ে আছে একজন সুপুরুষ। ওনার মুখটা কীভাবে যেন নষ্ট করে দেওয়া
হয়েছে, কিন্তু মহিলাটিকে বেশ সুন্দরী লাগছে। বেশী মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করলাম
না।
একটা কথা মনে এলো, এই ঘরে কি এমন আছে যে নিষেধাজ্ঞ্যা ছিল। আগে জানলে এই ঘরেই আগে চলে
আসতাম, এত সুন্দর সাজানো ঘর, বাইরের ধুলো খেতে হতো না।
ধপ করে শুয়েই পড়লাম ঐ অল্প নোংরা বিছানায়। ভয়টা অনেকটাই কেটে গেছে।
খট খট খট !
ঘরময় শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল। তিড়িং করে বিছানায় উঠে বসলাম।
শব্দটা এলো কোথা থেকে।
খট খট খট খট খট খট !
বিছানা থেকে বাম দিকে পা ফেলতে গিয়ে আবার পা তুলে এক কোনে জড়সড় হয়ে গেলাম। শব্দটা
আসছে ঐ আলমারির দিক থেকে। আলো ফেলতে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হল অন্ধকারে, আলমারির
দরজাটা যেন নিঃশ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতে খোলার চেষ্টা করছে কিছু একটা। মুহূর্তের মধ্যে
আবারও সেই শব্দ ঘরময় ভর্তি। খট খট খট !
কি করবো ? মাথা আর কাজ করছেনা এবার।
ডানদিকে একবার দরজার দিকে তাকাই, শত কাছে থাকা সত্ত্বেও যেন সেই দরজা অনেক দূরে । পায়ে
অসাড় অনুভূতি, উঠতে পারছিনা। এই মুহূর্তে ঘরের মিষ্টি গন্ধটা বড্ড আঁশটে হয়ে গেছে।
নিজের হৃদস্পন্দন সারা ঘর যেন শুনতে পাছে। এই ঘর থেকে আমার বেড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
হুট করে আলমারির দরজাটা খুলে গেল পুরো, আর তারপরই অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এলো কালো
রঙের ছায়া, না এটা একটি দেহ। হেঁটে এলো নাকি ভেসে এলো বোঝার উপায় নেই। আমার জ্ঞান
হারানোর জোগাড়...
কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেহটি আমার কাছে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, আর দুই ফুটের ব্যবধান
মাত্র। আঁশটে গন্ধটার রহস্য এবার আমার কাছে স্পষ্ট।
মাথা ঘুরছে, পুরো বিছানা টলছে মনে হল, কি করবো আমি বুঝতে পারছি না। অন্ধকারে ঠিক
ঠাহর করতে পারিনা দেহ টা ঠিক কতটা কাছে চলে এসেছে।
এখন আফসোস হছে। এ আমি কোথায় চলে এলাম।
কেনই বা এমন বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়েছিলাম। না না, এখন এসব ভাবার সময় নেই।
কিছু না দেখতে পেলেও অন্ধকারে ইন্দ্রিয় গুলো প্রবল সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অনুভব করলাম
যেটা এতক্ষণ চলমান ছিল আমার সামনে, সেটা স্থির হয়ে গেছে। সামনেই দাড়িয়ে আছে বুঝতে
পারলাম, ভাবা মাত্রই গলাটা শুকিয়ে কাঠ।
বাম দিকে তাকাতেও ভয় করছে, যদি কিছু দেখে
ফেলি। চোখটা প্রবল জোরে বন্ধ করে রয়েছি। শরীর হালকা অনুভব করছে, বুঝতে পারছি এবার
ভয়ানক কিছু ঘটবে হয়ত, প্রবল জোরে বজ্রপাত হওয়ার আগে যেমন মেঘ একটু শান্ত হয়ে যায়।
আমার শরীরটা যে আমার সাথে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, কেন আমি বিছানা থেকে উঠতে
পারছি না, কি একটা শক্তি আমাকে এখানে আঁটকে রেখেছে। নিজের দমটাও আমার নিয়ন্ত্রণের
বাইরে যেন, এতটা কষ্ট হছে।
একটা পর্যায়ে মনে হল কানের কাছে কোনও বাতাস নেই, সম্পূর্ণ শূন্যস্থান হলে একটা চি
চি শব্দ ভেতরে ভেতরে প্রতিধ্বনিত।
পর মুহূর্তে আমার বাম কান ঝালাপালা করে একটা বিকট শব্দ কানে এলো মেয়েলি জোরালো
স্বরে।
“নীহা মরবে, নীহা মরবে, নীহা মরবে “।
খান খান করে মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেলো সেই ঘরের আবহাওয়া। বুকের ভেতর তখন হাতুড়ি
পিটছে, আচমকা এমন স্বর শুনে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রচণ্ড ভাবে ভয় পেয়ে গেছি, জীবনে এমন ভয় সত্যি পাইনি।
কিন্তু এক মিনিট ! নীহা মরবে মানে ?
