চাকরি করাটা যতটা আনন্দের, তার থেকে কষ্ট বেশী হয় বদলি হওয়ার জন্য। ভালমতোই চলছিল ভুবনেশ্বর এ, কিন্তু ওদের আর পোষাল না আমার খুশি টা। ডাইরেক্ট কোলকাতাতে পাঠিয়ে দিলো। আমি বাঙালি, কিন্তু জন্ম জামসেদপুর এ। নিজের ফ্যামিলির সব্বাই চাকুরীজীবী, তাই আমি আর অন্য পথ ধরি কি করে।
ইঞ্জিনিয়ারিং সেরে ছোট্ট একটা প্রাইভেট ফার্ম এর ঢুকলাম, তারপর বদলি হতে হতে এবারের
গন্তব্য কলকাতায়।
মাইনে সে তুলনায় তেমন বাড়ল কই, সেই খরে দরে একই খরচ। হাতে পয়সা জমছে না আর।
তাই ঠিক করলাম কম পয়সায় একটা ভাড়ার ঘর খুঁজবো।
সাথে এত বড় বড় ব্যাগ, এদিক ওদিক করাটাই বিপজ্জনক। এই কিছুদিন আগে পোঁটলাপুটলি
গোছাতে গিয়ে আর একটা বড় ব্যাগ এক্সট্রা হোল।
হাতিবাগান এলাকায়, স্টার থিয়েটার এর পাশে একটা টেলারিং এর দোকান, তার বাম পাস থেকে
একটা গলি ঢুকে গেছে অনেকটা, তারই শেষপ্রান্তে একটা বড় বাড়ি।
তিনতলা মোটের ওপর, একটু পুরনো গোছের, শাহী ব্যাপারে ধস লেগেছে, লাল ইট গুলো কোথাও দেওয়াল ভেদ করে হাড়ের মত তাকিয়ে আছে।
মিস্টার তালুকদার, ঘরের মালিক। ফোনে ওনার সাথে কথা বলে বেশ ভালই লেগেছিল।
উনি সেদিন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, পৌঁছানো মাত্র হাসি মুখে অভ্যর্থনা
জানালেন।
বয়স ষাট ছুইবে, মাথা চকচকে, একটা পুরনো ফ্রেমের চশমা ও সঙ্গে ধুতি আর একটা সাদা
ফতুয়া মত পরে আছেন।
আমার ঘরটা একদম ওপরের তলায়।
পাশে আর একটি ঘর, ভাড়াটিয়া আরও আছেন সম্ভবত।
দুটি ঘর লাগোয়া ছাদ, দুজনের জন্যই বরাদ্দ।
দেখে মন টা একটু শান্তি পেলাম, খোলা
আকাশের ছাদটা নিজের কাছে পেয়ে।
এরই একপাশে ফুলের টব, বেশ সাজানো গোছানো। দেখে তো মনে হয় কোনও মহিলার হাতের জাদু
লেগে আছে এই স্থানে। মিলে রাখা জামা কাপড় দেখলেও সেটা প্রমাণ হয়।
………………………………………………………………………..