নিহা তো আমার স্ত্রীর নাম, তাহলে এ জানলও কি করে ?
এসব কি শুনতে হছে আমায়, তাও আবার এমন একজনের কাছ থেকে যাকে আমি ভয় পাছি।
নিজের স্ত্রী কে নিয়ে এমন কথা বললে যে কোনও স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু আমি
পারিনি। কারন পরিস্থিতি আমার অনুকূলে ছিল না।
নীহারিকা কে আমি “ নীহা “ বলে ডাকি, সেটাই বা জানলও কি করে।
অশরীরী দের জন্য সবই সম্ভব হয়তো। শরীরে যতটা শক্তি ছিল, সমস্তটাই মাথার মেরুদণ্ডে
সঞ্চয় করে মাথাটা একটু ঘোরাতে চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে মাথাটা ঘোরাতেই দেখলাম
কালো রঙের অন্ধকার।
হঠাৎ সেই মুখটা সামনে এসে পড়ল।
“ নীহা মরবে “, আবার সেই একই কথা।
ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত হয়ে যাচি আমি, কিন্তু মুখে রা কাটার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।
এই মুহূর্তে ঐ অশরীরীর চোখ আমার সম্মুখে, আমার বন্ধ চোখ কখন খুলে গেছে অন্ধকারে
সেটা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। সে কি বীভৎস দৃষ্টি। ক্ষোভ ফেটে বেড়িয়ে আসছে চোখের
মনি থেকে। আমি আর চোখ ফেরাতে পারছি না।
এ কোন সম্মোহন আমাকে পেয়ে বসেছে। আসতে আসতে চোখের পেশি গুলো দুর্বল হয়ে পড়ল,
ঘোলাটে হতে থাকল দৃষ্টি শক্তি। মুহূর্তের মধ্যে আমি একটা ধোঁয়ার মধ্যে প্রবেশ
করলাম।
চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ফুটে উঠলো, ঠিক সিনেমার মত।
আমি আমার বাড়ীতেই আছি, সকাল দশটা বাজে প্রায়। এটা সম্ভবত লকডাউন এর আগের ছবি,
যেদিন প্রথম নাইট শিফট এর জন্য খাবার গুছিয়ে দিলো নীহা । যথা সময়ে আমি বেড়িয়ে
যাওয়ার পরও ছাদে দাড়িয়ে ছিল ও। তারপর দেখলাম মিনিট খানেক পর একটা লম্বা বড় গাড়ি
এসে পার্ক করলো আমার বাড়ির সামনে। গাড়িটা বড্ড চেনা ঠেকছে।
ড্রাইভার এর সিট থেকে বেড়িয়ে এলো, এ আমি কাকে দেখছি। এতো মিস্টার বড়ুয়া, আমার বস।
ওকে দেখা মাত্রই আমার স্ত্রী এর মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে, চটকরে ছাদ থেকে নেমে
এসে দরজা খুলে দিলো।
দৃশ্য পাল্টে গেল।
দেখলাম আমাদের শোবার ঘরে এই মুহূর্তে দুটো নগ্ন শরীর। ওদের শরীরের ভাজে একটা সুতো
পর্যন্ত নেই লজ্জায়। সকালের অন্ধকার নেমেছে বন্ধ পর্দার মধ্যে দিয়ে।
বড়ুয়া নীহার বক্ষদেশ এর মধ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছে, সম্পূর্ণ মুখ ডুবে আছে, নীহার বন্ধ
চোখ তার অনুভুতি প্রকাশ করছে পুরো মাত্রায়।
দুটো শরীর পৃথিবীর কোনও বাঁধা না মেনেই আস্তে আস্তে একটা হয়ে গেল। শরীরের খাঁজে ভাঁজ
লেগে গতি নিল নিজের দোলনের মাধ্যমে। নীহার তৃপ্তির মুখ অতি সুস্পষ্ট।
ঘোড়দৌড় শেষে ওপরের কাঁচা পাকাদাড়ি ওয়ালা মুখটা নিচে চলে গেল, নূপুর নিয়ে ইনিবিনি
খেলবে বলে, তখনই নীহা বলে উঠলো , “ আর কত দিন ? আমরা কি এভাবেই লুকিয়ে দেখা করবো
?”