সেদিন আর অফিস যাইনি, ফোনে কথা বলেই নিয়েছিলাম। আমার ঘরটা বেশ বড়, দুজন সাছন্দে
থাকতে পারে। মোট দুটো রুম, একটা সামনের ঘর, সাজালে দারুণ লাগবে, কিন্তু ওত সময় কই। ভেতরের ঘরটা রান্নার জন্য, লাগোয়া বাথরুম
আছে।
ওপর দিকে একটা চোরাই বাঙ্কারের মত আছে, বেশ বড় কিছু লুকিয়ে রাখতে কাজে লাগবে।
শেষের ঐ ভারি ব্যাগটা ওখানেই রেখে দেবো কোনরকমে।
তক্তপোষ একটা আগে থেকেই ছিল, সেটা ঝারাঝারি করতে আর ঘরটা একটু গুছোতে গুছোতে কখন
যে বেলা ২টো পেরিয়ে গেছে, টের পেলাম না।
নিচে নামার সময় দেখলাম, তালুকদার মশাই লুঙ্গি পরে সামনের চেয়ার এ বসে আছেন, তর্জনী
ও মধ্যমার মাঝে একটি সিল্ককাট, কায়দা করে ধরা।
“ মেসোমসাই, একটু ডিস্টার্ব করবো। কাছে পিঠে কোথাও হোটেল আছে ভাত খাওয়ার ?”,
জিজ্ঞেস করলাম।
“ সেকি, এখনও তোমার খাওয়া হয়নি ? ওহ আমারই ভুল। একটু কিছু আজকের জন্য রান্না করে
রাখতে পারতাম, তোমার ভাল হতো। আসলে কি জানোতো, বৌ চলে যাবার পর আর কিছু ঠিক রাখতে পারি না বাবা।
তুমি কিছু মনে করো না। “
একটু লজ্জায় পরে গেলাম এরকম কথা শুনে, “ না না, মেসোমসাই কোনও সমস্যা নেই। আপনি
মোটামুটি সামনে কোথাও ভাল হোটেলের সন্ধান দিলেই হোল। আপাতত দুপুরটা কাজ সারা যাবে।
“
“ ঠিক আছে বাবা, শোনো। গলি থেকে বেড়িয়ে ঠিক ঐ পারে দেখবে বিনুদার কেবিন আছে। ওর
ঠিক পাশেই একটা হোটেল আছে, দারুণ খাবার বানায়। তবে অল্প পরিমাণে, দিনের টা দিনে
শেষ করে দেয়। এই এলাকার মধ্যে ওর খাবার সব থেকে আগে শেষ হয়, টাটকা বানায় রোজ কিনা “
“ ধন্যবাদ, মেসোমশাই ”, এই বলে পিছন ফিরতেই এগোতে যাবো, উনি আমাকে পিছু ডাকলেন, “
বাবা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ? ওপরে তোমার রুমের পাশে মিস্টার সেনগুপ্ত বাবুর সাথে
আলাপ হয়েছে ? “
“ না হয়নি , আমি তো সারাক্ষণ ঘরের ভেতরেই ছিলাম। “
মুখে একটা আশ্বস্ত হওয়ার ছাপ, বললেন, “ যত আলাপ না হয়, ততই ভাল। “
“ কেন মেসোমশাই ? “
“ ও কিছুনা, তুমি যাও তাড়াতাড়ি। খাবার শেষ হয়ে গেলে দিনের বেলা অভুক্ত থাকতে হবে। আর
হ্যাঁ, আজ রাতের খাবারটা আমি করে খাওয়াবো। কাল থেকে তুমি তোমার মত করে শুরু করো
। রাতে ভাত চলবে তো ?“
রাতে আমি আসলে রুটি খাই, কিন্তু এভাবে না বলাটা ঠিক বিবেকে ঠেকল।
হাসিমুখে জানিয়ে দিলাম, “ বিলক্ষণ, কোনও অসুবিধে নেই।“
বেলা সাড়ে তিনতে বাজে, দুপুরের খাওয়া টা
বেশ ভারি হয়েছে।
সারাদিনের খাটুনি চোখে ভাতঘুমের ঢল নামিয়ে দিয়েছে।
………………………………………………………………………………..
ঘুম
ভাঙল কড়া নাড়ার শব্দে। এখন কটা বাজে জানিনা। রান্না ঘরের জানালা থেকে রোদ আর দেখা
যাছে না, সম্ভবত সন্ধে হয়ে গেছে।
আবারও দরজায় খট খট !
দরজা খুলতেই দেখলাম একজন ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছেন, মাথায় কাচা পাকা চুল, গায়ে একটা ঘিয়ে
কিন্তু পুরনো পাঞ্জাবি, কলারের অংশে নীল সুতোর ডিজাইন এর সেলাই করা, ছোট্ট একটা
গোঁফ, কিন্তু সেটা যেন পরিচিতি পায় না।
“ নমস্কার ভাই, আপনি আজ এসেছেন শুনলাম তালুকদার বাবুর কাছে। আমার নাম বিমান
সেনগুপ্ত, এই পাশের রুমটা তে সস্ত্রীক থাকি। আপনি ব্যাচেলর বোধয় ! “
এত গুলো কথা মাথাটা যেন ঘেঁটে দিয়েছে আমার। একেই ঘুমের ঘোর কাটেনি, তার ওপর অজানা
ব্যক্তির আলাপ। থাক, বয়স্ক মানুষ। সঙ্গী পান না হয়তো, তাই কিছু মনে করলাম না।
বললাম “ হ্যাঁ, আমি আজই এসেছি। আসলে তেমন কিছু গুছিয়ে ওঠা এখনও হয়নি, তাই একটু...”
কথা থামিয়ে উনি বললেন, “ আর বলতে হবে না ভাই, বুঝেছি। গুছিয়ে নাও। তবে একটা আর জি
ছিল।
আজ একটু সময় করে আমাদের ঘরে আসার জন্য নেমন্তন্ন করতে এলাম। এসো ভাই তুমি, আমার
স্ত্রী আপনার সাথে দেখা করতে খুব উৎসুক।“
কথাটা কেমন যেন শোনালো আমার কানে। এলাম আজকেই, আর এরই মধ্যে বেয়াড়া একটা আবদার করে
বসলেন উনি। হজম করতে একটু কষ্ট হছে। শরীর ছানাবড়া হয়ে আছে একেই, তার ওপর ঘরের হাল
খারাপ।
বয়স্ক মানুষ উনি, কি করা যায় আর, মুখের ওপর না তো করা যায় না।
………………………………………………………………………………………….
ঘড়ির কাটা আঁটটার কাছাকাছি যখন, মনে পড়ল পাশের বাড়িতে যাওয়ার কথা।
দরজার ওপর একটা নেম প্লেট লাগানো, বেশ পুরনো।
এনারা তাহলে অনেক দিনের ভাড়াটিয়া।
দরজায় কড়া নাড়তেই মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে গেলো, মনে হোল আমার জন্যই যেন তারা ওত
পেতে বসে ছিলেন।
যে ভদ্রমহিলা দরজার খুললেন, উনিও মোটামুটি বয়স্কা, পুরনো যুগের শাড়ী, কপাল আর হাতে
লাল সাদা ঐতিজ্য এর চিহ্ন দেখা যায় স্পষ্ট।
“ এসো বাবা, এসো “, বলে আমাকে আপ্যায়ন করলেন। বেশ লাগলো ওনাকে দেখতে, মা সুলভ একটা
ব্যপার আছে।
ঘরে ঢোকা মাত্র বেশ লাগলো। ভেতরের দেয়ালে হালকা সবুজ রঙ, আলোর ছটা বাড়িয়ে দিয়েছে। বেশ
সাজানো গোছানো একটা ছিমছাম পরিবেশ। ঢুকেই ডানদিকে একটা ছোট্ট সোফা খয়েরি রঙের,
সেটায় বসলাম।
“ কি খাবে বোলো ? আপাতত একটু চা করি ?”
“ কাকিমা আজ কিছু খাব না”, খিদে একটু যে পেয়েছিল সেটা তো আর প্রথম দেখাতেই বলতে
পারিনা। দুপুরের খাওয়া কোনও কালেই হজম হয়ে গেছে। জানিনা মুখের ভাব দেখে টের
পেয়েছিলেন কিনা, “ প্রথম এলে, একটু চা করছি। রাতের খাবারটা এখানে খেয়ে যেতে হবে
কিন্তু “, ভদ্রমহিলা খুব জোরের সাথে বললেন সে কথা।
এরকম হঠাৎ প্রস্তাবটা আবারও নিতে পারিনি, বললাম “ না কাকিমা আজ থাক, অন্য একদিন “
কথাটা শুনে ওনার মুখ টা কেমন যেন পাঁশুটে হয়ে গেল, মনে মনে হয়তো একটু কষ্ট পেলেন,
কিন্তু বুঝতে দিলেন না।
“ যাক বাবা, তুমি আমায় কাকিমা বললে, এটুকুই শুনে মনটা ভরে উঠলো।“ বলে ঐ ঘরে চলে গেলেন ।
বসে বসে ঘরটা দেখতে থাকলাম।
আমি ততক্ষণে পাশে রাখা কাঠের শোকেস এর দিকে তাকালাম। বইএর গন্ধমাদন পর্বত। এনারা খুব
বই পড়তে ভালবাসেন।
চোখ পড়ল সেই তাকের একদম ওপরে, একটি মেয়ে এর ছবি।
চমকে উঠলাম সেটা দেখে। ছবিটা যেন হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে, যেন কথা বলছে। যেন অনেক