“ বেশী দিন নয় আর, মাথায় ভাল একটা প্ল্যান করেছি। খুব শিগগির তোমাকে নিয়ে যাবো,
নিজের করে নেব।
আর তোমার বর অফিসে কাজ করতে করতে মরবে। “
“ অফিস থেকে এসেও ও যখন কাজে বসে, আমি তখন ভাবি কীভাবে এই অমানুষটার কাছ থেকে
রেহাই পাবো। আমার আর ভাল লাগছে না। “
“ চিন্তা করো না, আর একটু অপেক্ষা করো সোনা। তোমার বর কে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়
আমি জানি।“
“ আর তোমার স্ত্রী ? সে কিছু বলবে না বুঝি ?”
“ আমার স্ত্রী ? মানে তো তোমার দিদি। ও একটা বোকা মেয়ে। ওকে নিয়েই তো আমার
প্ল্যান। প্লিস এই নিয়ে আর কথা নয়, আজ সারাদিন সারারাত আমি ডুবে থাকতে চাই
নীহারিকার জগতে। তোমার বোকা বর সারারাত অফিস সামলাক, আমি আপাতত তোমাকে সামলাই।“
“ তাই ? দুষ্টু টা। “, বলামাত্র নীহার শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে গেলো ওপরের চেহারায়
আস্তে আস্তে...
মুহূর্তের মধ্যে ঘুম ভাঙ্গার মত আমি জেগে উঠলাম। এ আমি কি দেখলাম। স্বপ্ন নাকি
বাস্তব ?
আমি আমার স্ত্রী কে এতটা বিশ্বাস করি, যে ও আমায় তার দাম এভাবে দিলো। সমস্তটাই
তাহলে ভান ? এতদিন ধরে আমার সাথে শুধু ছলনা করে গেছে আমার সঙ্গে ? কেন ? আমিতো ওকে
খুব ভালবাসি, পাগলের মত।
সেই ভালবাসার দাম এভাবে দিলো নীহা ? আর পারছি না এসব ভাবতে।
সহ্য করতে পারছি না, এই সত্যি টা।
তাহলে ? তাহলে ওটা কার সন্তান ? ওটা কি তাহলে... ?
নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
আমি যত রাত্রি অফিসে কাটিয়েছি ঠিক তটা রাত্রি... ছি ছি ছি। আর ভাবতে ইছে করলো না।
সামনে তাকিয়ে দেখলাম, চোখের সামনে কেও নেই।
একটু আগেও যে দেহ দেখেছি, সেটা আর এখানে নেই। ঘরটা ঠিক আগের মতই, কিন্তু জানালা
উসকে একটা আলো আসছে। সকাল হয়ে গেলো নাকি ?
বিছানার সামনে ছবিটা আবারও চোখে পড়ল। মেয়েটি আমার খুব চেনা, হ্যাঁ নীহারিকার দিদি।
সেজন্যই গলাটা বড্ড চেনা চেনা লাগছিলো। শুনেছিলাম কোনও একজন কে ভালোবেসে বিয়ে
করেছিলো, কোন রকম সংযোগ তো আমার সাথে ছিল না। সেই মর্কট যে আমার বস, সেটা জানতাম
না।
বাম দিকের আলমারিটা চোখে পড়ল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই বমি আসবে, একটা বাসি পচা গন্ধ
উঠছে। একটা মৃতদেহ, নীহারিকার দিদির। বেশ কিছুদিন আগেই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। কাল
এই দিদি অশরীরীর বেশে আমায় সত্যিটা বুঝিয়ে দিতে এসেছিল।
শুনেছিলাম এই দিদি সব্বার থেকে খুব সরল ছিল, আর তার পরিণতি এই হোল ? মিস্টার বড়ুয়া
এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য আমাকে হাতেনাতে ফাঁসাতে
চায়, তাও তার এই পুরনো ভাঙ্গা বাড়িতে, এটাই তার প্ল্যান তাহলে।
কিছু দূর থেকে পা এর শব্দও হছে, বেশ কয়েকজনের।
শরীরে একটু জোর এসেছে । এক লাফে ঘর থেকে বের হয়ে জানালার সামনে যেতেই দেখলাম,
পুলিশের একটা গাড়ি আসতে আসতে এই মুখে এগিয়ে আসছে, আর তার পাশাপাশি কিছু কনস্টেবল
ছুটছে। সম্ভবত হারামি বড়ুয়াটা পুলিশ পাঠিয়েছে আমার জন্য।
কিন্তু আমাকে যেভাবে হোক এই ঘর থেকে বেরোতে হবে। আমার সাথে ভান করার পরিণাম বুঝিয়ে
দেবো ওদের দুজন কে। দিদির কথাই সত্য হোক।
“ মরবে, মরবে হারামিটা মরবে সঙ্গে... “।
সমাপ্ত
Comments
Post a Comment