দিনের চেনা।
মুখের মধ্যে একটা মায়াময় ভাব লুকিয়ে আছে, যে কেও দেখলে প্রেম এ পরে যেতে পারে।
ছবিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে সেনগুপ্ত বাবুকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “ আমার মেয়ে,
বাইরে কাজ করে, তোমারই মত। “ ।
…………………………………………………………………………………………
রাত্রি ১০টা ১০ বাজে প্রায়।
নিজের বিছানায় একটু হেলান দিয়ে শুয়ে আছি।
মেসোমশাই এর ঘরে নিমতন্ন রক্ষার জন্য যেতে হবে, এত শখ করে বলেছেন। কিন্তু পেটটা যে
ভরা রয়েছে, সেনগুপ্ত কাকিমা শুধু চা তে ক্ষান্ত হননি। উনি নিজের হাতে পরটা আর আলুর
তরকারি সাথে সাথে বানিয়ে দিয়েছিলেন। খুব যত্ন করছিলেন, নিজের ছেলের মত। খুব গল্প
প্রিয় মানুষ এনারা, নিঃসঙ্গ বোধ করেন হয়তো।
একটা ব্যাপারে মনটা বড্ড উসখুস করছিল। মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে ওনারা কেমন
যেন একটু দমে যান। ব্যাপারটা যতটা অদ্ভুত, তার থেকেও বড্ড
অমিল ঠেকছে ওনাদের হাসিমুখের সাথে, কোথাও যেন কিছু একটা মিসিং আছে।
মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দরী না বললেও, চমক আছে । বয়স তো আমার কাছাকাছি হবে। মনে মনে ভাবলাম, প্রেম করলে এমন মেয়ের
সাথেই প্রেম করবো আর নিজের ভালোবাসা কে নিয়ে সারাজীবন ঘুরে বেড়াবো।
এই রে ! এসব কি ভাবছি আমি, যাই মেসোমশাই এর ঘরে যাই।
কড়া নাড়তেই উনি দরজা খুলে দিলেন।
“ এসো এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। আমি আবার গল্প করতে খুব ভালবাসি। তোমার সাথে
একটু আড্ডা দেবো। খাওয়া পর্ব কিন্তু রাত ১১ টায়, কি চলবে তো ? “
একটু হেসে বললাম, “ নিশ্চয় মেসোমশাই, আমার পেটটা এখনও খালি হয়নি। সেনগুপ্ত বাবুর
ঘরে গিয়ে এতো খাবার খাওয়ালেন।“
একটু থমকে গেলেন, তারপর আমাকে বসতে বললেন একটা জায়গা দেখিয়ে। টেলিভিশন টা মেইন
থেকে বন্ধ করে দিয়ে এসে বসলেন আমার সামনেই।
গলার স্বরটা একটু চাপা ও আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, “ সেনগুপ্ত বাবু কি নিজে তোমার
সাথে আলাপ করতে এসেছিলেন ?”
আদ্যপ্রান্ত সমস্তটাই আমি বলতে একটু চুপ করে কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন, “ ওনার সাথে
বেশী না মেশাই ভাল। নেহাত পুরনো ভাড়াটিয়া, তাই কথা বলি ঐ মাসে এক বার হয়তো, মাসের
ভাড়া দিতে আসে যখন।“
কৌতূহল বশত জিজ্ঞেস করলাম, “মেসোমশাই, একটা প্রশ্ন করবো ? ওনার মেয়ের সাথে কি
ওনাদের কোনও সমস্যা আছে ?”
তালুকদার মশাই হঠাৎ চোখ কপালে তুলে বললেন, “ সেটাই ওনাদের বড় সমস্যা। পরে একদিন
বলবো না হয়। এখন এসব তোমার না জানলেও হবে।
“
অগোছালো উত্তর পেয়ে আমার কিন্তু মনটা সায় দিলনা। ঠোটের ডগায় প্রশ্নটা এসেও আঁটকে
গেলো।
…………………………………………………………………………….
নিজের রুম এ ঢুকলাম যখন, ১১টা বেজে ৪৫ মিনিট।
রুমটায় অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি এই মুহূর্তে।
বিছানার চাদর আমি পেতে গেছিলাম, সেটা এখন যেন এক পাশে গুটিয়ে আছে, কেও যেন ঘেঁটে
দিয়েছে। শুধু তাই না, রান্না ঘরটাও ঠিক যেন আগের মত নেই।
সম্ভবত এগুলো আমি করেছি, মনে করতে পারি না।
ওপরের বাঙ্কারে উঠে দেখলাম, রাখা ঐ বড়
ব্যাগটার চেনটা একটু যেন খোলা মনে হোল। দেখে নিলাম, সব ঠিকই আছে।
অতো কিছু ভাব্বার সময় নেই এখন। সারাদিনের একটা ক্লান্তি যখন সারা শরীরএ ছড়িয়ে
পড়েছে, এলিয়ে দিলাম শরীরটা।
ঘুম ভেঙ্গে গেল পাশের রুমের আওয়াজে। জোরে জোরে কেও সম্ভবত কথা বলছেন।
নতুন ঘরে ঘুম সচরাচর আমার হয়না। কিন্তু কাচা ঘুম এভাবে কেটে গেলে একটু বিরক্ত
লাগে। পাশ থেকে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে জল ঢাললাম গলায়। কানে যাছে স্পষ্ট কথাগুলো, “
মাম, তুই কোথায় ? কথা বলছিস না কেন ? “
পাশের রুমের সেনগুপ্ত বাবুর গলা না ? এত রাত্রে ? পাশে থাকা মোবাইল এ দেখলাম,দুটো
বাজে।
ফোনে কথা বলছেন নাকি ?
মাম ওনাদের মেয়ের নাম সম্ভবত, কিন্তু এখন এই রাত্রে ফোনে কথা বলছে নাকি ?
মাথার কি ব্যারাম আছে ?
দেখে তো বোঝা যায় না, তাহলে ? ওদিকে আবার হঠাৎ একটি মহিলা কণ্ঠের চিৎকার, সেনগুপ্ত
কাকিমা সম্ভবত। উনিও জোরে জোরে কিছু একটা বলছেন, আর কাঁদছেন। মাথাটা বনবন করছে, এ
কোথায় এসে পড়লাম আমি। ছোট খাটো পাগলাগারদ নাকি ?
এই জন্য কি মেসোমশাই মশাই ওদের সাথে মিশতে মানা করেছেন ?
কানে বালিশটা চেপে আবার শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যি সমস্ত শোরগোল চুপ করে
গেলো। এবার একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে। মনে মনে ভাবলাম এরকমটা কি আমাকে রোজ সহ্য
করতে হবে ?
ভাবনা টা ছারখার করে দিলো রান্না ঘরের একটা শব্দ। কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়েছে।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো।
আওয়াজটা ধপ করে কিছু পড়ার।
সেই বাঙ্কার থেকে কিছু একটা পড়েছে, কিন্তু সেখানে তো আমার বড় ব্যাগটা ছাড়া আর কিছু
নেই। তাহলে ?
ভাবতেই শিউরে উঠলো গা।
উকি মেরে দেখলাম, রাতের আলো খোলা জানালা টপকে পড়েছে রান্না ঘরের মাঝে।
মুহূর্তের মধ্যে মনে হোল ঘরের উষ্ণতা সামান্য যেন বেড়ে গেছে। ভেতরে একপ্রকার
অনুভুতি হোল, আমি ঘরে একা নই।
একটা কিছু মনে হয়, ভেতরে ভেতরে, সেটা প্রকাশ কড়া যায় না, অনুভব করা ছাড়া।
মুহূর্তের মধ্যে একটা দৃশ্য চোখে পরে গেল। রান্না ঘরের আলোতে কিছু একটা বাঁধা
পড়ছে, কিছু একটা ঠিক তার সামনে যেন দাড়িয়ে আছে।
শরীরে সমগ্র জোর দিয়ে একটু মাথাটা ওঠাতেই চমকে উঠলাম, একটা কালো কিছু দেখলাম যেন।
থপ করে শুয়ে পড়লাম আবার। একী দেখলাম আমি। ছায়া ঠিক না, যেন কালো রঙের মেঘ দলা
পাকিয়ে রয়েছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হোল।
গলাটা শুকিয়ে গেছে, শরীর আর হেলাতে পারছি না। বোবায় ধরেছে কিনা জানিনা। ঘন কালো
মেঘের মত ওটা কি ?
ওটা চলতে শুরু করেছে কেন ? ধীরে ধীরে ওটা ডানদিকে চলেছে ভেসে ভেসে।
কি করবো আমি ? এভাবে শুয়ে থাকলে ওটা তো ওঘর থেকে এই ঘরে চলে আসবে, তখন আমি কোথায়
যাবো ?
পা নাড়াতে পারছিনা, কি করে আমি বাঁচবো ওর থেকে, এটাই মনে হছে।
মাথা কাজ করছে না একটুও। কিছু ভাব্বার অবকাশ নেই।
কালো ঘন চাই আকারের মেঘ দানা বেঁধে আছে রান্না ঘরে, শুয়ে শুয়েই দেখা যাছে এখন।
না আছে শরীর না আছে কোন আকার।
ওমা। এটা আবার চলতে শুরু করেছে। কি সর্বনাশ, আমি কি করবো এখন ?
নড়াচড়া করছে রান্নাঘরে, ভাসা ভাসা।
ঘর টা পেরিয়ে গেলেই তো আমার সাথে একটা দেওয়াল ব্যবধান মাত্র।
এগতে শুরু করেছ। আমি আবারও শরীর নাড়াতে পারছিনা।
এ আমি কোথায় এসে পড়লাম।
অন্ধকারটা এবার দেওয়াল পেরিয়ে একটু একটু করে চোখে পড়তে লাগলো সরাসরি।
সম্পূর্ণ ঘন কালো অংশটা কেমন যেন ভেতর থেকে কিছু একটা হতে থাকল, যেন কিছু একটা
ঘটছে।
দেখতে দেখতেই ওপরের ঘন মেঘ অংশটা মাথার আকারের মত কিছু ধারণ করতে থাকল।
দেখেতো মেয়ের মতই লাগছে।
বুকে আরও জোরে জোরে হাতুড়ি পিটছে।
এগিয়ে আসছে আমার দিকে, আমার শরীর একদম অবশ। নিঃশ্বাস নিছি কিনা আমি জানিনা, মনে
করতে পারছি না।
মেঘের পুঞ্জগুলো জমা হয়ে একটি শরীরের আকার নিছে, হ্যাঁ একটা মেয়ের শরীর।
একটা মেয়ে, মুখ টা তৈরি হছে, আস্তে আস্তে। মুখটা কেমন যেন চেনা লাগছে, কোথাও
দেখেছি যেন।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, এটা মাম, সেনগুপ্ত বাবুর মেয়ে। হ্যাঁ আমি ঠিক বলছি, ঠিক একদম।
পুরনো একটা জামা গায়ে, ময়লা লেগে আছে, চোখের মনি দুটো ওপর দিকে। গলার কাছে একটা পোঁচ
লেগেছে, রক্ত লাগা কালো দাগ, দুই হাত আমার দিকে বাড়িয়েছে।
আরও সামনে এগিয়ে আসছে। মুখের আকৃতি আস্তে আস্তে বড় হছে, আরও বড়
নিঃশ্বাস পড়ছে আমার মুখের ওপর আর আমি আমি আমি...
……………………………………………………………………………
সকাল কটা বাজে জানিনা। দরজায় ধরাম ধরাম আওয়াজ আসছে। ওপাশ থেকে তালুকদার মশাই এর
গলা। আমায় ডাকছেন জোরে জোরে, আর আমি মেঝেতে শুয়ে পড়ে আছি।
উঠে বসলাম যখন, মাথাটা প্রচণ্ড ভার হয়ে আছে পেছনের দিকটায়। কোনও রকমে উঠে দরজা
খুলতেই, মেসোমশাই প্রায় দমবন্ধ কড়া অবস্থায় যেন ঘরের ভেতরে ঢুকলেন।
“ কি হয়েছে তোমার ? কটা বাজে দেখেছ ?”
টেবিলে রাখা হাতঘড়ি দেখলাম, সকাল ১০টা।
“ আমার মুখ দেখে উনি বললেন, রাতে কি ভাল ঘুম হয়নি ? এতো দেরি হছে দেখে আমি উঠে
এলাম নিচ থেকে। কতক্ষণ তোমার ঘরে কড়া নাড়া দিছি। আমিতো জানি তুমি সকাল ৮টার মধ্যে
অফিস যাও, সেরকমই তো টেলিফোনে বলেছিলে আমায়। তাই খুব চিন্তিত হয়ে ওপরে এলাম। “
ওনার এত কথার কোনও ভ্রূক্ষেপ করলাম না। সিধে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
“মেসোমশাই, আপনি বোধয় ঠিক বলেছেন। সেনগুপ্ত বাবুরা একটু কেমন অদ্ভুত প্রকৃতির “
“ কেন ? কাল কিছু ঘটেছে নাকি ?”, গলাটা হঠাৎ একটু কমিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“ কাল মাঝরাতে ওরা কি চিৎকার করছিল
টেলিফোনে। সম্ভবত মেয়ের সাথে কথা বলছিল। কিন্তু ওত রাত্রে কেন ? ওনার স্ত্রী
পর্যন্ত উন্মাদের মত চিৎকার করেন। এসব কি রোজ মাঝরাতে হয় ?”
“ তুমি ঠিক শুনেছ উনি ওনার মেয়ের সাথে কথা বলছিলেন ?”
“ সেরকমই তো মনে হোল। মাম কি ওনার মেয়ের নাম ? এই নামেই উনি বার বার বলছিলেন। “
“ হ্যাঁ, মাম ওনাদের মেয়ের নাম। বড্ড ভাল মেয়ে ছিল। “
“ ছিল ? মানে ?”
“ ওনাদের মেয়ে মারা গেছে। পুলিশ অন্তত তাই বলছে।“
“ কিছু মাথায় ঢুকছেনা, একটু পরিষ্কার করে বলবেন ?”
“ কথাগুলো আমি আগেই বলতে পারতাম। যাইহোক শোনো, মেয়েটা চাকরি সুত্রে কাজ করত পুরীতে,
তোমার ভুবনেশ্বরে । ৬ মাস অন্তর ছুটি নিয়ে চলে আসত এখানে, তখন ঐ পরিবার দারুণ
খোশমেজাজে থাকতো। দারুণ মেয়ে, দেখতেও ভাল, কাজেও পটু। আমায় তোমার মতই মেসোমশাই
বলতো।
ওদের কাজের শিফটিং নাইট এও থাকতো, মাঝরাতে তাই মাঝে মধ্যে কল করত মেয়েটি টার বাবা
মা কে।
এই গত মাসেরই কথা, হঠাৎ বেশ কিছুদিন মেয়েটা আর ফোন করেনি। প্রথমে কিছুদিন কিছু ভাবেনি।
সেটা যখন এক সপ্তাহ তে গড়াল, এবার চিন্তিত হোল। মোবাইল ফোনে পাওয়া গেলো না, সেটা
সুইচ অফ।
শেষমেশ পুলিশের দ্বারস্থ হতে হোল, কিন্তু কোনও ফল তেমন মিলল না। মেয়েটাকে পাওয়া
যাছে না।
অফিসের তরফ থেকে একটাই খবর শুধু পেয়েছিলো, কিছুদিন ধরে মেয়েটি খুব উত্তেজিত ছিল,
কাজ কর্ম তেমন ভাবে মন বসাতে পারেনি। কারোর সাথে কোনও রকমের সম্পর্ক ছিল কিনা,
সেটাও সঠিক বলতে পারছে না কেউ। এই চরম
সত্য যখন সেনগুপ্ত পরিবারে আছড়ে পড়ল, তখন ওরা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। তারপর
থেকেই ওরা কেমন একটা পাগল গোছের হয়ে গেছে। সেই থেকে প্রতি রাত্রে ওরা ফোন করে, সেই
মোবাইল এ, যদি ফোনটা ধরে ওদের মেয়ে। আমি ওদের বুঝিয়ে ক্লান্ত, কিন্তু কি করবো
বোলো।“
“ কিন্তু কাল আমাকে এত করে ডাকার মানে কি ? কাল ওরা যে ডেকে খাওয়া দাওয়া করাল ?”
“ মেয়েটা তোমারই বয়সের ছিল তো। হয়তো তোমাকে দেখে ভাল লেগেছিলও। এটাই কারন হয়তো। “
বেলা করে অফিস গেলেও সমস্যা নেই, ওদের ফোনে বলে দিতে হবে। আজ অবশ্য কাজ বলতে নতুন
অফিস ভিসিট।
তালুকদার বাবু কে নিশ্চিন্ত করে দরজা বন্ধ করে দিলাম, স্নান টা সাড়তে হবে। আজ
বাইরেই খেয়ে নেবো।
……………………………………………………………………………………..`
রান্না ঘরে যাওয়ার সময় ঠিক মনে পরে গেল রাত্তিরের ঘটনা, ইছে করেই মেসোমশাই কে
বলিনি।
ওঘরে গিয়ে দেখলাম, বাঙ্কার থেকে কিছুই পড়েনি।
বড় ব্যাগের চেনটা একটু খোলা।
চেনটা পুরো খুলে দেখেনিলাম, মাম এর দেহটা ঠিক সেরকমই আছে যেমন সিল করে এনেছিলাম।
অনেক হ্যাপা আছে, এই ডেডবডি কে প্যাকিং করার। প্রথমে সেই বডিটা পুরো প্লাস্টিকে ঢোকাতে
হবে, তারপর সেই প্লাস্টিকটাকে বায়ু শূন্য করতে হবে সম্পূর্ণ, একমাত্র তখনই সেই বডি
অনেকদিন পর্যন্ত ঠিক থাকবে।
যদি জানতাম মাম এর মা বাবা এখানেই থাকে, ভুল করেও এই বাড়িতে উঠতাম না।
মাম কে আমি ভালবাসি খুব, ওকে ছাড়া আমি বাচবনা। কতবার বললাম ওকে, আমায় ভালবাসতে।
কিছুতেই শুনল না। একমাস আগে সেই দিনে ওকে কোনারকের মন্দিরের সামনে মোহনার কাছে,
শেষ বারের মত ডাকলাম।
কেও থাকেনা ওখানে, আমি জানতাম। যখন আর আমার কথা শুনল না, পকেট থেকে একটা নাইলন এর
দড়ি বার করে একটার পর একটা পাক দিতে থাকলাম। শুধু পাক দিতেই থাকলাম আর ওর দম বন্ধ
হতে থাকল। তারপর একটা সময়ে সূর্য ডুবে গেল।
কাল বোধহয় ওর বাবা মা এর কান্না ইহ জগৎ ছেড়ে ঐ জগতে পৌঁছে গিয়েছিল।
নয়তো এতদিন ওকে নিয়ে নিজের রুম এ ছিলাম, এমন তো হয়নি।
পুলিশ এর ভয়ে চলে আসলাম ট্রান্সফার নিয়ে, সদ্য নতুন বড় ব্যাগে ওকে ঢুকিয়ে।
ওখানে
থাকা সেফ ছিল না আর।
আমি তো ওকে ভালবাসি। আগেই তো বলেছি, নিজের ভালোবাসা কে নিয়ে আমি সব জায়গায় যেতে
চাই।
একটা বড় ফ্রিজ কিনতে হবে শুধু, কোন ফ্রিজ টা ভাল হবে বলতে পারো ?
ভয়ঙ্কর ব্যাপার
ReplyDeleteসঙ্গে থেকো বন্ধু, এভাবেই।
Delete